এইচআইভি পজিটিভ মায়েদেরও সুস্থ সন্তান হতে পারে by সাজিদা ইসলাম পারুল

পাঁচ বছর বয়সী রানী (ছদ্মনাম) স্বাভাবিক জীবন যাপন করলেও সে জানে না তার শরীরে এইচআইভি ভাইরাস বাসা বেঁধেছে। সে জানে না যে, এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েই তার বাবার মৃত্যু হয়েছে। আর এ ভাইরাসের জন্যই তার মায়ের অবস্থা দিন দিন খারাপ হয়ে যাচ্ছে। সংসারের আর্থিক সচ্ছলতার জন্য কোনো একসময় তার বাবা বিদেশে কাজ করতে যান। ৮ বছর পর তিনি দেশে ফিরে আসেন ঠিকই কিন্তু সঙ্গে বয়ে নিয়ে আসেন ভয়াবহ ব্যাধি এইডস।


পরবর্তী সময়ে রানীর মাও এইচআইভিতে আক্রান্ত হন। তারা এসবের কিছুই জানতেন না। রানীর জন্মের কিছুদিনের মধ্যেই হঠাৎ তার বাবা মারা যান। পরে ডাক্তারের পরামর্শে রানীর দেড় বছর বয়সে মা ও মেয়ের রক্ত পরীক্ষা করানো হলে এইচআইভি পজিটিভ ধরা পড়ে।
এইচআইভি সংক্রমিত আরেকজন সুফিয়া বেগম। স্বামীর মাধ্যমে তিনিও পজিটিভ। তার দুই ছেলে। স্বামীর এইডস ধরা পড়ার পর ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী তিনিসহ দুই ছেলের রক্ত পরীক্ষা করান। রিপোর্টে জানা যায়, সুফিয়া ও তার দেড় বছরের ছেলে এইচআইভিতে আক্রান্ত।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, গর্ভবতী মা এবং স্তন্যদায়ী মায়ের কাছ থেকে শিশুর শরীরে এইচআইভি সংক্রমিত হতে পারে। যদি কোনো রকম সাবধানতা না নেওয়া হয় তাহলে একশ' জন গর্ভবতী পজিটিভ মহিলার ৩০ জনের শিশুর শরীরে এইচআইভি সংক্রমিত হতে পারে। যদি সিজারিয়ান অপারেশন দ্বারা ডেলিভারি হয় এবং গর্ভাবস্থায় ও প্রসবকালীন গর্ভবতী মাকে এবং প্রসব-পরবর্তী সময়ে নবজাত শিশুকে এন্টিরেট্রোভাইরাল ওষুধ খাওয়ানো হয় তাহলে সংক্রমণের হার শতকরা ১৫ ভাগে নেমে আসবে। আর যদি নবজাত শিশুকে পজিটিভ মায়ের বুকের দুধ না খাওয়ানো হয় তাহলে এইচআইভি সংক্রমণের হার শতকরা ২ ভাগে নেমে আসবে।
ঢাকার একটি বেসরকারি সংগঠন 'মুক্ত আকাশ বাংলাদেশ' জানায়, এন্টিরেট্রোভাইরাল (এআরভি) ড্রাগ যা এইচআইভি ভাইরাসের বিরুদ্ধে কাজ করে। এখন পর্যন্ত এইচআইভি চিকিৎসার জন্য আবিষ্কৃত বিভিন্ন ওষুধের মধ্যে এআরভি সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য হিসেবে গ্রহণ করা হয়। এআরভি একজন পজিটিভ ব্যক্তির শরীরের ভাইরাল লোড কমিয়ে আনে এবং বিভিন্ন সুযোগ সন্ধানী রোগের বিরুদ্ধে কাজ করে এইডসের রূপান্তর প্রক্রিয়াকে দীর্ঘায়িত করে সুস্থ-সবল রাখে। যখন শরীরের ঈউ৪ সেল কাউন্ট ২০০-এর নিচে নেমে আসে তখন ডাক্তাররা এআরভি গ্রহণের পরামর্শ দিয়ে থাকেন।
ঈউ৪ সেল হচ্ছে শরীরের রক্তের শ্বেতকণিকাগুলোর একটি। এটি মূলত শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণে প্রধান ভূমিকা পালন করে। ঈউ৪ সেলের মাত্রা ২০০ বা ৩০০-এর নিচে এলে বিভিন্ন সুযোগ সন্ধানী রোগের সংক্রমণ হতে পারে এবং এ অবস্থায় এইডস হয়েছে বলা যায়। তখন এআরভি গ্রহণ করতে হবে। কারণ এআরভি গ্রহণ না করা ব্যক্তির তুলনায় এআরভি গ্রহণকারী ব্যক্তির জীবন অনেক বেশি দীর্ঘায়িত হয়।
