অঙ্গীকার জরুরি—উচ্ছ্বাস নয়

একুশে ফেব্রুয়ারি
‘মোদের গরব মোদের আশা—আ-মরি বাংলা ভাষা’ পঙিক্তটি যখন মধ্যযুগের কবি লিখেছিলেন, তখন তিনি ঠিকই লিখেছিলেন। বাংলা ভাষা তখন ছিল বাঙালির গর্বের ধন এবং তার আশা-ভারসার স্থল। এই পঙিক্ত লেখার বহু বছর পরে বাংলার কবি—বাংলা ভাষার কবি নোবেল পুরস্কার পান। বাংলা ভাষা বিশ্বসাহিত্যে স্থান পায়। তারও ৫৮ বছর পরে বাংলা ভাষাভাষী মানুষ তাদের একটি স্বশাসিত ভূখণ্ড পায়। সুতরাং বাংলা ভাষা বাঙালির গর্বের ভাষা এবং তার সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আশা-ভরসার স্থল—তাতে সন্দেহ কী?
সাড়ে আট বছর সংগ্রামের পর ১৯৫৬ সালে বাংলা পাকিস্তানের অন্যতর রাষ্ট্রভাষা বা সরকারি ভাষা হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি পেলে বাংলা ভাষার প্রশ্নে একটি অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটে। একাত্তরে পাকিস্তানকে বিদায় জানানোর পর নিজেদের রাষ্ট্রে বাংলাই সর্বেসর্বা: বাংলার আর কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী রইল না। কোনো প্রতিপক্ষ রইল না। সুতরাং ভাষা নিয়ে আর লড়াই করার মতো কিছু থাকল না। তবে একেবারে কিছুই থাকল না, তাও নয়। বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি দিনটির ঘটনাবলি নিয়ে স্মৃতিচারণা শুরু হলো। এই স্মৃতিরোমন্থন চলবে বহুকাল বংশানুক্রমে: পুত্র বা কন্যা বলবেন তাঁদের পিতার ভূমিকা সম্পর্কে, তারপর নাতি-নাতনিরা দাদা-নানার অবদান তুলে ধরবেন মিডিয়ায় ফেব্রুয়ারি এলেই। একুশে ফেব্রুয়ারির সঙ্গে ফুলের মধ্যে পলাশ ও শিমুলের কী সম্পর্ক তা বোধগম্য নয়, কিন্তু এই ফুলের দুটি প্রজাতি বাংলার মাটি থেকে বিলুপ্ত হওয়ার উপক্রম হলেও ফেব্রুয়ারি এলেই এগুলোর উল্লেখ অনিবার্য হয়ে পড়ছে। সম্ভবত ওগুলো রক্তের মতো লাল বলে। যেখানে কোনো ত্যাগ স্বীকারের প্রয়োজন হয় না, শুধু কথা দিয়েই কিস্তিমাত করা সম্ভব, সেখানে বাঙালি তুলনাহীন এবং মালকোঁচা মেরে নেমে পড়ে। যেখানে প্রয়োজন কঠোর পরিশ্রম, অসামান্য ত্যাগ, বিপুল উদ্যম এবং নিরেট যুক্তিবাদিতা— সেখানে বাঙালি অতি দুর্বল। সে রকম কোনো বিরাট ও মহৎ আয়োজনে তাকে ধরে-বেঁধেও আনা সম্ভব নয়।
কোনো রকম ভাষা আন্দোলন ছাড়াই, মিটিং-মিছিল ছাড়াই পৃথিবীর বহু দেশে সেখানকার প্রধান ভাষা জাতীয় জীবনের সব ক্ষেত্রে স্থান করে নিয়েছে। সরকারের একটি অগণতান্ত্রিক ও অন্যায় সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে একদিন রাজপথে নেমে জীবন দিলেন রফিকউদ্দিন আহমদ, আবুল বরকত, আবদুস সালাম, আবদুল জব্বার, শফিউর রহমান, অহিউল্লাহ, আবদুল আওয়াল এবং এক নাম না-জানা কিশোর। একজন বাংলাভাষী মানুষও যত দিন এ দেশে থাকবে, তত দিন তাদের স্মৃতি থাকবে অম্লান। একুশে ফেব্রুয়ারি তারিখটি নয়—রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের শহীদেরাই অমর। তাঁদের মৃত্যু নেই। পৃথিবীর ইতিহাসে