কালের আয়নায়-সভ্য যুগেও কি এই অসভ্য দণ্ডাদেশের কথা বিশ্বাস করতে হবে? by আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী

লজেরিয়া, মিসর থেকে লিবিয়া পর্যন্ত গণঅভ্যুত্থান শুরু হতেই কিং আবদুল্লাহ সংস্কারের নামে কোটি কোটি টাকা ওয়েলফেয়ার ব্যবস্থায় বরাদ্দ করে নিজ দেশে এই অভ্যুত্থান ঠেকান এবং তার শাসন ব্যবস্থায় নানা রিফর্মের প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করেন। চলতি সপ্তাহেই তিনি ঘোষণা করেন, সৌদি আরবের নারীরা ভোটাধিকার, নির্বাচনে অংশ নেওয়া এবং পার্লামেন্টে বসার অধিকার পাবে
একুশ শতকের এই উন্নত সভ্যতা ও মানবাধিকারের যুগে, কোনো সভ্য দেশে, বিশেষ করে পবিত্র ইসলাম ধর্ম ও সভ্যতার পীঠস্থান বলে পরিচিত সৌদি আরবে এক ধরনের বর্বর দণ্ডদান প্রথা বিচার ব্যবস্থা এখনও থাকতে পারে, তা এক অকল্পনীয় ব্যাপার। সায়মা জাস্তানিয়াহ নামের এক আরব মহিলাকে মোটরগাড়ি চালনার অভিযোগে সৌদি আদালত ১০ ঘা বেত্রাঘাতের দণ্ডাদেশ দিয়েছেন। ইসলামের মহানবী (দ.) যেখানে দীর্ঘ দেড় হাজার বছর আগে নারীদের ঘোড়ায় চড়ার অনুমোদন দিয়েছেন, এমনকি তার পত্নী বিবি আয়েশা তার সঙ্গে ঘোড়ায় চড়ে সফরে গেছেন, এমনকি যুদ্ধ করেছেন, দেড় হাজার বছর পর সেই মহানবীর দেশেই গাড়ি চালানোর জন্য নারীদের দণ্ডদানের ব্যবস্থা শুধু বিস্ময়কর নয়, আপত্তিকরও। গাড়ি চালনাতে নারীদের বেআব্রু হতে হয় না। ঘোড়ায় চড়তে গেলে বেআব্রু হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
সায়মা জাস্তানিয়াহকে বেত্রাঘাতের দণ্ডাদেশটির খবর আরব নাগরিক অধিকার রক্ষা গ্রুপের কল্যাণে বিশ্বময় জানাজানি হয়ে গেছে। ফলে আরও জানা গেছে, গত কয়েক মাসে আরও ২০ জন নারীকে একই কার ড্রাইভিংয়ের 'অপরাধে' গ্রেফতার করা হয়েছে। এর প্রতিবাদে এক-দু'জন করে সৌদি নারী জেদ্দা, রিয়াদসহ বিভিন্ন শহরে গ্রেফতার বরণের ঝুঁকি নিয়ে গাড়ি ড্রাইভিং শুরু করেছেন। এটা মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশে 'আরব স্প্রিংয়ের' যুগ না হলে সম্ভবত এই গ্রেফতারকৃত নারীদের দণ্ডাদেশ এতদিনে বহির্বিশ্বের অগোচরে কার্যকর হয়ে যেত।
কিন্তু সৌদি রাজারা এবং তাদের মধ্যযুগের চেয়েও গোঁড়া ও পশ্চাৎপদ এস্টাবলিশমেন্ট এই দণ্ডাদেশ দ্রুত কার্যকর করার ব্যাপারে সাহসী হয়নি। বরং সায়মা জাস্তানিয়াহের দণ্ডাদেশের খবরটি বিশ্বময় প্রচারিত এবং সর্বত্র নিন্দার ঝড় উঠতেই তাড়াতাড়ি ঘোষণা করা হয়েছে যে, ৮৭ বছর বয়সের বৃদ্ধ বাদশা আবদুল্লাহ এই দণ্ডাদেশ রদ করার জন্য হস্তক্ষেপ করতে পারেন। এই শাস্তির ব্যবস্থা ইসলামী টেরোরিজমের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ, এই অভিযোগ বহির্বিশ্বে উঠতেই তড়িঘড়ি ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে যে, এটা ইসলামী শরিয়ার বিধান নয়; এটা সৌদি আরবের বহু প্রাচীন গোত্রগত ব্যবস্থা (ঃৎরনধষ ৎঁষবং)। কিন্তু এই একুশ শতকে একটি দেশ যদি মধ্যযুগীয় অসভ্য ট্রাইবাল রুলস দ্বারা চালিত হয়, সেই দেশটিকে কি সভ্য দেশ বলে স্বীকার করা যায়?
