শ্রদ্ধাঞ্জলি-রশীদ করীমের তিরোধানে by হাসনাত আবদুল হাই

শীদ করীম গল্পে-উপন্যাসে এবং প্রবন্ধে যে শৈলী ব্যবহার করেছেন তা তাঁর একান্ত নিজস্ব। বাংলাসহ বিশ্বসাহিত্যের নিবিড় পাঠ তাঁকে এই শৈলী তৈরিতে সাহায্য করেছে। এই শৈলী এমন যা পাণ্ডিত্যকে প্রচ্ছন্ন রেখে খুব সহজভাবে অন্তরঙ্গ স্বরে পাঠকের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেশারীরিক অসুস্থতার কারণে লোকচক্ষুর আড়ালে অনেক আগেই চলে গিয়েছিলেন। এবারে চিরতরে বিদায় নিলেন বাংলা সাহিত্যের শক্তিশালী লেখক রশীদ করীম।


সংখ্যায় খুব বেশি না হলেও তিনি যে কয়েকটি উপন্যাস, গল্প এবং প্রবন্ধ লিখেছেন তার জন্য স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। বাংলাদেশের সাহিত্যের যখন শৈশব সেই বিভাগোত্তর চলি্লশের দশকের শেষ থেকে শুরু করে স্বাধীন বাংলাদেশের পর কয়েক দশক পর্যন্ত তাঁর কলম থেকে বেরিয়েছে সমাজমনস্ক উপন্যাস, নর-নারীর বিভিন্ন সম্পর্কের প্রতিনিধিত্বকারী গল্প এবং বিদগ্ধ প্রবন্ধ। জীবনযাপনে, চিন্তায়, বুদ্ধিবৃত্তির চর্চায় তিনি ছিলেন অবিমিশ্রভাবে নাগরিক। মধ্যবিত্ত এবং উঠতি উচ্চবিত্তের জীবন তিনি বর্ণনা করেছেন তাঁর বিশ্লেষণী পর্যবেক্ষণ এবং কৌতুকবোধের ভিত্তিতে। যে সমাজের চিত্র তিনি তুলে ধরেছেন গল্পে-উপন্যাসে তার বিবর্তন তাঁকে আকৃষ্ট করেছে যার জন্য সময়ের ধারাবাহিকতার পরিচয় রয়েছে তাঁর লেখায়। আধুনিকতার গুণে, জীবনদৃষ্টির গভীরতায় এবং মানবিকতাবোধে উজ্জীবিত হয়ে তিনি যেসব কাহিনী বর্ণনা করেছেন তা একই সঙ্গে বাস্তবানুগ এবং আদর্শমণ্ডিত। তাঁর ছোটগল্প এবং উপন্যাসে একটি পরিশীলিত, সংস্কারমুক্ত এবং শানিত মনের পরিচয় পাওয়া যায়।
এই কারণে তাঁর উত্তম পুরুষ, প্রসন্ন পাষাণসহ সব উপন্যাস আমাদের সাহিত্যে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পেরেছে।
রশীদ করীম গল্প-উপন্যাসের পাশাপাশি এবং সক্রিয় সাহিত্যজীবনের শেষ পর্বে অনেক প্রবন্ধ লিখেছেন। সংবাদপত্র এবং সাহিত্য পত্রিকায় কলাম হিসেবেই এদের আত্মপ্রকাশ। উপন্যাসের চেয়ে আরও বেশি করে তাঁর প্রবন্ধে চিন্তায় মননশীলতা এবং প্রকাশের বৈদগ্ধের পরিচয় পাওয়া যায়। প্রবন্ধে আধুনিক গদ্যের ব্যবহারে তিনি অনেক স্বচ্ছন্দ এবং সফল। শব্দের ব্যবহারে এবং বাক্যবন্ধের গঠনে তিনি নিজস্ব একটি গদ্যশৈলীও তৈরি করেছেন। প্রচলিত বাংলা শব্দে তিনি অনায়াসে ব্যবহার করেছেন আরবি, ফার্সি এবং উর্দু শব্দ। রশীদ করীম কেবল উর্দু-ফার্সি-আরবি শব্দ নয়, বাংলা ভাষার ভেতর থেকেও এমনসব শব্দ তুলে এনে ব্যবহার করেছেন, যাদের সাহিত্যে ব্যবহার কদাচিৎ অথবা একেবারেই নতুন। তাঁর ভাষা ব্যবহারে ইংরেজি বাক্যবন্ধেরও প্রভাব আছে, যার জন্য ভাষার ক্ষেত্রে তার উদারমনস্কতা এবং নিরীক্ষাধর্মিতা আরও স্পষ্ট হয়েছে।
রশীদ করীম গল্পে-উপন্যাসে এবং প্রবন্ধে যে শৈলী ব্যবহার করেছেন তা তাঁর একান্ত নিজস্ব। বাংলাসহ বিশ্বসাহিত্যের নিবিড় পাঠ তাঁকে এই শৈলী তৈরিতে সাহায্য করেছে। এই শৈলী এমন যা পাণ্ডিত্যকে প্রচ্ছন্ন রেখে খুব সহজভাবে অন্তরঙ্গ স্বরে পাঠকের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে। ফলে তাঁর লেখা হয়ে উঠেছে অন্তরঙ্গ কথোপকথন, যেখানে কৃত্রিমতা নেই, আনুষ্ঠানিকতা অনুপস্থিত। এই অন্তরঙ্গতা সত্ত্বেও তিনি লেখায় ব্যক্ত করেছেন সেই আভিজাত্যবোধ যার উৎস মননে ও মেধায়। বাংলা সাহিত্যে যে কয়েকজন মননশীল লেখক চিহ্নিত করা যায় নিঃসন্দেহে তিনি তাঁদের একজন।
প্রচারবিমুখ হয়েও এবং সাহিত্যে গোষ্ঠীর বাইরে থেকেও তিনি স্বীকৃতি পেয়েছেন এবং মর্যাদাশীল নানা পুরস্কার লাভ করেছেন। তাঁর সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি ও অর্জন ছিল পাঠকের সশ্রদ্ধ মনোযোগ এবং সুন্দর অভিজ্ঞতা লাভের পরিতৃপ্তি। মনোযোগ পাঠ শেষে থাকে না, কিন্তু পরিতৃপ্তি স্থায়ী হয়। পাঠকের কাছে রশীদ করীম এই জন্য স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

হাসনাত আবদুল হাই : কথাশিল্পী

No comments

Powered by Blogger.