বাড়ির কাজ বন্ধ, ৯০ লাখ টাকায় মীমাংসার প্রস্তাব পুলিশ কর্মকর্তার! by নুরুজ্জামান লাবু

পুলিশ কমিশনার এস এম শামীম
৯০ লাখ টাকার বিনিময়ে দুই পক্ষের বিবাদ মীমাংসা করে দেওয়ার প্রস্তাব দেন এক পুলিশ কর্মকর্তা। সে অনুযায়ী টাকা না পেয়ে তিনি রাজধানীর ভাষানটেক এলাকায় ৩১ জনের যৌথ মালিকানার একটি প্লটে ভবন নির্মাণকাজ বন্ধ করে দিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এমনকি মালিকদের কয়েকজনের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলাও দেওয়া হয়েছে। স্থানীয় একটি চক্রের যোগসাজশে এ কাজ করেছেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের সিনিয়র সহকারী কমিশনার এস এম শামীম।
এ বিষয়ে ভুক্তভোগীদের পক্ষ থেকে পুলিশ সদর দফতর ও ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনারের কাছে লিখিত অভিযোগ দেওয়া হলে নড়েচড়ে বসেন এই পুলিশ কর্মকর্তা। অভিযোগকারীসহ অন্যদের ডেকে নিয়ে অভিযোগ তুলে নিতে চাপও দিয়েছেন তিনি। কিন্তু ডিএমপি কমিশনার বিষয়টি আমলে নিয়ে তদন্ত করার নির্দেশ দিয়েছেন। ইতোমধ্যে পুলিশের মিরপুর বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার শাহেন শাহ তদন্ত শুরু করেছেন।
যোগাযোগ করা হলে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের পল্লবী জোনের সিনিয়র সহকারী কমিশনার এস এম শামীম বলেন, ‘আমার কাছে জহিরুল নামে একজন আবেদন করেছিলেন। আমি বলেছিলাম জমি সংক্রান্ত বিষয় সমাধানের কাজ আমার নয়। তবু আইনশৃঙ্খলার অবনতি হতে পারে বলে আমি দুই পক্ষকে ডেকেছিলাম।’ তিনি বাড়ির নির্মাণকাজ বন্ধ করে দেননি বা তাদের কাছে কোনও টাকাও চাননি বলে দাবি করেন।
পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, “যিনি আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন তিনি আমাকে বিষয়টি সমাধান করে দেওয়ার জন্য বলেছেন। আমি তাকে বলেছি জমির মালিককে ‘কম্পেনসেশন’ দিয়ে আপনারাই এটা সমাধান করেন।” পরে তার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ দেওয়া হয় বলে তিনি দাবি করেন।
পুলিশ সদর দফতর (স্মারক নং ১০৫৬) ও ডিএমপি হেডকোয়ার্টার্সে দেওয়া অভিযোগ থেকে জানা গেছে, ভাষানটেক থানার টোনারটেক মসজিদের পাশে ৫৮৫-সি নম্বর প্লটে একটি ভবনের নির্মাণকাজ চলছিল। ২০১৪ সালের ১১ সেপ্টেম্বর যৌথভাবে ওই জমি কেনেন ৩১ জন। গত বছরের ১৬ জুলাই তারা নির্মাণকাজ শুরু করেন। এ বছরের ১৮ এপ্রিল হঠাৎ পল্লবী জোনের সিনিয়র সহকারী পুলিশ কমিশনার এস এম শামীম বাড়ির মালিকদের কাছে একটি চিঠি [স্মারক নং ২১৯(২)এসি (পল্লবী জোন)] পাঠান। ওই চিঠিতে তিনি বলেন, জহরিুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তি জমির মালিক পরিচয় দিয়ে অভিযোগ করেছেন। এ জন্য বিষয়টি নিষ্পত্তির জন্য বাদী ও বিবাদীদের কাগজপত্র নিয়ে ২২ এপ্রিল হাজির হতে বলেন এস এম শামীম। তবে এ চিঠি ইস্যুর একদিন পরই নির্মাণকাজ বন্ধ করে দেন এই পুলিশ কর্মকর্তা।
জমির ৩১ মালিকের একজন নটরডেম কলেজের বাংলা বিভাগের প্রভাষক শহীদুল হাসান পাঠান। তিনি পুলিশ সদর দফতরে করা আবেদনে বলেন, বাড়ির কাজ বন্ধ না করলে ওই পুলিশ কর্মকর্তা তাদের ‘ক্রসফায়ার’-এ দেওয়ার হুমকিও দেন। এ সময় তারা রাজউকের অনুমোদিত নকশা নিয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত ভূমি কমিশনারের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। ভূমি কমিশনার জমিতে কোনও সমস্যা নেই বলে জানান। পরে আবারও তারা কাজ শুরু করতে গেলে পুলিশ কর্মকর্তা শামীম ক্ষিপ্ত হন। গত ১৪ জুন তাদের ৭ জনের বিরুদ্ধে একটি জিডি (নং ৪৯৮) করা হয়।