বাংলাদেশই একমাত্র দেশ, যেখানে সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে দেশপ্রেম প্রকাশের ধরনও বদলায়। প্রতি পাঁচ-দশ বছর পর পর আমাদের দেশপ্রেমের পারদও ওঠানামা করে। এক সরকারের সময় যদি শহীদ দিবসে ঘরে শুয়ে টানা ঘুম দিই বা শালীকে নিয়ে চিড়িয়াখানায় যাই, তো আরেক সরকারের সময় ভোর না হতেই সেজেগুজে শহীদ মিনারে রওনা দিই। বাঙালির কোনো কিছুর বেগ একবার শুরু হলে তা রোধ করতে পারে না। তা ছাড়া দেশাত্মবোধের হুজুগে অংশগ্রহণ না করা দেশদ্রোহের শামিল। কোনটা উৎসব আর কোনটা শোক পালন—তা যদি আমরা পার্থক্য করতে না পারি, তার চেয়ে দুর্ভাগ্যের বিষয় আর হতে পারে না। আমরা বাংলা নববর্ষ বা ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস যে আমেজে উদ্যাপন করব, সেই রকম ধুমধাম করে আনন্দ প্রকাশ একুশের শহীদ দিবসে করতে পারি না। উদ্যাপন করা আর পালন করা এক কথা নয়। ১৯৫৩ থেকে ’৭১ পর্যন্ত শহীদ দিবস পালনের অভিজ্ঞতা আমার রয়েছে। স্বাধীনতার পর থেকে, বিশেষ করে আশির দশক থেকে একুশে ফেব্রুয়ারি পালনে নতুন নতুনতর মাত্রা যোগ হচ্ছে।
উৎসবমুখর পরিবেশে পালন নয়, উদ্যাপিত হচ্ছে একুশে ফেব্রুয়ারি। কেউ ছোট বাচ্চা কাঁধে নিয়ে ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে রাস্তায় বেরিয়েছেন। ছোট বাচ্চা ও সুন্দরী যুবতীদের গালে অ আ ক খ লিখে ভাষার প্রতি প্রবল প্রেম প্রকাশ পৃথিবীর সবার কাছে প্রশংসাযোগ্য মনে হলেও আমার কাছে অসমর্থনযোগ্য। চ্যানেলগুলোতে সরাসরি দেখেছি এবং সংবাদপত্রেও ছবিতে দেখা যাচ্ছে, মেয়েদের মাথায় ফুলের মালা জড়ানো অথবা ফুলের মুকুট—গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে মেয়েরা যেমন যায়। টিভির সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে কেউ খুব জোর দিয়ে বলছেন, বাংলা আমাদের প্রিয় মাতৃভাষা না? বাংলা ভাষাকে আমরা ভালোবাসি, একুশ আমাদের মায়ের ভাষাকে ভালোবাসতে শিখিয়েছে। এর অর্থ দাঁড়ায় একুশের রক্তপাত না হলে আমরা বাংলাকে ভালোবাসতাম না। ধারণা করি, আলাওল, বিদ্যাসাগর, মধুসূদন, বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জসীমউদ্দীন, তাঁদের মায়ের ভাষাকে খুব বেশি ভালোবাসেননি। কারণ, তাঁরা কোনো উপলক্ষ থেকে নিজের ভাষাকে ভালোবাসার শিক্ষা পাননি। চর্যাপদের সময় থেকে বাংলা ভাষায় লেখালেখি হচ্ছে। বাংলা পৃথিবীর ১০-১১টি শ্রেষ্ঠ ভাষার একটি। বিপুল ও সমৃদ্ধ তার সাহিত্যসম্পদ। অগণিত সৃষ্টিশীল ও মননশীল প্রতিভা জন্ম দিয়েছে এই ভাষা। অতীতে কোনো শাসক আমাদের বাংলা বর্ণমালাকে মুছে দেওয়ার স্পর্ধা দেখাননি। দু-একজন নির্বোধ ও নষ্ট মানুষ আরবি বা রোমান হরফে বাংলা লেখার প্রস্তাব করে ধৃষ্টতা দেখিয়েছেন মাত্র।
