নিরাপদ সড়ক: 'যখন আমার লাশ যাবে কবরে তখন হয়ত সেই টাকাটা (ছেলেরা) পেলেও পেতে পারে' by শাহনাজ পারভীন

লাস্ট আপডেট- ১১ এপ্রিল ২০১৯: ১৯৮৯ সালের ৩রা ডিসেম্বর। রাজধানীর শান্তিনগরে বাড়ির সামনেই রাস্তা পার হয়ে দোকানে গিয়েছিলেন দৈনিক সংবাদ পত্রিকার সেই সময়কার বার্তা সম্পাদক মোজাম্মেল হোসেন মন্টু।
ফেরার সময় হঠাৎ উল্টো পথে আসা একটি কোমল পানীয় কোম্পানির পণ্য পরিবহনকারী গাড়ি ধাক্কা দেয় তাকে।
মাথায় গুরুতর আঘাত নিয়ে ১৩ দিন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন তিনি।
১৬ বছর পর আদালত থেকে ক্ষতিপূরণের আদেশ পেয়েছিলেন তার স্ত্রী রওশন আক্তার।
কিন্তু নানা জটিলতায় তার একটি টাকাও এখনো পাননি।
তিনি বলছেন, "টাকাটা আদায় করার জন্য আমাকে পুনরায় লোয়ার কোর্টে মামলা করতে হয়েছে। সেটাও তিন বছর হয়ে গেছে। সেখানে ঐ কোম্পানির প্লট বিক্রি করে টাকা দেওয়ার কথা। সেটা নিলামের জন্য ক্রোক হয়েছে। কিন্তু নিলামে কেউ যায়না কারণ ওটা ব্যাংকে মর্টগেজ দেওয়া।"
তিনি বলছেন, কেউ নিলামে আসছে না দেখে নিজ খরচে পত্রিকায় নিলামের জন্য বিজ্ঞাপন দিয়েছেন তাতেও কোন লাভ হয়নি।
এই রায়টি ছিল বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিপূরণের আদেশ পাওয়া প্রথম কোন রায়। ৭০ এর কোঠায় এখন বয়স এই নারীর।
বাংলাদেশে সড়কে চরম বিশৃঙ্খলার জন্য বহু দুর্ঘটনা ঘটে
দুর্ঘটনাটি যখন ঘটে তার দুই বছর পর নিম্ন আদালতে মামলা, সেই মামলার রায়, তার বিপক্ষে বিবাদী পক্ষের উচ্চ আদালতে আপীল, তারপর লিভ টু আপীল এরকম নানা আইনি জটিলতায় তিনি তিরিশ বছর পার করেছেন।
তিনি প্রশ্ন তুলছেন, "আইনের শাসন কোথায়? যখন আমার লাশ যাবে কবরে তখন হয়ত সেই টাকাটা আমার (ছেলেরা) পেলেও পেতে পারে।"
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আইনুন নাহার সিদ্দিকা ক্ষতিপূরণ মামলা বিষয়ে কাজ করেন।
তিনি বলছেন বাংলাদেশে ক্ষতিপূরণ পাওয়ার দুটি পদ্ধতি রয়েছে। একটি হল ব্রিটিশ আমলের টর্ট আইন।
তাতে যেকোনো ধরনের ঘটনায় ক্ষতি হলে ক্ষতিপূরণ চাওয়া যায়। সড়ক দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে রয়েছে ২০১৮ সালে সংশোধনীর পর সড়ক নিরাপত্তা আইন।
তিনি বলছেন, কোন মামলার রায়ের পর ক্ষতিপূরণের অর্থ আদায় কিভাবে হবে সেনিয়ে বাংলাদেশে পদ্ধতিগত জটিলতা রয়েছে।
তার ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি বলছিলেন, "ধরুন আপনি ক্ষতিপূরণ চাইলেন। আদালত আপনাকে ক্ষতিপূরণের টাকা দিলো। সেই টাকা তুলতে গেলে আপনাকে আবার একটা এক্সিকিউশন কেস করতে হবে।"
"সেখানে গিয়ে বলতে হবে এই রায় হয়েছে এই টাকাটা আমাকে দেয়া হোক। তখন সেই কেসে কোর্ট আবার বিবাদীকে ডেকে বলবে। তারা যদি টাকা না দেয় তাহলে পুলিশের মাধ্যমে আদায় করা হবে। তাকে নতুন করে আবার সময় সাপেক্ষ একটি আইনি প্রক্রিয়ায় যেতে হচ্ছে।"