যদি মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোতে রুলিং ক্লাসের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড আরব স্প্রিংয়ের অভ্যুদয় না ঘটত এবং আতঙ্কিত সৌদি রাজাদের দ্রুত তাদের গোঁড়ামিপূর্ণ শাসন ব্যবস্থা সংস্কারের প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করে পিছু হটতে না হতো, তাহলে নারীদের গাড়ি ড্রাইভ করাকেও ইসলামবিরোধী ও শরিয়তবিরোধী বলে যে এখনও চালিয়ে দেওয়া হতো তাতে সন্দেহ নেই। পেট্রো ডলারের কল্যাণে দেশটিতে আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা, শিক্ষা ব্যবস্থা, চিকিৎসা ব্যবস্থা ইত্যাদির অনেক উন্নতি ঘটেছে। কিন্তু ইসলাম-পূর্ব যুগ ও বেদুইন আমলের অনেক কুসংস্কার এবং নিয়মরীতি তারা এখনও ত্যাগ করতে পারেনি। যেমন চুরি, প্রতারণার মতো ছোটখাটো অপরাধেও বেত মারা, হাত কাটা, রগ কাটা ইত্যাদি বর্বর দণ্ডদান প্রথা তারা এখনও সম্পূর্ণ উচ্ছেদ করেনি। ধর্মের নামে বহাল রেখেছে।
বাংলাদেশে মূলত সৌদি অর্থে ও পৃষ্ঠপোষকতায় প্রতিষ্ঠিত এবং পরিচালিত জামায়াতিদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে এই হাত কাটা, রগ কাটা, বেত মারার নজিরগুলো বিভীষিকার মতো এ দেশের মানুষের স্মরণ থেকে মুছে যায়নি। অতীতের এবং বর্তমানের এই জামায়াতি সন্ত্রাসকেও ইসলামী বিধানের খোলস পরানোর চেষ্টা হয়েছে এবং প্রচেষ্টাটি এখনও চলছে।
হাউস অব সৌদ বা সৌদি রাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের দ্বারা। প্রথমে সৌদি রাজারা ব্রিটিশদের অনুগত ও আজ্ঞাবাহী ছিলেন। পরে আমেরিকার ক্লায়েন্ট ডায়নেস্টিতে পরিণত হয়। এই রাজাদের মধ্যে সত্তরের দশকের কিং ফয়সল ছিলেন কিছুটা উদার ও সাহসী। তিনি সৌদি আরবে প্রথম টেলিভিশন চালু করার অনুমতি দেন (তখনও গোঁড়া সৌদি এস্টাবলিশমেন্টের বড় অংশ তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল)। তিনি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরোধী ছিলেন না, কিন্তু দারুণ ইসরায়েলবিরোধী ছিলেন।
কিং ফয়সল মার্কিন আপত্তি সত্ত্বেও জোটনিরপেক্ষ রাষ্ট্র জোটে (ন্যামের) যোগ দিয়েছিলেন এবং ঘোষণা করেছিলেন, তিনি তার জীবিতাবস্থাতেই পবিত্র আল আকসা মসজিদ ইসরায়েলের দখলমুক্ত করবেন এবং নিজে দখলমুক্ত আল আকসা মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়বেন। এই ঘোষণা দেওয়ার অল্প দিনের মধ্যেই তাকে তার ভ্রাতুষ্পুত্রের দ্বারা নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। পশ্চিমা মিডিয়া প্রচার করেছিল, কিং ফয়সল শরিয়তের বিধান