বাংলা ভাষা বিলুপ্তির ষড়যন্ত্র কেউই করেনি, কিন্তু আজ আমরা বাংলা বর্ণ নিয়েই হাহাকার করছি। ব্যানারগুলো ‘দুঃখিনী বর্ণমালা’ নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করছে ফেব্রুয়ারিজুড়ে। এই বর্ণমালা যে সত্যি সত্যি দুঃখিনী, তাতেই বা সন্দেহ কী? এক সমীক্ষা করতে গিয়ে গতবার ফেব্রুয়ারিতে বইমেলায় ৪২ জন লেখককে জিজ্ঞেস করেছিলাম বাংলা স্বরবর্ণ কয়টি এবং ব্যঞ্জনবর্ণের সংখ্যা কত। সঠিক উত্তর কেউ দেননি, মাথা চুলকিয়েছেন অথবা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়েছিলেন। একুশে ফেব্রুয়ারিতে তোবড়ানো গালে নয়, আপেলের মতো গালে যতই বাংলা হরফ আঁকা হোক, বাংলা ভাষা আজ অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি শত্রুকবলিত। গাড়িতে বসে যখন রেডিওতে একটি নিউ সং প্লে হতে দেখি এবং সাম ইয়ং ফ্রেন্ডদের রিকোয়েস্টে যখন একটি ভাটিয়ালি সং ওয়ান উইকের মধ্যে সেকেন্ড টাইম রিপিট করতে দেখি, তখন তো বলতে ইচ্ছাই হয়: হায় বাংলা ভাষা! স্বাধীনতার পর থেকে বাংলা ভাষা ব্যবহারে যে অরাজকতা চলছে, স্বাধীনতার আগের ইসলামীকরণের গোত্রবিশেষের অপচেষ্টা তার কাছে কিছুই নয়। জাতি রাষ্ট্র হিসেবে আমাদের সৌভাগ্য যে দেশের ৯৯ শতাংশ মানুষ বাংলায় কথা বলে। বাংলা ছাড়া অন্যান্য ভাষা যাদের মাতৃভাষা, তারাও বাংলা বলতে পারে। অথচ পৃথিবীর অধিকাংশ দেশই বহু ভাষাভাষী, সেখানে প্রধান ভাষা একাধিক। সেসব দেশে ভাষানীতি আছে। সেসব দেশে কোনো ভাষা আন্দোলন হয়নি, ভাষা সংস্কার নিয়ে কাজ হয়েছে। সর্বস্তরে জাতীয় ভাষা বা সরকারি ভাষা প্রয়োগে অবিচল আনুগত্য দেখায় জনগণ। খেয়াল-খুশির কোনো জায়গা নেই, তা সরকার বরদাশতও করে না। ভাষার অবমাননা বা বিকৃতি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। বহু ভাষাভাষী থাইল্যান্ডে ভাষা আন্দোলনের প্রয়োজন হয়নি।
কিন্তু সে দেশে থাই ভাষা জীবনের সর্বক্ষেত্রে ব্যবহূত। মালয়েশিয়ায় রাষ্ট্রভাষা নিয়ে রক্তপাত ঘটেনি। সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষা মালয় ভাষাই সরকারি ভাষা। কঠোর তার প্রয়োগ। ৩৩ শতাংশ চৈনিক ভাষাভাষী মানুষ তাতে আপত্তি করেনি। যদিও চীনা ভাষাও প্রচলিত। তামিল, হিন্দিও চলে। ইন্দোনেশিয়া হাজারো দ্বীপের দেশ। জনগণ কথা বলে এক হাজার ১০০ ভাষায়। অনেক পরিবারে দু-তিনটি ভাষা প্রচলিত। সেখানে ভাষা ইন্দোনেশীয় বা মালয় সরকারি ভাষা। জাভানিজ ও অন্যান্য ভাষাও বহুল প্রচলিত, কিন্তু সংঘর্ষ নেই। মালয়েশীয় মালয় ও ইন্দোনেশীয় মালয় ভাষায় সমতা আনতে দুই দেশের মধ্যে একটি চুক্তি হয়েছিল ১৯৭৩ সালে। চুক্তিটি হলো: দুই দেশের মালয় ভাষার শব্দের বানান হবে এক, অর্থ হবে এক, উচ্চারণ হবে এক। মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায় শিক্ষার মাধ্যম সরকারি ভাষা মালয়, তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজিও চালু আছে। ওসব দেশে ভাষার প্রশ্নে কিছুমাত্র উচ্ছ্বাস নেই। একটুখানি দেশ সিঙ্গাপুর। সেখানে চৈনিক, মালয়, তামিল ও ইংরেজি— চারটিই সরকারি ভাষা। কেউ নিজেরটাই শ্রেষ্ঠ বলে হুংকার দেয় না, কেউ কারও মাথা ফাটায় না। যেসব