শ্রদ্ধাঞ্জলি-চোখের জলে বিদায় জানাই by ইমদাদুল হক মিলন

শীদ করীম চলে গেলেন। বহু দিন শয্যাশায়ী ছিলেন। হাঁটাচলা করতে পারতেন না, লেখালেখি করতে পারতেন না। বছর পাঁচেক আগে একদিন তাঁকে তাঁর ধানমণ্ডির ফ্ল্যাটে দেখতে গিয়েছিলাম। রাজপুরুষের মতো মানুষটি কী রকম ম্লান, বিষণ্ন হয়ে গেছেন। অনেকক্ষণ পাশে বসে রইলাম, কত কথা হলো। তারপর আর দেখা হয়নি। এই জীবনে আর দেখা হবে না।
এই প্রজন্মের পাঠক রশীদ করীমকে কতটা চেনেন জানি না। তবে তিনি আমার একজন প্রিয় লেখক। ১৯৭৩ সালে লেখালেখির শুরুর সময় থেকেই রশীদ করীমের লেখার সঙ্গে পরিচয়। গেণ্ডারিয়ার সীমান্ত গ্রন্থাগারে তাঁর দুটো উপন্যাস ছিল, 'প্রসন্ন পাষাণ' আর 'উত্তম পুরুষ'। পড়ে আমি একটু এলোমেলো হয়ে গিয়েছিলাম। একেবারেই অন্য জাতের লেখা। ভাষা বর্ণনাভঙ্গি সংলাপ জীবনবোধ এবং কাহিনীর বুনোট অন্য কারো লেখার সঙ্গে মেলে না। সরল শিক্ষিত এবং বনেদিআনায় ভর্তি লেখা। তর তর করে পড়ে ফেলা যায়। পড়তে পড়তে একটা ঘোর তৈরি হয়।
রশীদ করীমের লেখার ঘোরে সেই সময় থেকেই আমি আচ্ছন্ন।
তারপর হাতে এল তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস 'আমার যত গ্লানি'। মন্ত্রমুগ্ধের মতো পড়লাম। আমার তখনকার লেখক বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় আলোচনায় প্রায়ই সেই উপন্যাসের কথা বলি। আড্ডা উত্তপ্ত হয় রশীদ করীমের উপন্যাস নিয়ে।
শুরু থেকেই রশীদ করীম লেখেন কম। বেছে বেছে, হিসাব করে করে। উপন্যাসই লিখেছেন। গল্প বলতে গেলে লেখেনইনি।
আমার যত দূর মনে পড়ে, 'প্রথম প্রেম' নামে তাঁর একটিমাত্র গল্পের বই আছে। মুক্তধারা থেকে বেরিয়েছিল। সেই বই বহুকাল আর চোখে পড়ে না। রশীদ করীমের 'উপন্যাস সমগ্র' বেরিয়েছে, 'রচনা সমগ্র' বেরিয়েছে কি না জানি না। বেরোনো উচিত। কারণ তিনি বেশ কিছু মূল্যবান প্রবন্ধও লিখেছেন। আজকের পাঠকের কাছে সেই সব রচনা উপস্থিত হলে পাঠক উপকৃত হবেন।
মনে আছে, এগারো বছর আগে রশীদ করীমের পঁচাত্তরতম জন্মদিনের উৎসব হয়েছিল জাদুঘরের সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে। সেই অনুষ্ঠানে যাওয়ার সময় তাঁর জন্য ফুল কিনতে কিনতে আমার মনে পড়েছিল রশীদ করীমের একটি বিখ্যাত উপন্যাসের নাম 'প্রেম একটি লাল গোলাপ'। কী সুন্দর লেখা। সম্ভবত বিচিত্রার ঈদসংখ্যায় ছাপা হয়েছিল। ঈদসংখ্যায় পড়ার পর বই হয়ে বেরোবার পরও পড়েছি দু-তিনবার। তারপর আরো কত লেখা। 'একজন সাধারণ লোকের কাহিনী', 'শামা', 'মায়ের কাছে যাবো'। এক লেখার সঙ্গে আরেক লেখার দূরত্ব অনেক। তাৎক্ষণিক চিন্তা-চেতনায় উদ্দীপ্ত হয়ে কখনো লেখেননি রশীদ করীম। লিখেছেন বহু চিন্তা-ভাবনা করে, আস্তে-ধীরে। লেখায় কোনো তাড়াহুড়ো নেই, পাঠকের মুখ চেয়ে কলম ধরেননি, লিখেছেন নিজের মনমতো। লিখে তৃপ্ত না হলে সেই লেখা রশীদ করীম কখনো ছাপতে পাঠিয়েছেন এমন কথা তাঁর শত্রুরাও বলবে না।
আধুনিক বাংলা কবিতার তিনি একজন অনুরাগী পাঠক ছিলেন। সুধীন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর প্রিয় কবি, আর প্রিয় কবি বন্ধু শামসুর রাহমান। রবীন্দ্রনাথ, আবু সয়ীদ আইয়ূব তাঁর প্রিয় পাঠ্য। এই মনীষী লেখকদের স্তরেই রশীদ করীম থাকতে চেয়েছেন। বাজার মাত করা, জনপ্রিয় লেখক তিনি কখনো হতে চাননি। যদিও চাইলে তিনি তা পারতেন, কারণ তাঁর হাতের কলমটি ছিল খুবই শক্তিশালী। শক্তিশালী কলম যেকোনো দিকেই ঘোরানো সম্ভব।
