লঙ্কা-মার্কিন সম্পর্কে ধাঁধার সৃষ্টি করেছে নতুন সেনা প্রধান ও সাবেক প্রতিরক্ষা সচিব

লে. জেনারেল সাভেন্দ্র সিলভা
মঙ্গলবার শ্রীলংকার পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয় যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ সম্পর্কিত খবরের প্রতিবাদ করে বেশ কঠোর ভাষায় এক বিবৃতি দেয়। এতে বলা হয়, সেনা কমান্ডার নিয়োগ নিয়ে বিদেশী পক্ষগুলো যেসব মন্তব্য করছে তা কাঙ্ক্ষিত ও গ্রহণযোগ্য নয়, কারণ এটা রাষ্ট্রপ্রধানের সার্বভৌম সিদ্ধান্ত।

মূলত একদিন আগে নতুন সেনাপ্রধান লে. জেনারেল সাভেন্দ্র সিলভার নিয়োগ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের দেয়া বিবৃতিরই প্রতিবাদ জানায় শ্রীলংকা।

সোমবার যুক্তরাষ্ট্রের দেয়া বিবৃতিতে লে. জেনারেল সাভেন্দ্র সিলভা নতুন আর্মি কমান্ডার হিসেবে নিয়োগ পাওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। এতে বলা হয়, জাতিসংঘ ও অন্যান্য মানবাধিকার সংস্থা তার বিরুদ্ধে ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের যে অভিযোগ নথিবদ্ধ করেছে তা গুরুতর ও বিশ্বাসযোগ্য। এই নিয়োগ শ্রীলংকার আন্তর্জাতিক সুনাম এবং ন্যায়বিচার ও জবাবদিহিতা জোরদার করতে তার প্রতিশ্রুতির ক্ষতি করবে, বিশেষ করে এমন একটি সময় এটা করা হলো যখন সমঝোতা ও সামাজিক ঐক্যের খুবই প্রয়োজন। সিলভার নিয়োগে উদ্বেগ প্রকাশ করে জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনও একটি বিবৃতি প্রকাশ করে। কিন্তু পশ্চিমাপন্থী হিসেবে পরিচিত ক্ষমতাসীন ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টি (ইউএনপি) এ যাবতকালের সবচেয়ে কঠোর ভাষায় যুক্তরাষ্ট্র ও জাতিসংঘের বক্তব্যের প্রতিবাদ করে।

ইউএনপি’র বিবৃতিতে বলা হয়, কিছু দ্বিপাক্ষিক অংশীদার ও আন্তর্জাতিক সংস্থা এই নিয়োগের ব্যাপারে অভিযোগের ভিত্তিতে যে উদ্বেগ প্রকাশ করছে তা দু:খজনক এবং এটা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সকল দায়িত্বশীল সদস্যের সমর্থিত আইনানুগ বিচারের নীতির পরিপন্থী।

বিদায়ী সেনা প্রধান লে. জেনারেল মহেষ সেনানায়কের জায়গায় সোমবার সিলভাকে নিয়োগ দেয়া হয়। এই নিয়োগ শ্রীলংকার তামিল সম্প্রদায়ের মধ্যেও ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। কারণ গৃহযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে সিলভা যে ব্যাটালিয়নের নেতৃত্ব দেন সেটি শীর্ষ এলটিটিই কমান্ডারদের নিশ্চিহ্ন করে। বলা হয়, ২০০৯ সালের মে মাসে সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে হেরে গিয়ে এলটিটিই কমান্ডাররা আত্মসমর্পনের জন্য সাদা পাতাকা তুলেছিলো কিন্তু সিলভার ব্যাটালিয়ন তাতে পাত্তা দেয়নি।

শুরু থেকেই কঠোর ভাষায় এই নিয়োগের প্রতিবাদ জানান তামিল রাজনীতিকরা। তামিল ন্যাশনাল এলায়েন্সের মুখপাত্র এমএ সুমান্থিরান নিন্দা জানিয়ে বলেন, এই নিয়োগ সংখ্যালঘু তামিল সম্প্রদায়ের জন্য অপমানজনক। এর মাধ্যমে সরকারের সমঝোতা উদ্যোগ ভণ্ডুল হয়ে গেলো।

শ্রীলংকায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের তিন মাস আগে প্রেসিডেন্ট মৈত্রিপালা সিরিসেনা নতুন সেনাপ্রধান নিয়োগ দিলেন। নির্বাচনে সাবেক প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপাকসার ভাই ও সাবেক প্রতিরক্ষা সচিব গোটাভায়া রাজাপাকসার বিজয়ী হওয়ার ভালো সম্ভাবনা রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। মাহিন্দার তিন বছর বয়সী দল শ্রীলংকা পদু জানা পেরামুনা (এসএলপিপি) থেকে প্রার্থী হয়েছেন তিনি।

