তাহলে কেমন দুদক প্রয়োজন by মশিউল আলম



৩ মে জাতীয় সংসদ ভবনে সরকারি হিসাবসক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভা শেষে ওই কমিটির সভাপতি মহীউদ্দীন খান আলমগীর সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে দুর্নীতি দমন কমিশন প্রসঙ্গে কিছু কথা বলেছেন, যা সংবাদমাধ্যমের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। যেমন, তিনি বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক আমলের মতো ক্ষমতার অপব্যবহারকারী দুদকের প্রয়োজন নেই। তাঁর মতে, বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় দুদক সংবিধান লঙ্ঘন করে গোষ্ঠীস্বার্থে বিশেষ মহলের তল্পিবাহক হিসেবে কাজ করেছে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় যেসব রাজনীতিক, ব্যবসায়ী, ক্ষমতাধর ব্যক্তি ‘দুর্নীতি ও গুরুতর অপরাধ দমনবিষয়ক টাস্কফোর্স’ ও দুর্নীতি দমন কমিশনের দ্বারা নানা রকম হয়রানি, নিগ্রহ, নিপীড়নের শিকার হয়েছিলেন, তাঁদের সাধারণ অভিযোগ কমবেশি এই রকম। এ অভিযোগ সংক্ষুব্ধ মানুষের অভিযোগ। সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির অভিযোগ পক্ষপাতযুক্ত হতে পারে। যাঁরা সে সময় দুর্নীতি/ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগে গ্রেপ্তার ও জিজ্ঞাসাবাদের শিকার হয়েছিলেন, পরবর্তী সময়ে তাঁরা কারামুক্ত/মামলামুক্ত হলেও এ কথা বলা কঠিন যে, তাঁদের সবাই নিষ্কলুশ, কোনো দুর্নীতি বা ক্ষমতার অপব্যবহার তাঁরা করেননি। বিচারপ্রক্রিয়ার দুর্বলতা বা যে কারণেই হোক, দুর্নীতির মামলাগুলো অভিযুক্তদের শাস্তি দিতে সক্ষম হয়নি বলেই জনমনে এমন ধারণা সৃষ্টি হয়নি যে অনিয়ম-দুর্নীতি কিছুমাত্র ঘটেনি। অভিযোগ আদালত পর্যন্ত পৌঁছুতে পারুক বা না পারুক, অভিযোগ আদালতে প্রমাণিত হোক বা না হোক—জনসাধারণের মনে এত দিনে এই ধারণা প্রতিষ্ঠিত যে: কিছু বিরল ব্যতিক্রম বাদে ক্ষমতাবানেরা সাধারণভাবে অনিয়ম-দুর্নীতি করেন, ক্ষমতার অপব্যবহারের মধ্য দিয়ে বিপুল বিত্ত-বৈভবের মালিক হওয়ার প্রবণতা বেশ আছে।
কিন্তু তার মানে এটাও নয় যে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় দুদক বা সেই সাড়া-জাগানো টাস্কফোর্স যা কিছু করেছিল, তার সবই ছিল নৈতিক ভিত্তিসম্পন্ন। টাস্কফোর্স বা দুদক যেসব পদক্ষেপ নিয়েছিল, প্রথম দিকে সেগুলোর প্রতি সাধারণ মানুষ উৎসাহিত বোধ করলেও অচিরেই সংশয় দেখা দিয়েছিল। বিশেষ করে দুদকের সিলেক্টিভ পদ্ধতিতে দুর্নীতির বিচারের উদ্যোগ এমন প্রশ্ন জাগিয়েছিল: কাউকে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে, কাউকে নয়—এটা কেন? দুর্নীতি কি বাছাই করে বিচার করার মতো অপরাধ? তা ছাড়া, যাঁরা ক্ষমতা নিয়েছিলেন, তাঁদের নিজেদের ক্রিয়াকর্মের জবাবদিহির কোনো ব্যবস্থা ছিল না বলে দুর্নীতি দমনের নামে তাঁরা নিজেরাও দুর্নীতিতে লিপ্ত হয়েছেন কি না—এমন জিজ্ঞাসাও জনমনে জেগেছিল। তাঁরা ক্ষমতা থেকে বিদায় নেওয়ার পর অনেক অভিযোগ তাঁদের বিরুদ্ধে শোনা গেছে। এখনো সেসব অভিযোগের প্রতিধ্বনি চলছে। মহীউদ্দীন খান আলমগীরের সেদিনের বক্তব্যে সেই প্রতিধ্বনিই শোনা গেছে।