দেশের জনসংখ্যা খুব কম সেসবেও তাদের সরকারি ভাষা জীবনের সব ক্ষেত্রে নিষ্ঠার সঙ্গে প্রয়োগ না করে উপায় নেই। যেমন ডেনমার্কে ডেনিশ, নরওয়েতে নরওয়েজিয়ান, সুইডেনে সুইডিশ ও ফিনিশ, ফিনল্যান্ডে ফিনিশ। ফিনল্যান্ডে মাত্র সাড়ে ৬ শতাংশ মানুষ সুইডিশ ভাষাভাষী। কিন্তু সাংবিধানিকভাবে সেটাও স্বীকৃত সরকারি ভাষা। তুরস্কে তুর্কি সরকারি ভাষা, কিন্তু কুর্দিশও চলে। প্রতিটি জাতীয়তাবাদী দেশেই সরকারি ভাষা রাষ্ট্রীয় কাজে ও শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে কঠোরভাবে প্রয়োগের বিধান রয়েছে। শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলার দাবি বহুদিনের; পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগে থেকেই।
ষাটের দশকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে ইংরেজির সঙ্গে বাংলাও অনুমোদিত হয়। উঁচু শ্রেণীতে বাংলা বইয়ের অভাব। সে অভাব অনুবাদের মাধ্যমে দূর করা খুব সহজ। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন সে উদ্যোগ নিতে পারত। নিয়েছে কি? ভাষাকে মর্যাদা দেওয়ার ব্যাপারে চেতনাটাই আসল, উচ্ছ্বাস নয়। ভারতে সরকারি ভাষা হিন্দি হলেও, অতি বড় দেশ বলে ইংরেজির সেখানে প্রাধান্য থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু প্রতিটি রাজ্যের মানুষ দৈনন্দিন জীবনে নিজেদের ভাষা ব্যবহার করছে—হিন্দি নয়। তামিলনাড়ুতে তামিল, গুজরাটে গুজরাটি, কেরালায় মালয়ালম, অন্ধ্র প্রদেশে তেলেগু ও উর্দু, কর্ণাটকে কানাড়া, মহারাষ্ট্রে মারাঠি, পাঞ্জাবে পাঞ্জাবি, রাজস্থানে রাজস্থানি ভাষা যেভাবে ব্যবহূত, পশ্চিমবঙ্গে বাংলা সেভাবে নয় এবং বাংলাদেশেও বাংলার কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকলেও আন্তরিকতার সঙ্গে ব্যবহূত হয় না। ভাষা নিয়ে একবার হয়েছে রক্তপাত, এখন হচ্ছে মামলা-মোকদ্দমা। ভাষাদূষণে উচ্চ আদালতের নির্দেশে কমিশনও গঠিত হয়েছে। বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। কিন্তু দেশের ৫০টির বেশি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যই পড়ানো হয় না। এ জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কি কোনো দায়িত্ব নেই? আমাদের এনজিওগুলো দেশের মারাত্মক উন্নয়ন চায়। তাদের প্রায় সব গবেষণাপত্রই ইংরেজিতে রচিত হয়। কারণ, ওগুলোর পাঠক দাতারা— দেশের মানুষ নয়। বক্তৃতাবাজি, স্মৃতিচারণা ও অতীতের বীরদের হরবছর সংবর্ধনা দিয়ে জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে বাংলার প্রচলন সম্ভব হবে না। জাতিকে গড়ে তুলতে হয়। সে জন্য সরকারি আনুকূল্যের প্রয়োজন রয়েছে, যেমন দিয়েছিলেন হোসেনশাহি রাজত্বে আলাউদ্দিন হুসেন শাহরা। কিন্তু সবচেয়ে বেশি দরকার শিক্ষিত শ্রেণীর ভাষার অনাচার রোধে ও উন্নতি সাধনে সুদৃঢ় অঙ্গীকার।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।

No comments

Powered by Blogger.