'আর্সেনালের মেসি' ফন পার্সি

ফুটবল এখন মেসি আর রোনালদোময়। আর্জেন্টাইন খুদে জাদুকরের খেলায় মোহিত পুরো বিশ্ব। ২০০৯, ২০১০ সালের পর ২০১১ সালের ফিফা বর্ষসেরা পুরস্কারটাও হয়তো পেতে যাচ্ছেন তিনিই। অথচ ২০১১ সালে লিগে এখনো মেসির চেয়ে বেশি গোল রবিন ফন পার্সির। এ বছর এ পর্যন্ত আর্সেনালের এ ফরোয়ার্ড ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে ২৯ ম্যাচে করেছেন ৩১ গোল। আর গতকাল পর্যন্ত স্প্যানিশ লা লিগায় ৩১ ম্যাচে মেসির গোল ২৯টি।


শুধু গোল দিয়েই বিচার করা যায় না কাউকে। বিবেচনা করতে হয় মাঠের পারফরম্যান্স দিয়েও। নেদারল্যান্ডসের তারকা ফন পার্সি হয়তো সেখানেও পেছনে থাকবেন না মেসির চেয়ে, কেননা বার্সেলোনায় মেসির পাশেও কিন্তু অনেক তারকা। ফন পার্সির পাশে সে রকম কে আছেন! ইনিয়েস্তা, জাভি, ফ্যাব্রেগাস, ভিয়ারা একেকজন ফুটবল আকাশের উজ্জ্বল নক্ষত্র। সেখানে আর্সেনালে পার্সির পাশে আছেন কারা? বেশির ভাগই অচেনা ও অনভিজ্ঞ। গানারদের তাই বলতে গেলে একাই টানছেন পার্সি। মনে আছে নিশ্চয়ই মৌসুমের শুরুতে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের কাছে ২-৮ গোলে বিধ্বস্ত হয়েছিল আর্সেনাল। প্রথম ৫ ম্যাচ শেষে পয়েন্ট তালিকায় তারা নেমে গিয়েছিল ১৮ নম্বরে! সেখান থেকে ১২ ম্যাচ পর ২২ পয়েন্ট নিয়ে আর্সেনাল উঠে এসেছে সপ্তম স্থানে। কৃতিত্বটা ২৮ বছর বয়সী এ ডাচেরই। ২০১১-১২ মৌসুমের লিগে আর্সেনালের ২৫ গোলের ১৩টিই যে তাঁর! সেই সঙ্গে সতীর্থদের দিয়ে করিয়েছেনও ৬ গোল।
ইংলিশ লিগের মতো পার্সি চ্যাম্পিয়নস লিগেও সফল। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, চেলসি, ম্যানচেস্টার সিটি_ইংল্যান্ডের এ তিন দলই বাদ পড়ার শঙ্কায় গ্রুপ পর্ব থেকে। একমাত্র ইংলিশ দল হিসেবে কেবল পার্সির আর্সেনালই নিশ্চিত করেছে পরের রাউন্ড, তাও এক ম্যাচ হাতে রেখে। এতে পার্সির অবদান ৩ গোল। গত সপ্তাহে বরুসিয়া ডর্টমুন্ডের বিপক্ষে ২-১ গোলে জেতা ম্যাচটিতে দুবারই লক্ষ্যভেদ করেছেন তিনি। এরপরই নিশ্চিত হয় আর্সেনালের পরের রাউন্ডে খেলাটা। আর তারপরই পার্সিতে মুগ্ধ কোচ আর্সেন ওয়েঙ্গার রায় দিয়ে দেন, 'মেসি, রোনালদোর মতোই ভালো ফুটবলার পার্সি। বার্সেলোনা, রিয়ালে তারকার ছড়াছড়ি কিন্তু আমাদের আর্সেনাল এগিয়ে চলেছে ওর কাঁধে ভর দিয়ে। আশা করছি পুরো মৌসুমেই ফর্মটা ধরে রাখবে ও।'
এ বছর সব মিলিয়ে ৪১ ম্যাচে করেছেন ৩৮ গোল আর কেবল প্রিমিয়ার লিগে ২৯ ম্যাচে লক্ষ্যভেদ করেছেন ৩১ বার। এর মধ্যে লিগের যে ২৪টি ম্যাচে পার্সি প্রথম গোল করেছিলেন, সেই ম্যাচগুলোতে হারের তেতো স্বাদ পেতে হয়নি আর্সেনালকে। এর আগে ইংলিশ লিগে এক বছরে ৩০ বা এর বেশি গোল পেয়েছিলেন মাত্র ৪ জন। সর্বোচ্চ ৩৪ গোল করেছিলেন ১৯৯৪ সালে নিউক্যাসলের হয়ে অ্যান্ডি কোল ও ১৯৯৫ সালে ব্ল্যাকবার্নের হয়ে অ্যালান শিয়েরার। বছর শেষ হতে এখনো বাকি আছে বলে ৩৪ গোলের রেকর্ড ভাঙার সুযোগ ভালোভাবেই থাকছে পার্সির সামনে। সর্বশেষ ২০০৪ সালে ৩০ গোল করেছিলেন থিয়েরি অঁরি। আর্সেনালে অঁরির যোগ্য উত্তরসূরিই ধরা হচ্ছে পার্সিকে। দুজনের পথচলাটাও