এদিকে দেশে-বিদেশে কিছুটা হলেও বিতর্কিত একজনকে সেনাপ্রধান নিয়োগ করায় তার সমর্থক ও সমালোচক নির্বিশেষে সবাই স্বীকার করছেন যে এতে পশ্চিমা মানবাধিকার লবি জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলে (ইউএনএইচসিআর) কঠোর অবস্থান গ্রহণ করতে পারে। কিন্তু সমালোচকরা বলছেন যে, যুক্তরাষ্ট্র এমন এক সময় শ্রীলংকার মানবাধিকার নিয়ে বিবৃতি দিচ্ছে যখন তাদের প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধেই অভিবাসন বিরোধী নীতি অনুসরণের জন্য সারা বিশ্ব থেকে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তোলা হচ্ছে। যে নীতি শিশুদেরকে তাদের বাবা-মার কাছ থেকে আলাদা করে ফেলে এবং যুক্তরাষ্ট্র নিজেই ২০১৮ সালে ইউএনএইচসিআর ছেড়ে গেছে।

সার্বিকভাবে শ্রীলংকানরা এই নিয়োগকে দেশের নিজস্ব এবং জাতীয় সার্বভৌত্বের ব্যাপার বলে মনে করেন। এ বিষয়ে অন্য দেশের বলার কিছু নেই। বিশেষ করে জেনারেল সিলভার বিরুদ্ধে যখন কোন অভিযোগ প্রমাণ করা যায়নি। শ্রীলংকার ৩০ বছরব্যাপী গৃহযুদ্ধে হাজার হাজার তামিল, সিনহলিজ ও মুসলমান নিহত হয়। শ্রীলংকার সশস্ত্র বাহিনী এলটিটিইকে নিশ্চিহ্ন করার মধ্য দিয়ে ২০০৯ সালের মে মাসে এই যুদ্ধ শেষ হয়।

কেই কেউ মনে করেন এই নিয়োগ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের হৈচৈ-এর কারণ হলো আঙ্গুর ফল টক। কারণ তারা শ্রীলংকা সরকারের সঙ্গে স্ট্যাটাস অব ফোর্সেস এগ্রিমেন্ট (সোফা), একসেস এন্ড ক্রস সার্ভিসেস এগ্রিমেন্ট (এসিএসএ) ও মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ কোঅপারেশন ফান্ড এগ্রিমেন্ট (এমসিসি) চুক্তি করতে চেয়েও পারেনি।

মোটের উপর, সিলভার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া সিনহলা জাতীতাবাদী চেতনা জাগিয়ে তুলতে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারণায় কাজে লাগাতে পারবে এসএলপিপি। তামিল ও মুসলমানদের কাছ থেকে তেমন সমর্থন পাবে না ধরে নেয়ায় জনতাকে খেপিয়ে তোলার মতো এ ধরনের বক্তব্য এসএলপিপি’র খুবই প্রয়োজন। যদিও গোটাভায়ার পক্ষে শ্রীলংকার মুসলমানদের সমর্থন জোরদার হচ্ছে বলে কিছু ইংগিত পাওয়া যাচ্ছে। এই বিষয়টি আলাদা নিবন্ধে তুলে ধরবে সাউথ এশিয়ান মনিটর।

তবে, সাবেক প্রতিরক্ষা সচিবের ঘোষিত ও সরব মার্কিনবিরোধী অবস্থানের কারণে ‘ডাল মে কুচ কালা’ হ্যায়’ বলে সন্দেহ করছেন অনেকে। এই কিছু দিন আগেও গোটাভায়া ছিলেন মার্কিন নাগরিক এবং সংবিধান অনুযায়ী ২০১৯ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য তিনি নাগরিকত্ব পরিত্যাগ করেছেন বলে এসএলপিপি জানিয়েছে। গোটাভায়া যদিও জাতীয়তাবাদ, সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় নিরাপত্তাকে গুরুত্ব দিচ্ছেন বলে দাবি করে আসছেন এবং এগুলোই তার নির্বাচনী প্রচারণার ভিত্তি কিন্তু কোন কোন বিশ্লেষক মনে করে যুক্তরাষ্ট্র তার কাছ থেকে পুরোপুরি সরে যায়নি। তাহলে যুক্তরাষ্ট্র তার নাগরিকত্ব বাতিলের প্রক্রিয়া নির্বাচনের পর পর্যন্ত বিলম্বিত করতে পারতো। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে গোটাভায়ার বিরুদ্ধে দুই শ্রীলংকানের দায়ের করা দুটি মানবাধিকার লঙ্ঘনের মামলা চলমান থাকার পরও যুক্তরাষ্ট্র তা করেনি। মামলা দুটির একটি হলো ১০ বছর আগে নিহত সানডে লিডার পত্রিকার সম্পাদক লাসানথা বিক্রমেতুঙ্গা সম্পর্কিত। তার মেয়ে এই মামলা দায়ের করেন। কারণ তখন গোটাভায়া ছিলেন প্রতিরক্ষা সচিব এবং সশস্ত্র বাহিনী ছিলো তার নিয়ন্ত্রণে। যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে বিদ্রোহীদের সঙ্গে যেভাবে আচরণ করা হচ্ছিল, বিশেষ করে বেসামরিক লোকজন হতাহতের জন্য গোটাভায়ার তীব্র সমালোচনা করতেন লাসানথা।

No comments

Powered by Blogger.