ঢাবির ভর্তি পরীক্ষা-জিনিয়াদের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ by মোহাম্মদ গোলাম রব্বানী

যেসব শিক্ষার্থী অন্যসব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়েও ভর্তি হয়নি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে তাদের ভর্তির নিশ্চয়তা দিতে হবে। ভর্তি পরীক্ষার প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত যেসব ব্যক্তি এর জন্য দায়ী তাদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দক্ষতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করাএখন সময়ের দাবিবাংলাদেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠগুলোর অন্যতম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা পাসের পর উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন নিয়ে যেসব
শিক্ষার্থী ভর্তিযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়, তাদের অধিকাংশের পছন্দের তালিকার শীর্ষে থাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতি বছর লক্ষাধিক মেধাবী শিক্ষার্থী এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে ভর্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে, যা থেকে মাত্র কয়েক হাজার ভর্তি হওয়ার সুযোগ পায়। বলাই বাহুল্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর একটি বিষয়। তাই ভর্তি পরীক্ষা এবং ভর্তি প্রক্রিয়ায় শতভাগ দক্ষতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় প্রায়ই এই কাজটি করতে ব্যর্থ হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এর আগেও ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে নানা অনিয়ম ও দায়িত্বে অবহেলার ঘটনা ঘটেছে। কিছুদিন আগেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত বেশকিছু শিক্ষার্থীর ভর্তি বাতিল করা হয়েছে দুর্নীতির মাধ্যমে ভর্তি হওয়ার অভিযোগে। এতে দুর্নীতির মাধ্যমে ভর্তি হওয়া ভুয়া শিক্ষার্থীরা শাস্তি পেলেও তাদের কারণে অন্য যেসব মেধাবী শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছে তারা কি ক্ষতিপূরণ পেয়েছে? তাদের দায়-দায়িত্ব কে নিয়েছে? এসব বিষয় নিয়ে আমরা কেউ কোনো কথা বলিনি। আমরা কথা বলতে চাই না। কারণ নীরবতার সংস্কৃতি আমাদের গ্রাস করেছে। সর্বশেষ ২০১১ সালের 'গ' ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ চরম দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয় দিল, যা শত শত মেধাবী শিক্ষার্থীর জীবনকে চরম সংকটে ফেলে দিয়েছে। একটি উদাহরণ থেকেই তার প্রমাণ পাওয়া যাবে।
ফাহমিদা ইসলাম জিনিয়া। একজন মেধাবী শিক্ষার্থী। একটি সংগ্রামী জীবন। ঢাকা শিক্ষা বোর্ড ল্যাবরেটরি স্কুল থেকে গোল্ডেন জিপিএ-৫ নিয়ে এসএসসি পাস করেছে। ঢাকা কমার্স কলেজ থেকে জিপিএ-৫ নিয়ে এইচএসসি পাস করেছে। ২০১০ সালের ভর্তি পরীক্ষায় তার স্বপ্নের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পছন্দের সাবজেক্ট না পাওয়ায় অন্য কোথাও ভর্তি হয়নি। সারা বছর পড়াশোনা করে আবার ভর্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়েছে এবং ভর্তি সুযোগের শেষ বছর হওয়ায় এবার বাড়তি সতর্কতাও অবলম্বন করেছে। কারণ এ বছর তাকে কোথাও না কোথাও ভর্তি হতেই হবে। অন্যথায় তার উচ্চশিক্ষা লাভের স্বপ্ন থেমে যাবে। ফলে ২০১১ সালের ভর্তি পরীক্ষায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের 'ঙ' ইউনিটে সে চতুর্থ হয়েছে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে 'গ' ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় প্রথমবার প্রকাশিত ফল অনুযায়ী ২১০তম এবং সংশোধিত ফল অনুযায়ী ৪৪তম হয়েছে। অর্থাৎ দুটি ফলের ভিত্তিতেই স্বপ্নের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তার ভর্তি নিশ্চিত। তাই সে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের 'ঙ' ইউনিটে চতুর্থ হওয়া সত্ত্বেও সেখানে ভর্তি হয়নি।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সুবিবেচনাপ্রসূত ভর্তি পরীক্ষার্থীদের পছন্দের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে ভর্তি পরীক্ষার ফল অনেক আগে প্রকাশ করলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশের আগে ভর্তি কার্যক্রম শুরু করেনি। গত ১৩ থেকে ১৭ নভেম্বর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ মেধা তালিকা থেকে ভর্তি প্রক্রিয়া শেষ করেছে। আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাদের 'গ' ইউনিটের পরীক্ষার ফল বাতিল করেছে ২০ নভেম্বর। ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির অপেক্ষায় থাকা জিনিয়াদের শিক্ষাজীবন আজ হুমকির মুখে।