সাধারণত বাংলাদেশে মানুষের শরীরে স্বাভাবিক ঈউ৪ সেলের মাত্রা ৪১০ থেকে ১৫৯০। কিন্তু বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে এর মাত্রা বিভিন্ন হতে পারে।
এইডস বিশেষজ্ঞ ডা. এএসএ মাসুদ বললেন, 'যদি একশ' জন এইচআইভি পজিটিভ মহিলা গর্ভবতী হন তাহলে কোনো প্রতিরোধ ব্যবস্থা না নিলে শতকরা ৩০ জনের পজিটিভ বাচ্চা এবং ৭০ জনের নেগেটিভ বাচ্চা হতে পারে। যদি একজন পজিটিভ মা সুস্থ সন্তান পেতে চান তাহলে অবশ্যই তিনটি বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। একজন পজিটিভ গর্ভবতী মহিলার এন্টিন্যাটাল চেকআপের সময় ডাক্তারের পরামর্শ মোতাবেক এন্টিরেট্রোভাইরাল থেরাপি নিতে হবে অর্থাৎ গর্ভাবস্থায় ও প্রসবকালে মাকে এবং নবজাত সন্তানকে এআরভি ড্রাগ দেওয়া, সিজারিয়ান অপারেশনের মাধ্যমে ডেলিভারি করানো এবং শিশুর জন্মের পর থেকেই মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানো থেকে বিরত রাখা হয়। এই তিনটি বিষয় সঠিকভাবে পালন করলে মাত্র শতকরা ২ জন শিশুর পজিটিভ হওয়ার আশঙ্কা থাকে।'
তিনি আরও বললেন, 'অনেক এইচআইভি পজিটিভ মা আছেন যাদের বুকের দুধ ভিন্ন অন্য কোনো খাবার শিশুকে দেওয়ার থাকে না। সে ক্ষেত্রে অনেকে দুধমায়ের সাহায্য নিয়ে থাকেন। অথবা বিকল্প খাবার হিসেবে গরুর দুধের সঙ্গে নিরাপদ পানি মিশিয়ে খাওয়ানো যেতে পারে। তবে অবশ্যই পরিষ্কার ও জীবাণুমুক্ত খাবারের পাত্র বা বোতল ব্যবহার করতে হবে। নয়তো শিশু অন্য কোনো জটিল রোগ যেমন_ ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যেতে পারে। আর ডায়রিয়া হয়ে মারা যাওয়ার আশঙ্কা এইডস হয়ে মারা যাওয়ার আশঙ্কার চেয়ে বেশি থাকে। এ ক্ষেত্রে সঠিক বিকল্প খাবার চিহ্নিত করতে মাকে সাহায্য করতে হবে।'
প্রাপ্ত তথ্যমতে, বিশ্বে প্রতিবছর ৮ লাখ শিশু এইচআইভি ভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছে। এর মধ্যে শতকরা ৯০ ভাগ শিশু তার বাবা-মা দ্বারা সংক্রমিত।
এইচআইভি/এইডস নিয়ে কাজ করছে ঢাকার একটি বেসরকারি সংগঠন আশার আলো। এই সংস্থার ট্রেনিং অব প্রোগ্রাম অফিসার তানিয়া মুর্শেদ বললেন, 'শিশুটি এইচআইভি পজিটিভ কি-না তা জানার জন্য দীর্ঘ ১৮ মাস অর্থাৎ দেড় বছর অপেক্ষা করতে হয়। দেড় বছর পর তার রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে পজিটিভ কি-না তা নির্ণয় করা যায়। সাধারণত একটি শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের তুলনায় অনেক কম থাকে। তাই ১৮ মাসের ব্যবধানে শিশুটি অল্পতেই বেশি দুর্বল হয়ে পড়ে। তাই শিশুটিকে বেশিদিন টিকিয়ে রাখার জন্য নিয়মিত পুষ্টিকর খাদ্য খাওয়ানো আবশ্যক। বর্তমানে আশার আলো ২৩ জন এইচআইভি পজিটিভ শিশুর দেখভাল করছে।'
তানিয়া মুর্শেদ এইডস সম্পর্কে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য বিয়ের ক্ষেত্রে ছেলে-মেয়ে উভয়কেই রক্ত পরীক্ষা করে যৌনবাহিত বিভিন্ন রোগ বা এইচআইভি পজিটিভ কি-না তা নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। _নিউজ নেটওয়ার্ক

No comments

Powered by Blogger.