চীন-জাপানের অর্থনৈতিক চাপ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনকে এগিয়ে নিচ্ছে by ল্যারি জ্যাগান

বাংলাদেশে একটি রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির
মিয়ানমার ও বাংলাদেশ শেষ পর্যন্ত আগামী সপ্তাহ থেকে রোহিঙ্গা পুনর্বাসন প্রক্রিয়া শুরুর ব্যাপারে একমত হয়েছে যদিও এখন পর্যন্ত কোন প্রকাশ্য ঘোষণা দেয়া হয়নি।

এতে কোন সন্দেহ নেই যে, প্রত্যাবাসনের জন্য সাম্প্রতিক যে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি হয়েছে, তার পেছনে চীনের অব্যাহত প্রচেষ্টা এবং জাপানের চাপ রয়েছে। কিন্তু প্রত্যাবাসন  চুক্তির ব্যাপারে বিস্তারিত কিছুই প্রকাশ করা হয়নি, বা প্রাথমিক ধাপটা কতদিনের হবে, সেটাও জানানো হয়নি।

তবে কক্সবাজারের শরণার্থী ক্যাম্পের সূত্রগুলো আগাম প্রত্যাবাসন শুরুর ব্যাপারে অতটা আশাবাদী নন।

বাংলাদেশ ও মিয়ানমার ২০১৭ সালের নভেম্বরে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি স্বাক্ষর করলেও প্রত্যাবাসন ইস্যু নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে দর কষাকষি চলছে। ওই চুক্তির পেছনেও চীনের ভূমিকা ছিল এবং ওই চুক্তি অনুসারে প্রত্যাবাসন শুরুর জন্য ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসকে নির্ধারণ করা হয়েছিল।

সাত মাস পরেও প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু না হওয়ার পর জাতিসংঘ (ইউএনডিপি এবং ইউএনএইচসিআর) মিয়ানমারের সাথে ত্রিপক্ষীয় একটি চুক্তি করে গত বছরের জুনে, যার উদ্দেশ্য হলো রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তনের জন্য পরিবেশ তৈরি করা, কিন্তু সেখানেও প্রশংসা করার মতো কোন সাফল্য অর্জিত হয়নি। দুই দেশই পরস্পরের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে যে, প্রত্যাবাসন শুরুর দেরির কারণে কে দায়ি।

২০১৭ সালের আগস্টে সামরিক ষাঁড়াশি অভিযানের পর মিয়ানমারের পশ্চিমাঞ্চলীয় রাখাইন রাজ্য থেকে প্রায় এক মিলিয়ন রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে যায়। সেনাবাহিনীর কর্মকাণ্ডকে অব্যাহতভাবে ‘গণহত্যা’ আখ্যা দিয়েছে জাতিসংঘ – দেশটির বেসামরিক ও সামরিক নেতারা যে অভিযোগ সবসময় প্রত্যাখ্যান করে এসেছে।

যেটা নিশ্চিত, সেটা হলো অধিকাংশ শরণার্থী ফিরে আসার পর আবারও সহিংসতার শিকার হওয়ার ভয়ে প্রত্যাবাসনে রাজি হচ্ছে না। গত বছর নভেম্বরে যখন প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরুর চেষ্টা করা হয়, তখন শরণার্থী ক্যাম্পে আতঙ্ক ও বিভ্রান্তি ছড়িয়ে পড়ে এবং শেষ পর্যন্ত শরণার্থীদের প্রতিবাদের মুখে সেটা আর শুরু হতে পারেনি। ক্যাম্পের অনেক বাসিন্দাই এমন ভয় করছেন যে বাংলাদেশ তাদেরকে জোর করে বের করে দিচ্ছে।

এই মুহূর্তে প্রত্যাবাসন তালিকায় ৩৪৫০ জনের নাম অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, যাদের ফেরত নেয়ার জন্য মিয়ানমার প্রস্তুত বলে ঢাকাকে জানানো হয়েছে। বাংলাদেশ এর আগে যে ২২০০০ এর বেশি মানুষের তালিকা পাঠিয়েছিল, তাদের মধ্য থেকে এই সাড়ে তিন হাজার জনকে বৈধ অধিবাসী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। দুই দেশের সরকারী কর্মকর্তারা এ তথ্য জানিয়েছেন।

গত বছরের শুরুর দিকে মূলত যাচাই প্রক্রিয়া শুরু হয়। এর দায়িত্বে নিয়োজিত মিয়ানমারের সমাজ কল্যাণ মন্ত্রী ড. উইন মিয়াত আই সে সময় এক বিশেষ সাক্ষাতকারে সাউথ এশিয়ান মনিটরকে এ কথা বলেছিলেন।