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নতুন করে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার তারিখ ঘোষণা করেছে এবং বলেছে, 'যারা ভর্তি পরীক্ষার প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত ছিলেন তারা এত বেশি ভুল করে ফেলেছেন যে, ফের ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া ছাড়া উপায় নেই।' এখন একটি সহজ প্রশ্ন হলো_ 'এত বেশি ভুল' কেন এতদিন পরে এসে ধরা পড়ল। যখন ভর্তি পরীক্ষার্থীদের অন্যসব জায়গায় ভর্তির সুযোগ শেষ হয়ে গেছে? পত্রপত্রিকায় খবর বেরিয়েছে, ভুল উত্তর দিয়ে উত্তরপত্র মূল্যায়ন এবং সঠিক উত্তরবিহীন প্রশ্নপত্র সরবরাহের বিষয়টি খতিয়ে দেখতে ৩ নভেম্বর একটি তদন্ত কমিটি করা হয়। কিন্তু ১৭ দিন পেরিয়ে গেলেও তদন্ত কমিটি কাজ শুরু করেনি। তদন্ত কমিটি যদি ত্বরিতগতিতে তদন্ত শুরু করত তাহলে পরীক্ষা বাতিলের সিদ্ধান্তটি হয়তো অনেক আগেই নেওয়া যেত এবং শিক্ষার্থীরাও খুব বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতো না। সুতরাং ভর্তি প্রক্রিয়ায় যারা জড়িত ছিলেন শুধু তারাই দায়িত্বহীনতার পরিচয় দেননি, বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ প্রশাসনও চরম দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শিক্ষার্থীদের কাছে 'ক্ষমা প্রার্থনা' করেছেন। ইতিমধ্যেই মানসিকভাবে ভেঙে পড়া শিক্ষার্থীরা যদি নতুন করে নেওয়া পরীক্ষায় ভালো করতে না পারে, যদি তাদের স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ না পায় এবং তার মধ্য দিয়ে তাদের শিক্ষাজীবন যদি ব্যাহত হয় তাহলে কী হবে? এসব মেধাবীর জীবনের দায়দায়িত্ব কে নেবে? তাদের শিক্ষাজীবনের নিশ্চয়তা কে দেবে? সুতরাং 'ক্ষমা প্রার্থনা' যথেষ্ট নয়; এটি 'ক্ষমা প্রার্থনা'র সময় নয়। যেসব শিক্ষার্থী অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পাওয়া সত্ত্বেও ভর্তি হয়নি তাদের ভর্তির নিশ্চয়তা দিতে হবে। তারপরই কেবল 'ক্ষমা প্রার্থনা' করার সুযোগ তৈরি হবে।
এ দেশে বিভিন্ন পরীক্ষায় প্রশ্নপত্রে ভুল থাকা এবং পরীক্ষা বাতিল হওয়া নতুন কোনো বিষয় নয়। কিন্তু ঢাবি কর্তৃপক্ষ চরম দায়িত্বজ্ঞানহীনভাবে সংশোধিত ফল প্রকাশের ১৮ দিন পর এসে পরীক্ষার ফল বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি কার্যক্রম শেষ হয়েছে। নিজের দায়বদ্ধতা থেকে এখানে আর একটি বিষয় উল্লেখ করতে হয়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১১ সালের ভর্তি পরীক্ষায় হলে দায়িত্ব পালনকালে 'ছ' ইউনিটের (আইআইটি) পরীক্ষায় প্রশ্নপত্রের প্যাকেটে নির্দেশনা পেলাম_ পরীক্ষায় ক্যালকুলেটর ব্যবহার করা যাবে না। এ নির্দেশনা পাওয়ার পর যথারীতি প্রশ্নপত্র বিতরণের আগেই আমার কক্ষের সব পরীক্ষার্থীকে ক্যালকুলেটর ব্যবহার করা থেকে বিরত রাখি। এক পরীক্ষার্থী তখন দাঁড়িয়ে সাহস করে আমার কাছে জানতে চেয়েছিল_ অন্যান্য কক্ষেও ক্যালকুলেটর ব্যবহার করতে দেওয়া হচ্ছে না সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত কি-না। আমি প্রশ্নপত্রের নির্দেশনার দিকে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করে আশ্বস্ত করেছিলাম যে, সব কক্ষেই একই নির্দেশনা অনুসরণ করা হচ্ছে। সে আশ্বস্ত হয়েছিল। পরে জেনেছি বেশকিছু কক্ষে ক্যালকুলেটর ব্যবহার করতে দেওয়া হয়েছে এবং প্রশ্নপত্রের ধরনটিই ছিল এমন যে, ক্যালকুলেটর ব্যবহার করলে অতি অল্প সময়ের মধ্যে সহজেই উত্তর বের করা যাবে। আর সে কারণেই নাকি সংশ্লিষ্ট অনুষদ ক্যালকুলেটর ব্যবহার নিষেধ করেছিল। পরে পরীক্ষার্থীরা এ নিয়ে প্রতিবাদ জানিয়ে আবার পরীক্ষা নেওয়ার দাবি জানিয়েছিল। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। এর মাধ্যমে কি ন্যায়বিচার হয়েছে? যে পরীক্ষার্থীকে আমি আশ্বস্ত করেছিলাম তার কাছে আমারও ক্ষমা প্রার্থনা করা উচিত। জানি না আমার ক্ষেত্রেও ক্ষমা প্রার্থনা যথেষ্ট কি-না।
এ অবস্থায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃর্পক্ষকে যেসব শিক্ষার্থী অন্যসব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়েও ভর্তি হয়নি তাদের ভর্তির নিশ্চয়তা দিতে হবে। ভর্তি পরীক্ষার প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত যেসব ব্যক্তি এর জন্য দায়ী তাদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দক্ষতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি। এ রকম অসংখ্য দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েও আমরা বহাল তবিয়তে থাকতে পারি এবং আমাদের কোনো জবাবদিহিতা নেই বলেই আজ এত অধঃপতন। সর্বোপরি এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দুর্বলতা। কেন ১৭ দিনেও এত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়ে গঠিত তদন্ত কমিটি কাজ শুরু করল না। এসব বিষয় সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে খতিয়ে দেখার পদক্ষেপ নিতে হবে।


মোহাম্মদ গোলাম রব্বানী : সহকারী অধ্যাপক জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
rabbani_ju@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.