প্রায় একই। জুভেন্টাস থেকে অঁরি আর্সেনালে এসেছিলেন উইঙ্গার হিসেবে। পার্সিও ফেইনুর্ড থেকে ২০০৪ সালে লন্ডনের ক্লাবটিতে নাম লিখিয়েছিলেন উইঙ্গার হয়েই। অঁরি-পার্সি তাই শুরুতে ভয়ংকর কোনো ফরোয়ার্ড ছিলেন না। কিন্তু দুজনকেই ফরোয়ার্ড হিসেবে খেলানোর সিদ্ধান্ত নেন আর্সেনাল ম্যানেজার ওয়েঙ্গার। তাঁর আস্থার প্রতিদান দিয়েছেন দুজনই। অঁরি তো হয়ে গেছেন আর্সেনালের সর্বকালের সর্বোচ্চ গোলদাতাই। পার্সিও ১৬৮ ম্যাচে করে ফেলেছেন ৭৯ গোল।
শুরুতে অবশ্য ডেনিস বার্গক্যাম্প ও অঁরির পেছনে থেকেই খেলতেন পার্সি। অঁরি ক্লাব ছাড়ার পরও খেলেছেন দ্বিতীয় স্ট্রাইকার হিসেবে। তবে এ মৌসুমে সেস্ক ফ্যাব্রেগাস বার্সেলোনায় যোগ দেওয়ার পর ১০ নম্বর জার্সিটা পরে খেলছেন মূল ফরোয়ার্ডের ভূমিকাপ্রাপ্তির স্বীকৃতি হিসেবে। পেয়েছেন দলের নেতৃত্বও। তাতে কতটা সফল তা বুঝিয়ে দিয়েছেন এ মৌসুমে ইংলিশ লিগের এ পর্যন্ত শীর্ষ গোলদাতা হয়ে। সেই সঙ্গে ফ্যাব্রেগাস, সামির নাসরিরা একে একে ক্লাব ছাড়লেও আর্সেনালে থেকে যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে জিতে নিয়েছেন সমর্থকদের মনও। এই দুই তারকার পর যখন ট্রান্সফার বাজারে জোর গুজব_'ক্লাব ছাড়ছেন পার্সি'_তখনই এ ডাচ তারকা জানান, 'আর্সেনাল আছে আমার হৃদয়জুড়ে। আমার আজ যেটুকু অর্জন তার সবটুকু পেয়েছি এখানে খেলেই। সমর্থকদের আশ্বস্ত করছি, ক্লাব ছেড়ে কোথাও যাচ্ছি না আমি।'
ক্লাবের মতো পার্সি সফল নেদারল্যান্ডস জাতীয় দলেও। অনেকে তাঁর মাঝে খুঁজে পান মার্কো ফন বাস্তেনের ছায়া। পার্সিও বেড়ে উঠেছেন বাস্তেনকে আদর্শ করে। এরই মধ্যে আবার গোল সংখ্যায় ছাড়িয়ে গেছেন বাস্কেনকেও! ১৯৮৩ থেকে ১৯৯২ পর্যন্ত ঝড় তোলা বাস্তেন ৫৮ ম্যাচে করেছেন ২৪ গোল। সেখানে ৬০ ম্যাচে পার্সির গোল ২৫টি, যা আবার ডাচ ফুটবল ইতিহাসে সর্বকালের সেরা দশে জায়গা করে দিয়েছে এ তরুণকে। সর্বোচ্চ ৪০ গোলের রেকর্ড প্যাটট্রিক ক্লাইভার্টের আর ৩৭ গোল নিয়ে দ্বিতীয় স্থানে আছেন ডেনিস বার্গক্যাম্প। উইঙ্গার হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করা পার্সির বয়স ২৮ বছর বলে ক্লাইভার্টের রেকর্ডে পাখির চোখ করতেই পারেন তিনি।
জাতীয় দলের হয়ে খেলেছেন ২০০৬ ও ২০১০ বিশ্বকাপ। ২০০৬ বিশ্বকাপে দ্বিতীয় রাউন্ডে বাদ পড়া নেদারল্যান্ডসের হয়ে খেলেছিলেন চার ম্যাচই। গ্রুপ পর্বে আইভরি কোস্টের বিপক্ষে ফ্রি-কিক থেকে গোলও করেছিলেন একটি। ২০১০ বিশ্বকাপে নেদারল্যান্ডসের ফাইনালে ওঠার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাও রেখেছিলেন পার্সি। একটা মাত্র গোল করলেও পুরো টুর্নামেন্টে আলো ছড়িয়েছেন যথেষ্ট। উজ্জ্বল ছিলেন এবারের ইউরো বাছাই পর্বেও। পোল্যান্ড-ইউক্রেন যাত্রার পথে বাছাই পর্বে সর্বোচ্চ ৩৭ গোল নেদারল্যান্ডসেরই, যার সাতটি করেছেন পার্সি। এর মধ্যে অন্যতম স্যান ম্যারিনোর বিপক্ষে ১১-০ গোলের জয়ে চারবার লক্ষ্যভেদ করা। ফর্মটা ধরে রাখতে পারলে আগামী মৌসুমের ফিফা বর্ষসেরার লড়াইয়ে মেসি, রোনালদোর সঙ্গে হয়তো জোর প্রতিদ্বন্দ্বিতাই গড়ে তুলবেন এ ডাচ তরুণ।

No comments

Powered by Blogger.