জুলাইয়ের শেষ দিকে এক উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকের সময় বাংলাদেশের কর্মকর্তাদের কাছে এই তালিকাটি হস্তান্তর করে মিয়ানমার। যাচাইয়ের জন্য আরও ২৫,০০০ জনের আরেকটি তালিকা বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষ মিয়ানমারের কাছে হস্তান্তর করে।

মিয়ানমারের প্রতিনিধি দল সে সময় শরণার্থী শিবির সফর করেন এবং তাদের কাছে মিয়ানমারের পরিস্থিতি তুলে ধরেন। তাদেরকে এই নিশ্চয়তা দেয়া হয় যে, কাউকে জোর করে প্রত্যাবাসন করা হবে না এবং রাখাইনে পরিস্থিতির আরও উন্নতি করা হয়েছে: শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সেবার সুবিধা বাড়ানো হয়েছে; জীবিকা প্রকল্প নেয়া হয়েছে; এবং বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে সামাজিক সমঝোতা বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।

অবশ্য নাগরিকত্বের সমস্যাটি এখনও জটিল সমস্যা হিসেবেই রয়ে গেছে। অধিকাংশ মুসলিমকে বহু দশক ধরে নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত রাখা হয়েছে, যদিও সেখানে তারা বহু প্রজন্ম ধরে বাস করে আসছে। বরং এখানে ন্যাশনাল ভেরিফিকেশান সার্টিফিকেটের (এনভিসি) উপর জোর দেয়া হচ্ছে, যেটার মাধ্যমে তারা কিছু আবাসিক অধিকার পাবে এবং ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইনের অধীনে যেটা ভবিষ্যতে নাগরিকত্বের দিকে নিয়ে যেতে পারে।

বাংলাদেশ সরকার মিয়ানমারকে ৮ আগস্ট ইউএনএইচসিআরকে মিয়ানমারের অনুমোদিত তালিকা দিয়েছে এবং অনুরোধ করেছে যাতে ২২ আগস্ট প্রত্যাবাসনের জন্য প্রথম ব্যাচকে প্রস্তুত করা যায়। কিন্তু ইউএনএইচসিআর বিষয়টি শরণার্থীদের জানিয়েছে ১৫ আগস্ট। এক গণ সার্কুলারে জানানো হয়েছে প্রথম ধাপের প্রত্যাবাসন আগামী সপ্তাহে শুরুর পরিকল্পনা করা হয়েছে।

এই ঘোষণায় শরণার্থীরা হতবুদ্ধি হয়ে পড়েছে এবং কি হতে পারে সেটা নিয়ে তাদের মধ্যে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।

অবশ্য মিয়ানমার এবং বাংলাদেশ সরকার উভয়েই শরণার্থীদের এই আশ্বাস দিতে গিয়ে সমস্যায় পড়েছেন যে, তাদেরকে ‘নিরাপদ, স্বেচ্ছায়, মর্যাদার সাথে স্থায়ীভাবে প্রত্যাবাসনের ব্যবস্থা করা হবে’, যেটার কথা জাতিসংঘ বলে আসছে। কিন্তু বাস্তবে কি নিরাপত্তা ব্যবস্থা রয়েছে এবং সেখানে প্রত্যাবাসন নিরাপদ কি না, সেটা যাচাইয়ের জন্য জাতিসংঘ প্রস্তুত নয় এবং তারা এটাকে দ্বিপাক্ষিক বিষয় হিসেবে দেখছে বলে জাতিসংঘের ভেতরের সূত্রগুলো জানিয়েছে। ইউএনএইচসিআর একমাত্র যেটা নিশ্চিত করতে চাইছে, সেটা হলো প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া স্বেচ্ছায় হচ্ছে কি না।

শরণার্থী ক্যাম্পের সূত্রগুলো জানিয়েছে, উত্তেজনা বাড়ছে কারণ অধিকাংশ শরণার্থীই তাদের ভবিষ্যতের ব্যাপারে অনিশ্চিত। তাদের ভয় হলো এই প্রক্রিয়াটা বাধ্যতামূলক হয়ে যেতে পারে কারণ স্থানীয় পর্যায়ের বাংলাদেশের কর্মকর্তারা এই প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াটা শুরুর ব্যাপারে অতিমাত্রায় ব্যাগ্র হয়ে আছে।

এমন আশঙ্কাও রয়েছে যে, আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশান আর্মি (আরসা) – যারা এর আগে বেশ কতগুলো সন্ত্রাসী হামলা করেছে এবং ২০১৭ সালের আগস্টে তাদের হামলার কারণেই এই সঙ্কটের সূচনা হয়েছিল – তারা প্রত্যাবাসন ঠেকানোর জন্য সহিংসতার পথে যেতে পারে। আর এই আশঙ্কাও রয়েছে যে, ওই এলাকায় আরাকান আর্মির (এএ) তৎপরতার কারণে তাদেরকে অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়া হতে পারে।

