স্মরণ-নরেন বিশ্বাস : সার্থক বাকশিল্পী

কজন বিশিষ্ট ব্যক্তি বক্তিৃতা দেবার সময় অবলীলায় বলেছেন সনমানিত সবাপতি। কিন্তু তিনি কি ইংরেজি বক্তিৃতা দেবার সময় বলবেন হনারেবল ফ্রেসিডেন্ট? কখনোই তিনি এমন ভুল করবেন না। কারণ তিনি ইংরেজি শেখেন, রপ্ত করেন, কিন্তু বাঙলা তাঁর মাতৃভাষা হলেও এটি শেখার জন্য কোন গরজ অনুভক করেন না।' মাতৃভাষা নিয়ে উপরের এই মমতামাখা কথাগুলো অধ্যাপক নরেন বিশ্বাসের। তিনি তাঁর শিক্ষকতা জীবনে যেমন পড়িয়েছেন


বাংলা, তেমনি আমৃত্যু গবেষণা করেছেন বাংলা ভাষা নিয়ে। তিনি প্রমিত বাংলা উচ্চারণের পথিকৃৎ। শুদ্ধ উচ্চারণের জন্য তিনি তৈরি করেছেন উচ্চারণবিষয়ক বহু সূত্র। 'কণ্ঠশীলন' নামের উচ্চারণবিষয়ক স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানটির তিনি প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন। এ ছাড়াও দেশের প্রায় সব প্রমিত বাংলা উচ্চারণবিষয়ক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ছিল তাঁর অচ্ছদ্যে সম্পর্ক। বাংলা সাহিত্যের ওপর ১৩ পর্বের ক্যাসেট তিনি বের করেন 'ঐতিহ্যের অঙ্গীকার' নামে। সেই চর্যাপদ থেকে শুরু করে আজকের দিনের সাহিত্য পর্যন্ত তিনি সুন্দর করে বন্দি করেছেন ম্যাগনেটিক ফিতায়। তিনি কলকাতার 'আনন্দ পুরস্কার' পান এই অসামান্য অবদানের জন্য। 'বাতাসে লাশের গন্ধ' ও 'ভালো আছি ভালো থেকো, আকাশের ঠিকানায় চিঠি লেখো' খ্যাত রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ছিলেন নরেন বিশ্বাসের ছাত্র। রুদ্র সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সময় মৌখিক পরীক্ষায় এক ছাত্রকে জিজ্ঞাসা করা হলো তোমার নাম কী, সে বলল আমার নাম রুদ্র। আমি রুদ্র নাম শুনে কৌতূহলী হয়ে বললাম রুদ্র! সে বলল জ্বী স্যার। তার কথাবার্তা তখনই আমার দৃষ্টি কেড়েছিল। ছাত্রদের মধ্যে আমি ওর মতো প্রতিভাধর আর কাউকে দেখিনি। পিতা নগেন্দ্রনাথ বিশ্বাস ও মা হরিদাসী বিশ্বাসের ঘরে নরেন বিশ্বাসের জন্ম হয় ১৯৪৫ সালের ১৬ নভেম্বর। তাঁর জন্মস্থান বৃহত্তর ফরিদপুরের মাঝিগাতিতে। তিনি গোপালগঞ্জের ওড়াকান্দি মিড হাই স্কুল থেকে মাধ্যমিক ও শ্রীকৃষ্ণ কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় অনার্স, মাস্টার্স করেন যথাক্রমে ১৯৬৫ ও ১৯৬৬ সালে। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি নাট্যাচর্চার সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষ থেকে তিনি নানা আন্দোলেন অগ্রদূত ছিলেন। এমএ পাস করেই অধ্যাপনা শুরু করেন। ১৯৬৬-৭৬ সাল পর্যন্ত মাদারীপুর নাজিমউদ্দিন কলেজ ও ১৯৭৬ থেকে আমৃত্যু তিনি সহযোগী অধ্যাপক ছিলেন ঢাকা বিশ্যবিদ্যালয়ে। বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধের সময় তিনি পাকিস্তানি বাহিনীর নজর এড়িয়ে কলকাতায় পেঁৗছান। এ সময় বেতারে তিনি সক্রিয় ছিলেন বিভিন্ন নাটক, জীবন্তিকা, নকশা ইত্যাদিতে। নাটক, আবৃত্তি, উচ্চারণ, কথন-এর মতো শৈল্পিক কর্মের কারণে তিনি অনেক খ্যাতি লাভ করেন। তাঁর লেখা জনপ্রিয় কিছু বইয়ের মধ্যে হলো_বাংলা উচ্চারণ অভিধান, প্রসঙ্গ বাংলা ভাষা, বাংলা উচ্চারণ সূত্র, নিহত কুশীলব, রৌদ্রদিন, ক্রুশবিদ্ধ যীশু, তমসীর ফাঁসি ইত্যাদি। এই মানুষটি মনে করতেন তিন ম-এর ঋণ মানুষ কিছুতেই শোধ করতে পারবেন না_মা, মাটি ও মাতৃভাষা। তিনি জানতেন কি না জানি না, তাঁর প্রতি আমাদের, বাঙালি মানুষের যে ঋণ তাও আমরা শোধ করতে পারব না কোনো দিন। আমাদের ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার ঋণে ঋণী করে এই এই মহান মানুষটি ১৯৯৮ সালের ২৭ নভেম্বর আমাদের ছেড়ে না ফেরার পথে পাড়ি জমান।
জাহাঙ্গীর হোসেন অরুণ

No comments

Powered by Blogger.