যেভাবে চীন-ভারত প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুবিধা পাচ্ছে বাংলাদেশ by আনু আনোয়ার

বলা হয়ে থাকে বড় শক্তিগুলোর প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণে ক্ষুদ্র প্রতিবেশীরা অসহায় অবস্থার মধ্যে পড়ে যায়। সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রী লি সিয়েন লুং সম্প্রতি এমনটাই বলেছেন: “হাতি যখন লড়াই করে, তখন ঘাসগুলো দলিত হয়, আবার হাতিরা যখন ভালবাসে, তখনও ঘাসেরা দলিত হয়”। তবে প্রথাগত এই কথাটা চীন-ভারত প্রতিদ্বন্দ্বিতার ক্ষেত্রে খাটছে না, যেখানে প্রতিবেশী হলো বাংলাদেশ। ক্ষতির মুখে না পড়ে, দক্ষিণ এশিয়ার এই ছোট দেশটি বরং এখান থেকে মুনাফা লুটছে।
প্রতিযোগিতাপূর্ণ ভারত মহাসাগরে গুরুত্বপূর্ণ ভৌগলিক অবস্থানের সাথে সাথে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতিগুলোর মধ্যে অন্যতম। ১৬০ মিলিয়ন জনসংখ্যার বাংলাদেশ এখন বিশ্বের অষ্টম জনবহুল দেশ। জনসংখ্যার দ্বারাই যেহেতু বাজারের আকার নির্ধারিত হয়, তাই বিপুল জনসংখ্যার কারণে বাংলাদেশের সীমিত আয়তনের বিষয়টি চাপা পড়ে গেছে। বাংলাদেশ সম্প্রতি ২০২৪ সালের মধ্যে উন্নয়নশীল দেশের পর্যায়ে যাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছে। এরপরও আগামী দশকগুলোতে অবকাঠামোগত ও সামাজিক উভয় উন্নয়নকেই অগ্রাধিকার দিয়ে চলতে হবে বাংলাদেশকে। সে কারণে বিদেশী সরাসরি বিনিয়োগের (এফডিআই) যে ক্রমবর্ধমান চাহিদা, সেটা বাড়ানোর জন্য চীন-ভারত প্রতিদ্বন্দ্বিতাটাকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের ভূ রাজনীতিতে ভারত সবসময় ছিল কেন্দ্রে, যুক্তরাষ্ট্রের কিছু প্রভাব ছিল। চীনের মতো অন্যান্য আঞ্চলিক শক্তিগুলোর অবস্থান ছিল গৌন। ঐতিহাসিকভাবেও বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সাংস্কৃতিক ও সামাজিক যোগাযোগ অনেক বেশি। ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ মিলিতভাবে উপমহাদেশ হিসেবে পরিচিত। তবে ভারতের আধিপত্যবাদী মানসিকতা এবং প্রতিহিংসামূলক কৌশলের কারণে সাধারণ বাংলাদেশীদের মধ্যে ব্যাপক নেতিবাচক মনোভাবের সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে চীন যেখানে বিপুল বিনিয়োগের পরও অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার নীতি মেনে চলছে।
দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতি হিসেবে বাংলাদেশের বিনিয়োগ প্রয়োজন। অন্যদিকে চীন ও ভারত উভয়েই বাংলাদেশে বিনিয়োগকে তাদের প্রভাব বিস্তারের উপায় হিসেবে দেখছে। বাংলাদেশ এই সুযোগটাকে কাজে লাগাচ্ছে এবং এফডিআইয়ের ঘাটতি পূরণের জন্য চীন ও ভারত উভয়কেই কাজে লাগাচ্ছে।
এই সম্পর্কের একটা শক্তিশালী নিরাপত্তাগত দিকও রয়েছে। বাংলাদেশ তিন দিক থেকে ভারত কর্তৃক বেষ্টিত। এবং দুই দেশের মধ্যে যে ৪০৯৬ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে, সেটি বিশ্বের পঞ্চম দীর্ঘতম সীমান্ত। দক্ষিণে রয়েছে বঙ্গোপসাগর, যেখানে নজরদারি করছে শক্তিশালী ভারতীয় নৌবাহিনী। কৌশলগত বঙ্গোপসাগর অঞ্চলে ভারতের সাথে নৌ সীমা নিয়ে কিছু বিরোধও রয়েছে ভারতের সাথে।
বাংলাদেশের অস্ত্র আমদানির ক্ষেত্রে এখন সবচেয়ে বড় উৎস হলো চীন। পাকিস্তানের পর ঢাকাই এখন চীনের দ্বিতীয় বৃহত্তম অস্ত্র রফতানির জায়গা। সম্প্রতি ২০১৭ সালে বাংলাদেশের নৌবাহিনীকে সাবমেরিন দেয়ার জন্য চুক্তি করেছে চীন। যে চুক্তিতে ভারত খুশি হতে পারেনি।
চীন-ভারতের কৌশলগত প্রতিযোগিতা যতই বাড়বে, ততই তারা কৌশলগত অবস্থান থেকে গুরুত্বপূর্ণ বাংলাদেশকে নিজেদের বলয়ে টানার চেষ্টা করবে।
তবে, বাংলাদেশের একটা ব্যাপারে সচেতন থাকা উচিত যে, ভারত ও চীন উভয়েই মূলত নিজেদের স্বার্থেই বিনিয়োগ করবে। বঙ্গোপসাগরে ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতার পরোক্ষ শিকার যাতে না হতে হয়, সে জন্য নিজেদের কৌশলগত শক্তিকে বুদ্ধিমত্তার সাথে কাজে লাগাতে হবে বাংলাদেশকে। ভারত-চীন প্রতিযোগিতা থেকে সর্বোচ্চ অর্জনের চেষ্টার ক্ষেত্রে কোন পক্ষের প্রতি পক্ষপাতিত্ব দেখানো যাবে না। ভারত ও চীন উভয়ের সাথেই সুসম্পর্ক বজায় রাখাটা অর্থনৈতিক ও অবকাঠামোগত দিক থেকে দুর্বল বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
>>>আনু আনোয়ার, ইস্ট-ওয়েস্ট সেন্টারের অ্যাফিলিয়েট স্কলার এবং যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াইয়ের এশিয়া-প্যাসিফিক সেন্টার ফর সিকিউরিটি স্টাডিজের রিসার্চ ফেলো।
গত ৫ জুলাই ২০১৯, বেইজিংয়ের দিয়াওইউতি স্টেট গেস্ট হাউজে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাত করেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং

No comments

Powered by Blogger.