বাংলাদেশের সূত্রগুলো জানিয়েছে, শরণার্থীরা ফিরতে চায় কি না, এটা তাদের জিজ্ঞাসা করার প্রক্রিয়া মাত্র শুরু হয়েছে। প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে যে, গত বছরের পরিস্থিতির আবার পুনরাবৃত্তি হবে, যখন শরণার্থী ক্যাম্পগুলোতে বাসগুলো থেমে ছিল এবং মিয়ানমারে ‘স্বাগতম’ লেখা ব্যানার লাগানো হয়েছিল, কিন্তু কেউই সেই বাসে ওঠেনি।

প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণের জন্য মিয়ানমার আসিয়ান এবং আসিয়ান কোঅর্ডিনেটিং কমিটি ফর হিউম্যানিটারিয়ান অ্যাসিস্ট্যান্স অন ডিজ্যাস্টার ম্যানেজমেন্টের (এএইচএ) দ্বারস্থ হয়েছে। অবগত সূত্রগুলো জানিয়েছে, আসিয়ান এখনও এ ব্যাপারে সাহায্যের জন্য প্রতিশ্রুতি দেয়নি। তবে আসিয়ান বিশেষ করে এ বছর থাই চেয়ারম্যানের অধীনে রাখাইন সঙ্কট সমাধানের জন্য মিয়ানমারের প্রচেষ্টাকে সহায়তার জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে আছে।

মিয়ানমার ও বাংলাদেশের মধ্যকার দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে আসিয়ান সেক্রেটারিয়েটের সদস্য এবং এএইচএ প্রতিনিধিরা অংশ নিয়েছেন। তারা এর আগে চলতি বছরের শুরুর দিকে উত্তর রাখাইনে প্রিলিমিনারি নিডস অ্যাসেসমেন্টও (পিএনএ) সম্পন্ন করেছেন, যেখানে শরণার্থীদের পুনর্বাসিত করার কথা রয়েছে।

যদিও এমন কোন নিশ্চয়তা নেই যে, শরণার্থীরা আগামী সপ্তাতেই রাখাইনে ফিরে যেতে শুরু করবে, তবে এই অচলাবস্থা নিরসনের জন্য মিয়ানমার ও বাংলাদেশ অব্যাহতভাবে চীনের ক্রমবর্ধমান চাপ এবং জাপানের তুলনামূলক কম চাপের মুখে রয়েছে।

চীনের বিশেষ দূত রাখাইন সমস্যার সমাধান এবং শরণার্থী প্রত্যাবাসন শুরুর জন্য মিয়ানমারকে সহায়তা করার জন্য তার সমস্ত মনোযোগ দিয়েছেন। চীনা কর্মকর্তাদের মতে, তিনি বেশ কয়েকবার সফর করেছেন। চীনা কূটনীতিকরা একই সাথে বাংলাদেশের সাথেও পর্দার আড়ালে কাজ করছে যাতে এই প্রক্রিয়াটাকে এগিয়ে নেয়া যায়।

সান চলতি সপ্তাহের শুরুর দিকে স্টেট কাউন্সিলর অং সান সু চি এবং সেনাবাহিনী প্রধান মিন অং লাইংয়ের সাথে আলাদা বৈঠক করেছেন এবং প্রক্রিয়া এগিয়ে নেয়ার বিষয়ে আলোচনা করেছেন।

জাপান বেসামরিক কর্তৃপক্ষ এবং সামরিক নেতাদের মৃদু চাপ দিয়েছে যাতে তারা শরণার্থীদের ফেরত নেয়ার প্রক্রিয়া শুরু করে। জুলাইয়ের শেষের দিকে জাপানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী নেপিদো ও ঢাকা সফর করেছেন এবং দুই দেশের সরকারকে জোর দিয়ে বলেছেন যাতে তারা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরুর জন্য সহযোগিতার ভিত্তিতে কাজ করে।

বাংলাদেশ ও মিয়ানমার উভয়েই সহায়তা, বিনিয়োগ ও বাণিজ্যের জন্য চীন ও জাপানের উপর যথেষ্ট নির্ভরশীল। মনে হচ্ছে যেন, ইউরোপিয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র ও জাতিসংঘ নিন্দা জানানো, হুমকি দেয়া ও অবরোধ আরোপের যে কৌশল নিয়েছে, তার বিপরীতে অর্থনৈতিক শক্তি এই দুই দেশকে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরুর ব্যাপারে অনেক সফলভাবে উৎসাহিত করছে।

No comments

Powered by Blogger.