ওই অভিযোগে বলা হয়, গত ২৭ জুলাই পল্লবীর ৯৫ নম্বর ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগ সভাপতি হাফিজুর রহমান সরদার, এসএম সাদিকুরসহ ৩০-৩৫ জন তাদের সাইনবোর্ড ফেলে দিয়ে নতুন সাইনবোর্ড লাগিয়ে দেন। বাড়ির কাজ করলে মেরে ফেলা হবে বলে হুমকি দেন তারা। মিথ্যা মামলা দিয়ে জেলহাজতে পাঠানোরও হমকি দেওয়া হয়। ওই দিনই মালিকদের কয়েকজন বিষয়টি এসি শামীমকে জানালে তিনি হাফিজুর রহমানের সঙ্গে টাকা-পয়সা দিয়ে মীমাংসা করতে বলেন। তা না হলে তাদের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হবে বলে হুমকি দেন। এ থেকে পরিত্রাণের উপায় জানতে চাইলে পুলিশ কর্মকর্তা শামীম বলেন, আপনারা ৩১ মালিকের প্রত্যেকে ৩ লাখ টাকা করে মোট ৯০ লাখ টাকা হাফিজকে দিয়ে দিন। এতে রাজি না হওয়ায় পরদিনই মোস্তাফিজুর রহমান নামে স্থানীয় এক ব্যক্তিকে দিয়ে মালিকদের মধ্যে ৫ জনের নামের একটি মামলা দায়ের করানো হয়।
অভিযোগে বলা হয়, পুলিশ কর্মকর্তা শামীম এবং স্থানীয় কাউন্সিলর ও ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি হাফিজের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। এসি শামীম নিজেই হাফিজের মাধ্যমে জহিরকে দিয়ে মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে কাজ বন্ধ করে রেখেছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তদন্ত শুরু হওয়ার পর পুলিশ কর্মকর্তা এস এম শামীম বিষয়টি সমাধানের জন্য বাদী শহীদুল হাসান পাঠানসহ অন্য মালিকদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। বিষয়টি যাতে গণমাধ্যমে প্রকাশ করা না হয় সেজন্যও তদবির শুরু করেন তিনি।
যোগাযোগ করা হলে অভিযোগকারী শহীদুল হাসান পাঠান পুলিশ মহাপরিদর্শক ও ডিএমপি কমিশনার বরাবর অভিযোগ করার বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, বিষয়টি সমাধানের প্রক্রিয়া চলছে।
পুলিশ সদর দফতর ও ডিএমপির একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, পুলিশের উচ্চপর্যায় থেকে জমি সংক্রান্ত যেকোনও ঘটনায় পুলিশের হস্তক্ষেপ না করার বিষয়ে মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের কঠোরভাবে নিষেধ রয়েছে। দেওয়ানি মামলা সম্পর্কিত সব ঘটনা আদালতের মাধ্যমে সমাধানের নির্দেশনা রয়েছে।
এদিকে ডিএমপি কমিশনার অভিযোগটি আমলে নিয়ে মিরপুর বিভাগের উপ-কমিশনারকে বিষয়টি তদন্ত করে দেখার নির্দেশ দেন। মিরপুর বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার শাহেন শাহকে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তদন্তের অংশ হিসেবে অভিযোগকারী শহীদুল হাসান পাঠানকে গত ১৯ আগস্ট একটি চিঠি পাঠানো হয়েছে। আগামীকাল বৃহস্পতিবার (২২ আগস্ট) তার বক্তব্য রেকর্ড করা হবে বলে জানা গেছে।
জানতে চাইলে অতিরিক্ত উপ-কমিশনার শাহেন শাহ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ডিএমপি হেডকোয়ার্টার্সের নির্দেশে বিষয়টি আমি তদন্ত করছি। উভয় পক্ষকে ডাকা হয়েছে। এছাড়া এসি তো আমার এখানেই রয়েছে।’ তদন্তে ঘটনার সত্যতা পাওয়া গেলে যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান তিনি।

No comments

Powered by Blogger.