তিনি আরও বলছেন, "বাস্তবতা হল বিবাদী যদি হাই প্রোফাইল হয়ে থাকে তাহলে ত্রিশ বছর কেন, কোন টাকা না দিয়ে বাংলাদেশে পঞ্চাশ বছরও কাটিয়ে দিতে পারে।"
বাংলাদেশে কাছাকাছি সময়ে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা ও সংবাদমাধ্যমের ব্যাপক মনোযোগের কারণে কয়েকটি খুব মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় প্রায় সাথেই সাথেই ক্ষতিপূরণের আদেশ দিয়েছে আদালত।
গত বছর নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের শুরু যে দুর্ঘটনায় তাতে নিহত দুই কলেজ ছাত্রের পরিবারকে দেয়া ক্ষতিপূরণ এর একটি।
বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় দু একটি ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণ পেলেও আদায় করতে পার হয়ে যায় বছরের পর বছর।
দুটি বাসের রেষারেষিতে দুর্ঘটনা-কবলিত এক কলেজ ছাত্রের ঝুলে থাকা বিচ্ছিন্ন হাতের ছবি ব্যাপক প্রচার হওয়ার পরও দ্রুতই ক্ষতিপূরণের আদেশ দেয়া হয়েছিলো।
এই দুটি নমুনার বাইরে একই রকম আলোচিত ঘটনার ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণের আদেশ দেয়ার নমুনা রয়েছে।
কিন্তু বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর ও পুলিশের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে বলছে গত বছর সাড়ে পাঁচ হাজারের বেশি সড়ক দুর্ঘটনায় সাড়ে সাত হাজারের মতো মানুষ মারা গেছে।
আহত হয়েছে ১৬ হাজারের মতো।
এরকম অসংখ্য ঘটনায় ক্ষতিপূরণের কোন নজির নেই।
দুর্ঘটনার শিকার হলে গাড়ি আটকে বাস মালিকদের সাথে দেন-দরবার করে মাঝে মধ্যে কিছু টাকা পাওয়ার ঘটনা থাকলেও পরিবহন খাতের সাথে জড়িতরা বিশেষ প্রভাবশালী হওয়ার কারণে তারা খুব সহজে পার পেয়ে যায় বলে মনে করছেন যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক চৌধুরী।
তিনি বলছেন, "পরিবহন পরিচালনার সাথে যারা জড়িত তারা কিন্তু অনেক শক্তিশালী। যেসব দল ক্ষমতায় থাকে, যখন যারাই থাকে তাদের সাথে তাদের একটা দহরম মহরম থাকে। এই সুসম্পর্কের মধ্য দিয়ে তারা এই সেক্টরে একটা প্রভাব বিস্তার করে। সেই কারণে একজন বিচ্ছিন্ন ক্ষতিগ্রস্ত যাত্রীর পক্ষে তাদের কাছ থেকে নেগোসিয়েশন করে আইনের সমান সুযোগ পাওয়া বা যথাযথ ক্ষতিপূরণ পাওয়া কোনভাবেই সম্ভব হয়না।"
নতুন মামলায় না গিয়ে ক্ষতিপূরণ আদায়ের একটি আইনি কাঠামোর প্রয়োজনের কথা বলছিলেন তিনি।
এরকম কোন কাঠামোর অভাবেই তৈরি হচ্ছে রওশন আক্তারের মতো ভুক্তভোগী।
দুর্ঘটনায় স্বামীর মৃত্যুর সময় থেকে পাঁচ ও নয় বছরের দুই ছেলেকে বড় করেছেন আর সরকারি কলেজের শিক্ষকের বেতন দিয়ে মামলা পরিচালনা করছেন।
তিনি বলছিলেন তার জীবন পার হয়ে গেছে এই এক মামলায়। কিন্তু এখন সেই কোম্পানিটিই আর নেই।
ক্ষতিপূরণ আদায়ে আরও নতুন সব জটিলতায় শেষ হচ্ছে তার বাকি জীবন।

No comments

Powered by Blogger.