অমান্য করে দেশে টেলিভিশন চালু করেছেন। এ জন্য ত্রুক্রদ্ধ হয়ে তার ধর্মান্ধ ভ্রাতুষ্পুত্র তাকে হত্যা করেছে। পরে এই খবরটা ফাঁস হতে দেরি হয়নি যে, এই হত্যাকাণ্ড ছিল জায়োলিস্ট কন্স্পিরেসি এবং ক্যালিফোর্নিয়ায় বসবাসরত সৌদি পরিবারেরই এক মদ ও মেয়েমানুষ-পাগল শাহজাদাকে দিয়ে এই হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে।
কিং ফয়সলের মতো বর্তমান বাদশা আবদুল্লাহও অনেকটা উদার ও আধুনিকমনা মনার্ক। সৌদি আরবে আমেরিকানদের আধিপত্য সম্পর্কে তার মনেও রিজারভেশন আছে। ওয়াশিংটন এ কথা জেনেই তার পূর্ববর্তী কিং ফুয়াদের মৃত্যুর পর তাকে রাজা হতে দিতে বাধা দিয়েছিল। এই বাধা অতিক্রম করার জন্য আবদুল্লাহ ওয়াশিংটনের সঙ্গে কতটা আপস করেছেন, তার সব বিবরণ এখনও জানা যায়নি। তিনি তার গোঁড়া এস্টাবলিশমেন্ট ও ক্লারিকসদের আপত্তি অগ্রাহ্য করে সৌদি আরবে প্রথম নারী-পুরুষ সহশিক্ষা (ঈড়-বফ-ঁহরাবৎংরঃু) খোলার সিদ্ধান্ত নেন।
এ বছর আলজেরিয়া, মিসর থেকে লিবিয়া পর্যন্ত গণঅভ্যুত্থান শুরু হতেই কিং আবদুল্লাহ সংস্কারের নামে কোটি কোটি টাকা ওয়েলফেয়ার ব্যবস্থায় বরাদ্দ করে (সমালোচকদের মতে জনগণকে ঘুষ দিয়ে) নিজ দেশে এই অভ্যুত্থান ঠেকান এবং তার শাসন ব্যবস্থায় নানা রিফর্মের প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করেন। চলতি সপ্তাহেই তিনি ঘোষণা করেন, সৌদি আরবের নারীরা ভোটাধিকার, নির্বাচনে অংশ নেওয়া এবং পার্লামেন্টে বসার অধিকার পাবে।
এই ঘোষণা দেওয়ার পরও গাড়ি ড্রাইভিংকে অপরাধ গণ্য করে জেদ্দার একটি আদালত একজন নারীকে বেত্রাঘাতের আদেশ দেওয়ার পর সৌদি রাজনীতির অনেক পর্যবেক্ষকই মনে করেন, সৌদি বাদশা যতই শক্তিমান হোন, তিনি অর্ধশতকেরও প্রাচীন ও রক্ষণশীল ক্লারিকস, এস্টাবলিশমেন্ট ও জুডিসিয়ারির সঙ্গে পেরে উঠছেন না। গত ২৯ সেপ্টেম্বর সারাদেশে যে ভোট হয়েছে, তাতে সৌদি নারীরা অংশগ্রহণ করতে পারেনি। বাদশার ঘোষণাতেও বলা হয়েছে, ২০১৫ সালের কাউন্সিল নির্বাচনে সৌদি নারীরা অংশগ্রহণ করতে পারবে, তার আগে নয়। বাদশা এখানে রক্ষণশীলদের সঙ্গে একটা আপসরফা করেছেন। অর্থাৎ প্রতিশ্রুতির রজ্জুতে নারীদের ভোটাধিকার ঝুলিয়ে রেখেছেন।
