চ্যানেল আইয়ের যুগপূর্তি-প্রথমা by আবুল হায়াত

নন্ত শুভকামনা তোমাকে হে চ্যানেল আই।যুগ যুগ জিও প্রথমা চ্যানেল। কারণ তুমি তো ধারণ করেছ হৃদয়ে বাংলাদেশনাটক কী? : নাটক সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার, এ কথা আমরা বলতাম যখন জোরদারভাবে গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলন করতাম।কথাটা ঠিক না বেঠিক সেটা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। চায়ের কাপে প্রচুর ঝড় চলেছে এ নিয়ে। তবে একটা কথা সত্য যে, নাটক সমাজের দর্পণ, এর ঘটনাবলি বাস্তব জীবন থেকে উঠে আসে প্রায়শই। তবে আরও
যথাযথভাবে বলতে গেলে বুঝতে হয়, নাটক হচ্ছে নাট্যকারের দর্শন। তিনি সমাজকে কীভাবে দেখছেন বা কীভাবে দেখতে চান, সেটাই দর্শকদের সামনে তুলে ধরা হয় প্রযোজনার মাধ্যমে।
নাটক দেখে সমাজ বদলাক বা না বদলাক এর ঘটনাবলি রাষ্ট্রীয়, সামাজিক, পারিবারিক জীবনে কিঞ্চিৎ হলেও প্রভাব ফেলে তার প্রমাণ ভূরি ভূরি আছে। সামান্য উদাহরণ দিতে পারি। দেশে যখন একটি টিভি চ্যানেল ছিল সেই সময় হুমায়ূন আহমেদের এইসব দিনরাত্রির সুখী নীলগঞ্জ প্রজেক্টের মতো বেশকিছু প্রতিষ্ঠানও বাস্তবে গড়ে উঠেছিল। আবার কোথাও কেউ নেই-এর চরিত্র বাকের ভাইয়ের ফাঁসি ঠেকাতে বাস্তব জীবনে আন্দোলনে নেমেছিল জনগণ। আমার নাটক 'বন্দী' দেখে অনেকে তাদের কাজের মেয়েকে বাইরে যাওয়ার সময় তালাবদ্ধ করে যাওয়া থেকে বিরত থেকেছেন।
খুবই সামান্য উদাহরণ। তবু ঘটেছে তো। এতে বলা যেতে পারে, নাটকের প্রভাব জীবনে ছাপ ফেলেই। নইলে চরিত্রের মতো কথা বলা, ফ্যাশন করা, প্রেম করা ইত্যাদি হয় কেন? সেখানেই নাটকের দায়বদ্ধতা_ রাষ্ট্রের কাছে, সমাজের কাছে, পরিবার এবং ব্যক্তির কাছে।
এবার বলি আমরা নাটক করি কেন? এর মুখ্য উদ্দেশ্য শিল্প সৃষ্টি। তারপর আসে সুস্থ বিনোদন প্রদান। এরপর বলতেই হবে, দর্শককে সচেতন করা, সব রকম খারাপ থেকে দূরে সরিয়ে রাখা, ভালোর দিকে আকর্ষণ করা। এগুলোই তো নাটকের দায়বদ্ধতা।
এ দায়বদ্ধতা কোনো একজনের ওপর ন্যস্ত নয় নিশ্চয়; নাট্যকার, শিল্পী, কলাকুশলী, প্রযোজক সবার।
আজ আমি যখন বলতে চাইছিলাম আমাদের প্রিয় চ্যানেল 'চ্যানেল আই'-এর ১২ বছর পূর্তির কথা, তখন নাটকের দায়বদ্ধতার কথা ওঠে কেন? ওঠে এ জন্যই যে চ্যানেল আইও নাটক প্রচার করে। অন্য সব চ্যানেলের মতোই সময়ে, অসময়ে, নিয়মিত-অনিয়মিত, যখন-তখন নাটক প্রচার করে। জনবিনোদনের অন্যতম প্রধান মাধ্যম নাটক। এর প্রচারে কোনো অন্যায় নেই। এর প্রচার দর্শক টানে, দর্শক সচেতন হয়। তার রুচি পরিবর্তন হয় ইত্যাদি ইত্যাদি।
