প্রবীণের প্রজ্ঞা দেশের সম্পদ by ফারহানা রেজা

অক্টোবর আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস। সারাবিশ্বের মতো বাংলাদেশেও এ দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হওয়ার কথা। কিন্তু বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস সরকারিভাবে উদ্যাপিত হতে দেখা যায় না। দু'একটি বেসরকারি সংস্থা, যারা প্রবীণদের নিয়ে কাজ করে; তারাই এক্ষেত্রে কিছুটা ভূমিকা রাখার চেষ্টা করে থাকে।১৯৯০ সালের ১৪ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ১ অক্টোবর আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হওয়ার আগে


থেকেই বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে প্রবীণবান্ধব আইন প্রণীত হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে প্রবীণদের নিয়ে এ পর্যন্ত সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে তেমন জোরালো কোনো কার্যক্রম নেই বললেই চলে। জাতীয় পর্যায়ে প্রবীণদের কল্যাণে কোনো নীতিমালাও এখন পর্যন্ত প্রণীত হয়নি। অথচ আজকে রাষ্ট্র ও সমাজের সামগ্রিক অর্জনের পেছনেও প্রবীণ জনগোষ্ঠীর রয়েছে অসামান্য অবদান। আজ নবীনরা যে রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা উপভোগ করছে এর ৯৯ শতাংশই অবহেলিত প্রবীণদের শ্রম ও ঘামের ফসল। আমাদের দ্রুত পরিবর্তনশীল আর্থসামাজিক পরিবেশে যৌথ বা একান্নবর্তী পরিবারের ধারণাটিই মুছে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। আর সামাজিক এই পরিবর্তন ও অবক্ষয়ের কারণে সবচয়ে বেশি অবহেলার শিকার হচ্ছেন প্রবীণরা। উন্নত বিশ্বে প্রবীণদের 'সিনিয়র সিটিজেন' হিসেবে বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হয়ে থাকে। সেসব দেশে প্রবীণরা আমৃত্যু রাষ্ট্রীয় আনুকূল্য পেয়ে থাকেন। আর আমাদের দেশে বার্ধক্য মানেই পরমুখাপেক্ষী-পরনির্ভরশীলতা। এ দেশে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের কোথাও প্রবীণবান্ধব পরিবেশ নেই। একান্নবর্তী পরিবারের ভাঙন, তীব্র জীবনযুদ্ধ, সন্তানদের ক্যারিয়ার এবং বিদেশনির্ভরতা প্রবীণদের জীবনকে অনেকটাই নিরাপত্তাহীন করে তুলেছে। সে কারণেই অনেক সচ্ছল পরিবারের প্রবীণদেরও সংসারের পরিবর্তে বৃদ্ধাশ্রমে ঠাঁই নিতে হচ্ছে।
বিশ্বজুড়ে প্রবীণদের বয়স্ক জনসংখ্যা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের তথ্যমতে, বাংলাদেশে বর্তমানে এক কোটি ৩০ লাখের মতো প্রবীণ রয়েছেন। জাতিসংঘের এক হিসাব অনুযায়ী ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের ২০ শতাংশ মানুষের বয়স হবে ষাটোর্ধ্ব।
দুঃখজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশে এত কিছু নিয়ে গবেষণা হয় কিন্তু প্রবীণ জনগোষ্ঠীর আর্থসামাজিক অবস্থান নিয়ে তথ্য-উপাত্তভিত্তিক গবেষণার কোনো উদ্যোগ নেই।
তাদের মধ্যে শতকরা ৮৮ প্রবীণের কোনো না কোনো সন্তান পরিবারের বাইরে দেশে বা প্রবাসে অবস্থান করে। শতকরা ২০ জন প্রবীণ পরিবার-পরিজনহীন একাকী অথবা কেবল বৃদ্ধ স্বামী-স্ত্রী মিলে বসবাস করেন। শতকরা ৫৯ ভাগ প্রবীণ নারী বিধবা এবং ছেলে সন্তানের মা। তবে তারা ছেলে সন্তানের সঙ্গে থাকেন না বা থাকতে চাইলেও পারেন না। এ ছাড়া দেশের মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তে অসংখ্য প্রবীণ আছেন, যাদের জীবনের শেষ সময়টুকু অসম্ভব প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে অতিক্রান্ত হয়। অনেক প্রবীণ নর-নারী আছেন, নিজের সন্তানরাও যাদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। এদের অনেকে অন্যের বাড়িতে আশ্রিত হয়ে নতুবা চেনাজানা পরিবেশ ছেড়ে শহরের বিশাল জনস্রোতের সঙ্গে মিশে ভিক্ষাবৃত্তি বা শ্রম বিক্রি করে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। সরকারিভাবে এসব প্রবীণের কথা মাথায় রেখেই বয়স্কভাতা, বিধবাভাতা চালু করা হলেও ভোক্তার তুলনায় বরাদ্দ একেবারেই অপ্রতুল। তাছাড়া দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির কারণে প্রকৃত ভোক্তাদের অনেকেই এই উদ্যোগের সুফল পাচ্ছে না। তাই আজ প্রবীণদের নিয়ে নতুন করে ভাবার সময় এসেছে। পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রের উদ্যোগে প্রবীণবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি এখন সময়ের দাবি। প্রবীণদের অবজ্ঞা না করে, তাদের প্রজ্ঞা, অভিজ্ঞতা আর নবীনদের উদ্যম নিয়েই আমাদের সামনে এগিয়ে যেতে হবে। আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবসে সারা বিশ্বের প্রবীণদের জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।

ফারহানা রেজা : মুক্তিযুদ্ধ গবেষক farhanankf@gmail.com
 

No comments

Powered by Blogger.