শামসুর রাহমান বলতেন, 'রশীদ করীম আমার সময়কার শ্রেষ্ঠ গদ্যশিল্পী।'
রশীদ করীমের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল ১৯৭৮ সালে। ইত্তেফাক ভবন থেকে 'রোববার' নামের একটা কাগজ বেরোবার তোড়জোড় চলছে। সেই কাগজে পার্টটাইমার হিসেবে যোগ দিয়েছেন রফিক আজাদ। আমি তখন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে অনার্স পড়ছি। রফিক আজাদ আমাকে খুবই স্নেহ করেন। আমিও কাজ পেলাম জুনিয়র রিপোর্টার হিসেবে।
রোববারে তখন আড্ডা দিতে আসতেন অনেকেই। রশীদ করীমের সঙ্গে রোববার অফিসেই পরিচয়। প্রথম বছরের ঈদসংখ্যায় উপন্যাস লিখেছিলেন। তাঁর সেই বিখ্যাত উপন্যাস 'একজন সাধারণ লোকের কাহিনী'। তিনি একটু একটু করে লিখছেন, আমি গিয়ে তাঁর অফিস থেকে লেখা নিয়ে আসছি। অফিস ছিল ইত্তেফাকের কাছেই। একটি বিখ্যাত তেল কম্পানির অতিবড় কর্মকর্তা তিনি। অফিসে গেলে পূর্বাণী থেকে প্যাটিস আনাতেন, সুন্দর বড় কাপে মূল্যবান চা খাওয়াতেন। তাঁর রুমে রিনরিন শব্দে চলছে এয়ারকুলার, স্যুট-টাই দামি জুতো পরে তিনি বসে আছেন তাঁর দামি চেয়ারে। বিশাল কাচের টেবিলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ফাইলপত্র। মধ্য পঞ্চাশের রশীদ করীম তখনো টকটকে ফর্সা, সুন্দর, বিদেশি সিনেমার নায়কদের মতো। মাথার টাক তাঁর সৌন্দর্য একটুও ম্লান করতে পারেনি, বরং আশ্চর্য এক ব্যক্তিত্ব যোগ করেছে।
কী যেন কী কারণে তিনি আমাকে পছন্দ করতে শুরু করেছিলেন। আমি লেখা আনতে গেছি, তিনি কাজ ফেলে চা-প্যাটিস খাওয়াচ্ছেন আমাকে, গল্প করছেন। একদিন ফোনে আমাকে ডেকে বললেন, 'দুপুরের পর আমার অফিসে এসো। তোমাকে আজ আমার বাড়িতে নিয়ে যাব।' গেছি। ছুটির একটু আগেই অফিস থেকে বেরোলেন তিনি। অফিসের সুন্দর গাড়িতে তাঁর পাশে বসালেন। প্রথমে গেলেন হোটেল পূর্বাণীর পেস্ট্রিশপে। সেখান থেকে প্রচুর দামি দামি খাবার কিনলেন। তখন তিনি কলাবাগানে থাকেন। দোতলা কিংবা তিন তলায় বনেদি ধরনের ফ্ল্যাট। চুপচাপ, নির্জন রুচিস্নিগ্ধ ফ্ল্যাট। মনে আছে, রশীদ করীমের ফ্ল্যাটে সেদিন প্রথম কনিয়েক খেয়েছিলাম। দুটো গ্লাসে কনিয়েক ঢেলেছেন রশীদ করীম, আমি একটা নিয়ে টক করে খেয়ে ফেললাম। তিনি হাসলেন। বললেন, কনিয়েক এভাবে খায় না। এ জিনিস খেতে হয় একটু একটু করে।
তারপর দিনে দিনে দিন কেটে গেল। রশীদ করীম চাকরিজীবন থেকে অবসর নিলেন। আগেও কম লিখতেন, অবসর জীবনে গিয়েও তেমন লেখালেখি করলেন না। বছর পনেরো আগে একবার অসুস্থ হলেন, বারডেমে একদিন তাঁকে দেখতে গিয়েছিলাম। কী যে খুশি হয়েছিলেন!
আমার দুর্ভাগ্য, যাঁরা আমাকে খুব বেশি ভালোবাসেন কেন যেন সেই মানুষগুলোর সঙ্গেই আমার যোগাযোগ কমে যায়। রশীদ করীমের সঙ্গেও তাই হয়েছে। অথচ কত আনন্দের দিন তাঁর সঙ্গে একদা কেটেছে। আমার মতো নগণ্য এক যুবককে কত প্রশ্রয় এত বড় একজন লেখক দিয়েছেন। আজ সেই সব মধুর স্মৃতি মনে করে গৌরব বোধ করছি।
মৃত্যু মানুষের অমোঘ নিয়তি। মৃত্যু ঠেকাবার সাধ্য মানুষের নেই। তবে কোনো কোনো মানুষ তাঁর কাজের মধ্য দিয়ে মৃত্যুকে জয় করেন। রশীদ করীম তেমন এক মানুষ। মেধাবী পাঠকের বুক শেলফে থেকে যাবেন তিনি, অন্তরমহলে থেকে যাবেন। চোখের জলে বিদায় জানাবার পরও তিনি থেকে যাবেন পাঠকের চোখের অনেক ভেতরে।
রশীদ করীম, আপনার জন্য অশেষ শ্রদ্ধা।

No comments

Powered by Blogger.