আমরা জানি, আজ থেকে ১২ বছর আগে চ্যানেল আইয়ের জন্ম, কিন্তু তারও আগের কিছু ঘটনা আছে। যাকে আমরা বলতে পারি গর্ভধারণ পর্ব। সেই সময় থেকে আমিও এই চ্যানেলের সঙ্গে জড়িত। তখন বলতাম ইমপ্রেস টেলিফিল্ম লিমিটেড, এই ইমপ্রেস গোষ্ঠী অনেক বিষয়েই আজ প্রথম হওয়ার দাবিদার। প্রথম ডিজিটাল চ্যানেল, প্রথম দুইশ'রও অধিক পর্ব নাটক নির্মাণ-প্রচার (জোয়ার ভাটা), প্রথম চাঁদরাতের নাটক (রেজানুরের), প্রথম কৃষকের ঈদ আনন্দ, প্রথম রাজনীতিবিদদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ভালোবাসার বাংলাদেশ, প্রথম লাক্স-চ্যানেল আই সুপারস্টার তৈরি_ আরও শত শত অনুষ্ঠানেরও ভাবনায় ও প্রচারে প্রথম চ্যানেল আই।
সেই সঙ্গে এই ভাগ্যবান লেখককেও প্রথম নাট্যপরিচালক বানিয়েছিল চ্যানেল আই তথা ইমপ্রেস টেলিফিল্ম। নাটক ছিল প্রণব ভট্টের হারজিৎ। আমার নির্মিত দোলা ছিল চ্যানেল আইয়ে প্রচারিত প্রথম ধারাবাহিক। বিটিভির জন্য প্রথম ৫২ পর্বের প্যাকেজ ধারাবাহিক নির্মাণও আমি করেছিলাম (দূরের আকাশ, নাট্যকার মঈনুল আহসান সাবের) আই পরিবারের প্রযোজনায়। প্রথমে প্রথমে সয়লাব চ্যানেল আই।
ইত্যাকার নানা রকম প্রথমের সঙ্গে আমিও কিঞ্চিৎ জড়িত ছিলাম, সেসব কথাই মনে পড়ছে। পুরনো স্মৃতি তো ভোলার নয়। সিদ্ধেশ্বরীর একটি ফ্ল্যাট থেকে আজ তেজগাঁওয়ের বিশাল কমপ্লেক্সে আসতে চ্যানেল আইকে বহু 'প্রথম'-এর মাধ্যমেই আসতে হয়েছে এবং সাফল্যের সঙ্গেই এসেছে চ্যানেল আই, তা শত্রুও বলবে।
তবে ওই যে নাটক, নাটক সবসময়ই ছিল প্রধান বিনোদন। এখনও আছে। আসলে বলব অনুষ্ঠান প্রযোজনায় যে বৈচিত্র্য তাতেও চ্যানেল আই-ই প্রথম।
প্রথম হওয়ার আনন্দ যেমন, যন্ত্রণাও তেমনই। প্রথমের দিকেই নজর সবার বেশি। তাই দায়বদ্ধতা পালনের ক্ষেত্রেও প্রথম হতে হবে চ্যানেল আইকে। আমি নাটকের মানুষ, নাটকের কথাই বলি।
নাটক যখন প্রথম সারির বিনোদন মাধ্যম একে যথাযথ লালন-পালন করাটাও দায়িত্বে এসে যায় চ্যানেল আইয়ের। সে দায়িত্ব কি সুষ্ঠুভাবে পালন করা হয়েছে? অনেকের মতো আমারও সামান্য আপত্তি আছে এতে। কারণ এই নন্দিত চ্যানেল যেমন প্রচুর ভালো নির্মাতাকে দর্শকের সামনে উপস্থাপন করেছে, তেমনি সুযোগ করে দিয়েছে নানা ভুঁইফোড়কে যারা নাটকের যে শিল্পসত্তা, তাকেই অপমানিত করেছে। এতে নিন্দিত হয়েছে চ্যানেল।