স্বস্তির বিষয়, সেসব দিন গত হয়েছে। দেশ এখন একটি গণতান্ত্রিক সরকারের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। ক্ষমতাসীনদের কাছে এখন কিছু জবাবদিহি মানুষ দাবি করতে পারে। নির্বাচনে জনগণের রায় নিয়ে যাঁরা পাঁচ বছরের জন্য রাষ্ট্র পরিচলানার দায়িত্ব ও ক্ষমতা পেয়েছেন, তাঁরা যদি মনে করেন, আগামী পাঁচ বছর তাঁরা যা করবেন তার সবকিছুর পেছনেই জনগণ আগাম সমর্থন দিয়ে রেখেছে, তবে সেটা হবে এক বিরাট ভুল। সেই সঙ্গে তাঁদের প্রতি মুহূর্তে বিচার করে দেখা উচিত, তাঁরা যেসব পদক্ষেপ নিচ্ছেন সেগুলো তাঁদের নির্বাচনপূর্ব প্রতিশ্রুতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ কি না। কোনো বিষয়ের পক্ষে জনসমর্থন রয়েছে কি না, তা বোঝার জন্য সংবাদমাধ্যমে প্রতিফলিত বিভিন্ন মতামত গুরুত্বের সঙ্গে আমলে নিতে হয়। দুর্নীতি দমন কমিশন আইন এমনভাবে সংশোধনের প্রস্তাব পেশ করা হয়েছে, যার ফলে এই স্বাধীন সংস্থাটি আপন কর্তব্য পালনের ক্ষেত্রে অনেকাংশে নির্বাহী বিভাগের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বে। এটা কি সরকারের নির্বাচনপূর্ব প্রতিশ্রুতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ? এ রকম সংশোধনীর প্রস্তাব তৈরির প্রক্রিয়ায়, বা তা মন্ত্রিসভায় পাঠানোর আগে কি এ বিষয়ে জনমত যাচাইয়ের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে? এমনকি খোদ দুদকেরও মতামত নেওয়া হয়েছে কি? দুদক নিজেই যদি মনে করে এই সংশোধনী তার ক্ষমতা খর্ব করবে, তাহলে এ রকম সংশোধনীর উদ্যোগ নেওয়া কি যুক্তিসঙ্গত, যখন প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে যে দুদককে আরও শক্তিশালী করার মধ্য দিয়ে দুর্নীতি দমন ব্যবস্থাকে আরও দক্ষ ও ফলপ্রসূ করা হবে? এগুলোর উত্তর: না, না এবং না। আপামর জনসাধারণ বা সচেতন নাগরিক সমাজ—কারোর মতামত যাচাই বা বিবেচনা না করে সম্পূর্ণ এককভাবে সরকার দুদক আইন সংশোধনের এই উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, সরকারের নেতারাও বুঝতে পারছেন যে কাজটি সদুদ্দেশ্যপূর্ণ নয়। দুদককে শক্তিশালী করা নয়, বরং দুর্নীতি দমন ব্যুরোর মতো একটি অকার্যকর প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করাই এ সংশোধনীর উদ্দেশ্য—এটা সবার কাছেই পরিষ্কার।
সেদিন মহীউদ্দীন খান আলমগীর সাংবাদিকদের বলেছেন, দুদককে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা দেওয়া যাবে না, তাহলে সেনাপ্রধানও নিরঙ্কুশ ক্ষমতা চাইবেন। প্রথমত স্মরণ রাখা দরকার: নিরঙ্কুশ ক্ষমতা কাউকেই দেওয়া যাবে না, গণতন্ত্রে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা বলে কিছু নেই। নির্বাহী বিভাগের ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব যাতে নিরঙ্কুশ না হয়ে ওঠে সে জন্যই কতকগুলো স্বাধীন সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান থাকে। দ্বিতীয়ত, দুদকের কতটা ক্ষমতা থাকবে, তা নির্ধারিত হবে সংবিধান-নির্দেশিত সুশাসনের চেতনার আলোকে ও জনগণের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী। দুদক দুর্নীতি দমন করবে, দুর্নীতির বিচার করবে—এ জন্য তার যতটা ক্ষমতা দরকার তা সে পাবে, সে জন্য যেরকম আইনের দরকার হয়, নির্বাচিত আইনপ্রণেতাদের সেরকম আইনই প্রণয়ন ও গ্রহণ করতে হবে। দুদক আইনে যেসব সংশোধনী আনার প্রস্তাব মন্ত্রিসভায় গৃহীত হয়েছে, তার বিরুদ্ধে যেসব বক্তব্য প্রচারিত হচ্ছে, সেগুলোকে উপেক্ষা করা বা তাচ্ছিল্যের সঙ্গে উড়িয়ে দেওয়া মোটেও গণতান্ত্রিক আচরণ নয়।