কিন্তু সৌদি এস্টাবলিশমেন্ট তাতেও খুশি নয়। তারা আভাসে-ইঙ্গিতে জানাচ্ছেন, বাদশা নারীদের ভোটাধিকার দিতে চাইলেও তারা এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হতে দেবেন না। সবচেয়ে মজার ব্যাপার এই যে, মধ্যপ্রাচ্যের কোনো দেশে যদি মানবাধিকার, নাগরিক অধিকার সবচেয়ে বেশি অস্বীকৃত এবং মধ্যযুগীয় নিপীড়নমূলক সমাজ ব্যবস্থা বহাল রাখা হয়ে থাকে, সে দেশটি হচ্ছে সৌদি আরব। কিন্তু এ দেশে 'আরব স্প্রিং' ঘটতে যাওয়া সত্ত্বেও আমেরিকাসহ পশ্চিমা দেশগুলো তাতে কোনো উৎসাহ দেখায়নি। তাদের সব উৎসাহ আলজেরিয়া, মিসর, লিবিয়া প্রভৃতি দেশগুলোতে স্বৈরাচারী শাসক বদলের কাজে। লিবিয়ায় তো এ ব্যাপারে তারা ঘোষিত যুদ্ধের চেয়েও ভয়াবহ অভিযান ও বোমা হামলা চালিয়েছে।
অথচ এই দেশগুলোতে একনায়কত্ব থাকলেও সমাজ ব্যবস্থা উন্নত, আধুনিক এবং সেক্যুলার, কর্মজীবনে নারীর অংশীদারিত্ব অস্বীকৃত নয়। সৌদি আরবের মতো নারী নির্যাতিত নয়, নাগরিক অধিকার লঙ্ঘিত নয়। তা সত্ত্বেও আমেরিকা ও তার পশ্চিমা মিত্রবর্গ সর্বাধুনিক যুদ্ধাস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে এই দেশগুলোর শাসক উচ্ছেদের জন্য। সচেতন বিশ্ববাসীর বুঝতে অসুবিধা হয়নি, এসব দেশের অধিকাংশ শাসক (বিশেষ করে গাদ্দাফি) স্বৈরাচারী হলেও ছিলেন কমবেশি পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ, বিশেষ করে তাদের পোষ্য ইসরায়েলবিরোধী। সুতরাং সুযোগ পেয়ে তাদের পতন ঘটানো হয়েছে। বলা হচ্ছে, এটা দেশগুলোর জনগণকে 'লিবারেট' করা। যেমন তারা ইরাকের জনগণকে 'লিবারেট' করেছেন। এক্ষেত্রে সৌদি আরব তাদের টার্গেট নয়। কারণ, সৌদি বাদশাদের কোনো সাম্রাজ্যবাদবিরোধী, পশ্চিমা স্বার্থবিরোধী ভূমিকা নেই। বরং তারা পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থের তল্পিবাহক। ফলে পশ্চিমা মদদপুষ্ট 'আরব স্প্রিং' থেকে দেশটি আপাতত বেঁচে গেল।
কিন্তু এ বাঁচা তো বাঁচা নয়। সৌদি আরবে গত দু'তিন দশকে যা ঘটেছে, তা হলো একটি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণী যেভাবেই হোক গড়ে উঠেছে। নারীদেরও একটা মধ্যবিত্ত অংশ, এমনকি রয়াল ফ্যামিলিরও বহু নারী শিক্ষিত ও অধিকারসচেতন। অন্যদিকে এস্টাবলিশমেন্ট, জুডিসিয়ারি ও ক্লারিকসতন্ত্র গোঁড়ামি ত্যাগে অসম্মত। মাঝখানে কিছুটা উদারমনা বর্তমান মনার্ক। সৌদি আরবের রুলিং ক্লাসেও তাই অপ্রকাশ্যে একটা সংঘাতের ধারা শুরু হয়েছে এবং দিন দিন শক্তিশালী হচ্ছে। সে সঙ্গে গণসচেতনতা বাড়ছে। সুতরাং এটা এখন কেবল সময়ের অপেক্ষা। এই মধ্যযুগীয় রাজতন্ত্র, তার গোঁড়া, রক্ষণশীল এস্টাবলিশমেন্ট, বহু প্রাচীন অন্ধকার অতীতের সমাজ ব্যবস্থা কবে সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ে এবং আরব স্প্রিংয়ের সবচেয়ে বড় বিস্ফোরণটি ঘটে তা এখন সম্ভবত কেবল দেখার রইল।
লন্ডন, শুক্রবার, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১১

No comments

Powered by Blogger.