একসময় মানুষ তাদের সন্তানদের বলত_ বেশি বেশি করে টেলিভিশনের নাটক দেখবে, যাতে সুন্দর করে কথা বলা শেখো। আর এখন বাবা-মায়েরা বাচ্চাদের নাটক দেখতে নিষেধ করেন শুধু তাদের বলার ভাষা নষ্ট হওয়ার ভয়ে। এ দায় কি এড়াতে পারবে চ্যানেল আই? এক বালতি দুধের মধ্যে এক ফোঁটা চনাই যথেষ্ট সব দুধকে অখাদ্য করার পক্ষে। হুশিয়ার হতেই হবে।
ওপরের সমালোচনার অংশটুকু হয়তো সবার ভালো লাগবে না। তবু চ্যানেল আইকে ভালোবাসি। সে জন্য এ কথা বলা। সিনেমার ক্ষেত্রেও অনেকে বলেন, চ্যানেল আই সিনেমার জগতে অভূতপূর্ব এক পদক্ষেপ নিয়ে এ শিল্পের উন্নতি ঘটিয়েছে, নির্মাণ-প্রযোজনায় আজ তারাই প্রথম। কিন্তু টিভিতে ওয়ার্ল্ড প্রিমিয়ার দিয়ে দর্শকদের হলবিমুখ করে ফেলেছে তারাই, এ কথাও বলা হয় এই শিল্পজগতে। এও সেই প্রথম হওয়ার জ্বালা বৈকি।
আমি সিনেমার কথা না-ই বলি। নাটকে ফিরে আসি। নাটক ছাড়া এখন কোনো বিনোদন মাধ্যম ভাবাই যায় না যেহেতু, সুতরাং নাটকের মান উন্নয়নেও আমার অনুরোধ, চ্যানেল আইকে প্রথম হতে হবে।
সময়ের নাটক সময়ে প্রচার করতে হবে।
বিজ্ঞাপনের অত্যাচার অবশ্য অবশ্যই কমাতে হবে (কীভাবে সেটা খুঁজে বের করার ক্ষেত্রেও চ্যানেল আইকে প্রথম হতে হবে)।
ভূঁইফোড়দের যন্ত্রণা থেকে দর্শকদের রেহাই দিতে হবে।
মান নিয়ন্ত্রণ সেল করে, সংখ্যা কমিয়ে মান-উত্তীর্ণ নাটকই কেবল প্রচার করতে হবে।
এর জন্য নাটকের মূল্য যথাযথ হিসাব করেই নির্বাচন করতে হবে। কারণ মনে রাখা প্রয়োজন, ১০০ টাকায়ও শার্ট পাওয়া যায়, ১০ হাজার টাকায়ও শার্ট কিনতে পারেন কেউ।
এমন কোনো নাটক অবশ্যই প্রচার থেকে বিরত থাকতে হবে, জীবনে বা সমাজে যার উল্টো প্রতিক্রিয়া হতে পারে। এ কাজটির জন্য মান নিয়ন্ত্রণ সেল অবশ্যই প্রয়োজন।
আজ এ পর্যন্তই। হয়তো অনেক বেশি লিখে ফেলেছি, তবুও বলা তো প্রয়োজন। আমরাই তো বলব। কারণ আমরা চ্যানেল আইকে ভালোবাসি, আপন ভাবি। যুগপূর্তিতে আমাদের চেয়ে বেশি আনন্দিত আর কে?
চ্যানেল আই বহু ক্ষেত্রে প্রথম হয়েছে, যুগপূর্তির দিনে আমি চাইব আগামীতেও সব ক্ষেত্রে প্রথম হোক। অবশ্যই শুধু ভালোর ক্ষেত্রে, সুন্দরের ক্ষেত্রে, দেশের ও জনগণের কল্যাণের ক্ষেত্রে।
অনন্ত শুভকামনা তোমাকে হে চ্যানেল আই।
যুগ যুগ জিও প্রথমা চ্যানেল। কারণ তুমি তো ধারণ করেছ হৃদয়ে বাংলাদেশ।

আবুল হায়াত :সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

No comments

Powered by Blogger.