মুক্তি পাওয়া জিম্মি: ‘ভয় ছিল ইসরায়েলই হত্যা করে ফিলিস্তিনি যোদ্ধাদের ওপর দায় দেবে’
ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম টাইমস অব ইসরায়েলের খবরে জানা গেছে, হামাসের হাতে আটক আইডিএফের (ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী) পাঁচ নারী সেনার একজন ছিলেন নামা লেভি।
জিম্মিদের মুক্তির দাবিতে তেল আবিবের জাদুঘরের সামনে আয়োজিত এক বিক্ষোভে অংশ নিয়ে তিনি বলেন, গাজায় জিম্মি থাকার সময় সবচেয়ে ভয়াবহ আশঙ্কা ছিল নিজ দেশের বিমান হামলা। তার ভাষায়, প্রাণহানির আশঙ্কা ছিল হামাস থেকে নয়, বরং ইসরায়েলি বোমা বর্ষণ থেকেই।
মুক্তি পাওয়া লেভি বলেন, প্রতিটি বোমা হামলা ছিল বিভীষিকাময়। প্রতিবার মনে হতো, এটাই শেষ। আর হয়তো কোনো দিন পৃথিবীর আলো দেখতে পারব না। তিনি বলেন, কোনো সতর্কতা ছাড়া হঠাৎই এক ধরনের বাঁশির মতো শব্দ শোনা যেত, যা ছিল বোমা আছড়ে পড়ার পূর্বসংকেত। ওই শব্দ শুনলেই শরীর ঠান্ডা হয়ে আসত। মনে হতো, এই বুঝি শেষ। তারপর আসত বিকট বিস্ফোরণের শব্দ, যা এত তীব্র ছিল, কয়েক ঘণ্টা অনুভূতিশূন্য হয়ে যেতাম।
একবার তার আশ্রয়স্থলের ওপর একটি ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হানে। ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান লেভি। যেদিকে আমি ছিলাম, সেদিকে আঘাত হানে না ক্ষেপণাস্ত্রটি। অল্পের জন্য প্রাণে রক্ষা পাই। জিম্মিদশায় আপনি কোথাও পালাতে পারবেন না, নিজেকে একেবারে অসহায় মনে হয়,—বলেন তিনি।
খাবার ও পানির সংকটের কথাও তুলে ধরেন এই নারী সেনা। জানান, কখনো খাওয়ার কিছু ছিল না। এমনকি পানিও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। একদিন বৃষ্টির পানি সংগ্রহ করে হামাস সদস্যরাই আমাকে দেয়। ওই এক চুমুক পানিই সেদিন মনে হয়েছিল যেন জীবন ফিরে পাওয়া।
নেতানিয়াহু সরকারের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করে লেভি বলেন, আমি কখনোই ভাবিনি, আমাদের অবস্থার ভয়াবহতা জেনেও সরকার আমাদের উদ্ধারে নিষ্ক্রিয় থাকবে। প্রথম দফার মুক্তিপ্রাপ্তদের অভিজ্ঞতা শুনেও সরকার কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি।
লেভির এই বক্তব্যের আগে চলতি মাসেই আরেক মুক্তিপ্রাপ্ত জিম্মিও একই রকম আশঙ্কার কথা জানান। তিনি বলেন, আমাদের ভয় ছিল হামাস নয়, ইসরায়েলই আমাদের হত্যা করবে। আর তারপর দায় চাপাবে হামাসের ওপর।
প্রসঙ্গত, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলে নজিরবিহীন হামলা চালিয়ে অন্তত ২৫১ জনকে জিম্মি করে গাজায় নিয়ে যায়। বর্তমানে তাদের মধ্যে ৫৮ জন এখনো হামাসের কাছে জিম্মি রয়েছেন।
ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিলে যে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে ইসরায়েল
ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার পরিণতি ভয়াবহ হতে পারে—এমন হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন ইসরায়েলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী গিদিওন সা’আর।
তিনি সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যদি ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেয়, তাহলে ইসরায়েল একতরফাভাবে পশ্চিম তীর ও জর্ডান উপত্যকায় নিজেদের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করবে, অর্থাৎ ওই অঞ্চলগুলো দখলে নেবে।
সোমবার (২৬ মে) ফিলিস্তিনি বার্তা সংস্থা ওয়াফা, ইসরায়েলি দৈনিক ‘ইসরায়েল হায়োম’-এর বরাতে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা যায়।
গিদিওন সা’আর বলেন, ইসরায়েলের বিরুদ্ধে নেওয়া যে কোনো একতরফা পদক্ষেপের জবাবে আমরাও একতরফা সিদ্ধান্ত নেব। তার এই বক্তব্যে স্পষ্ট হয়ে ওঠে, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হলে ইসরায়েল পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড দখলের পথে হাঁটবে।
তিনি আরও সতর্ক করেন, যেসব দেশ ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার কথা ভাবছে, তাদের পদক্ষেপ ইসরায়েলকে পশ্চিম তীরের বসতি ও জর্ডান উপত্যকা একতরফাভাবে দখলের দিকে ঠেলে দেবে।
এই হুঁশিয়ারি এমন এক সময়ে এসেছে, যখন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাখোঁ আগামী জুন মাসের মাঝামাঝি নিউইয়র্কে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন আয়োজনের উদ্যোগ নিচ্ছেন। সৌদি আরবের সমর্থনে আয়োজিত এই সম্মেলনের লক্ষ্য—ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিতে আন্তর্জাতিক সহমত গড়ে তোলা।
কূটনৈতিক সূত্রের বরাত দিয়ে ‘ইসরায়েল হায়োম’ জানায়, ১৮ জুন সম্মেলন অনুষ্ঠানের সম্ভাব্য তারিখ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। ওই দিনই একাধিক দেশ আনুষ্ঠানিকভাবে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এই সম্ভাবনায় ইসরায়েলি সরকার চরম অসন্তোষ প্রকাশ করেছে। তারা অভিযোগ করেছে, প্রেসিডেন্ট ম্যাখোঁ তাদের আশ্বাস দিয়েছিলেন, এমন কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হবে না। এখন সে অবস্থান থেকে সরে এসে ‘প্রতারণা’ করেছেন তিনি—এমনটাই দাবি তেল আবিবের।
প্রসঙ্গত, জাতিসংঘের ১৯৩টি সদস্য দেশের মধ্যে ইতোমধ্যে ১৪৯টি দেশ ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
এছাড়া, ২০২৪ সালের ২০ জুলাই আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে) একটি ঐতিহাসিক রায়ে জানায়, অধিকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইসরায়েলের উপস্থিতি আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী। আদালত ফিলিস্তিনিদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারকে সমর্থন করে এবং অবৈধভাবে গড়ে ওঠা ইসরায়েলি বসতি সরিয়ে নেওয়ার আহ্বান জানায়।
সূত্র : মিডল ইস্ট মনিটর, ওয়াফা, ইসরায়েল হায়োম
![]() |
| চলতি বছর জানুয়ারিতে যুদ্ধবিরতি ও জিম্মিমুক্তি চুক্তির আওতায় গাজা থেকে মুক্তি পাওয়া বাঁ থেকে প্রথম নামা লেভি। ছবি : সংগৃহীত |

No comments