দুদককে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা দিলে সেনাপ্রধানও নিরঙ্কুশ ক্ষমতা চাইবেন—এটা এক ধরনের তিক্ত খেদময় প্রতিক্রিয়া। সেনাপ্রধানেরা কি কখনো ক্ষমতা চেয়ে নেন? এবং ক্ষমতা না দিলে তাঁরা কি তাঁদের মাহেন্দ্রক্ষণে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকেন? না। যখন মুহূর্ত আসে, পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়, তখন তাঁরা কোনো কিছুরই অপেক্ষা করেন না। অবলীলায় নিজেদের হাতে তুলে নেন রাষ্ট্রের সর্বময় ক্ষমতা (কখনো সরাসরি, কখনো বা কোনো বাতাবরণে)। এবং জনগণ কিছু সময়ের জন্য বিভ্রান্ত, মোহগ্রস্ত হয়ে ভাবে—রক্ষাকর্তারা এসে গেছেন, এইবার সব বদলে যাবে, দুর্নীতি-দুঃশাসন থেকে রক্ষা পাবে দেশ-জাতি।
কিন্তু তাই কি কখনো হয়? হয়েছে কখনো? এরশাদের ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিহাদের’ কথা কি মনে পড়ে না? তাঁর বাইসাইকেলে চড়ে অফিসে যাওয়ার দৃশ্য কি আমরা ভুলে গেছি?
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলের মতো দুদকের কোনো প্রয়োজন নেই। মহীউদ্দীন খান আলমগীরের এই বক্তব্য শতভাগ সমর্থনযোগ্য। কারণ সে সময় দুদক স্বাধীন ছিল না, ছিল নির্বাহী বিভাগের অধীনস্থ, যে নির্বাহী বিভাগ চলছিল সেনাবাহিনীর ইচ্ছা-অনিচ্ছার সঙ্গে তাল মিলিয়ে। কিন্তু সেই অধীনস্থতা সাধারণের চোখে লাগছিল না, কারণ তখন কাজ চলছিল রাষ্ট্রের প্রত্যেকটি অঙ্গপ্রতঙ্গের মধ্যে একধরনের বোঝাপড়ার মধ্য দিয়ে। বোঝাপড়াটা গণতান্ত্রিক ছিল না, এক অঙ্গ অন্য অঙ্গের আচরণের জবাবদিহি দাবি করেনি। দৃষ্টান্তস্বরূপ, সেনাবাহিনীর সদস্যরা অনিয়ম-দুর্নীতি করছিলেন কি না, উপদেষ্টাদের সব আচরণ সততাপূর্ণ ছিল কি না—এসব প্রশ্ন দুদক বা অন্য কোনো রাষ্ট্রীয় সংস্থা তোলেনি। যাঁদের হাতে ক্ষমতা ছিল তাঁরা কেউ কোনো নয়-ছয় করছেন কি না—দুদক এই প্রশ্ন তুললেই টের পাওয়া যেত সে কতটা স্বাধীন।
তো সেই রকম দুদক আমরা কেন চাইব? তাহলে কেমন দুদক প্রয়োজন? যে দুদক ক্ষমতাসীন প্রত্যেক ব্যক্তি ও কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তদন্ত করতে পারবে, মামলা করে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করতে পারবে মহাক্ষমতাধর ব্যক্তিকেও। এটা সামান্য কথা, সবাই বোঝেন—একদম নিরক্ষর সাধারণ নাগরিকও। কিন্তু তার পরিবর্তে যদি দুদক আইন এমনভাবে সংশোধন করা হয়, যার ফলে সংস্থাটি সেই দুর্নীতি দমন ব্যুরোর মতো নখদন্তহীন, নির্বাহী বিভাগের অনুগ্রহনির্ভর প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হয়, তবে তার প্রয়োজন নেই। সরকার যদি নিজের ইচ্ছামতো দুদককে ব্যবহার করার ক্ষমতা নিজের হাতে রেখে দেয়, তাহলে দুদকের বিলুপ্তিই শ্রেয়। জনগণের অর্থ খরচ করে ক্ষমতাসীন সরকারগুলোর হাতে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও বিরাগভাজন ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠানকে শায়েস্তা করার হাতিয়ার তুলে দেওয়ার কোনো প্রয়োজন আছে কি?
মশিউল আলম: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
mashiul.alam@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.