নারী আন্দোলন ও সুফিয়া কামাল

সুফিয়া কামাল
সুফিয়া কামাল (১৯১১-১৯৯৯) অধ্যয়ন করলে শত বছরের নারী আন্দোলনের ইতিহাস উন্মোচিত হয়। নারীর অধিকার অর্জনের আন্দোলন সামগ্রিকভাবে পরিচালিত হয় পরিবার-সমাজ-রাষ্ট্রের নানাবিধ বৈষম্য-অসাম্যের বিরুদ্ধে। তুলনামূলকভাবে নারীর ওপর এই বৈষম্য-অসাম্য চলে আসছে বেশি হারে। যুগ যুগ ধরে সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ায় নারীকে অধস্তনতায় ফেলে দেওয়া হয়েছে, ইতিহাসে নারীর অবদান উপেক্ষিত হয়েছে, নারীর মানবাধিকার স্বীকৃতি পায়নি, অর্জিত হয়নি। নারী সংগঠন, আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে, নেতৃত্ব দিয়ে ৭২ বছর সুফিয়া কামাল উল্লিখিত দর্শন-চেতনা ও আদর্শ বাংলাদেশের নারী আন্দোলনের ইতিহাসে লিপিবদ্ধ করেছেন। বরিশালের শায়েস্তাবাদের নবাব পরিবারের অবরোধবাসিনী হয়েও তিনি দেশের ও পরিবারের স্বদেশি পরিমণ্ডলের অনুপ্রেরণায় প্রভাবিত হয়েছেন, সে সময়ের নারী আন্দোলনের কাজে যুক্ত হয়েছিলেন।
১৯৪৭ সালের জুলাই মাসে মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন সাপ্তাহিক বেগম প্রকাশ করেন সুফিয়া কামালকে প্রধান সম্পাদিকা ও নূরজাহান বেগমকে ভারপ্রাপ্ত সম্পাদিকার দায়িত্ব দিয়ে। সে বছরেরই আগস্ট মাসে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনমুক্ত স্বাধীন দেশ পাওয়ার আনন্দ পরিণত হলো নিরানন্দে। দেশ ভাগ হয়ে গেল হিন্দু-মুসলিম ধর্মভিত্তিতে। কলকাতার কর্মস্থল, নারী আন্দোলনের কর্মকাণ্ড ত্যাগ করে সুফিয়া কামালকে ঢাকায় চলে আসতে হলো সপরিবারে। তারপর ঢাকায় স্থায়ীভাবে বাস করতে এসে তিনি একেবারেই নতুন রাজনৈতিক ও বিপ্লবী ধারার নারী আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। পূর্ব পাকিস্তানের প্রগতিশীল-ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক চেতনায় বিশ্বাসী বিপ্লবী ধারার নারীনেত্রী ও সংগঠকেরা তাঁকে পূর্ব পাকিস্তানের নারী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য আকুল আহ্বান জানাতে থাকলেন। পূর্ব পাকিস্তানে লীগ সরকারের প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক দমননীতির প্রতিবাদে জনগণের পক্ষে দাঁড়ানোর মতো গুটি কয়েক নারীনেত্রীর মধ্যে সুফিয়া কামাল ছিলেন সর্বজন-সমর্থিত। সমাজতান্ত্রিক আদর্শের শ্রেণী-শোষণহীন সমাজব্যবস্থার প্রতি সুফিয়া কামালের কুণ্ঠাহীন একাত্মতাবোধ তাঁকে দ্ব্যর্থহীনভাবে যুক্ত করেছে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যদের উদ্যোগে পরিচালিত মহিলা সমিতির সভানেত্রীর দায়িত্ব পালনে। নিবেদিতা নাগ, যুঁইফুল রায় ও অন্যান্য কমিউনিস্ট নারীর আহ্বানে ‘পূর্ব পাকিস্তান মহিলা সমিতি’র সভানেত্রী হন ১৯৪৮ সালে। তার পরপরই লীলা নাগের প্রচেষ্টায় সুফিয়া কামালকে সভানেত্রী ও লায়লা সামাদকে সাধারণ সম্পাদক করে প্রতিষ্ঠিত হয় ওয়ারী মহিলা সমিতি। ১৯৪৭ থেকে ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানের সময়কালে জাতীয় সকল সংকটে রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক-সামাজিক বিবেকের মতো দায়িত্ব পালন করেছেন সুফিয়া কামাল।
সামরিক শাসনের গণবিরোধী পদক্ষেপের বিরুদ্ধে, রাজবন্দীদের নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে, রবীন্দ্রশতবর্ষ উদ্যাপনের দাবিতে, দাঙ্গা প্রতিরোধে সুফিয়া কামাল সামাজিক গণমানুষের সর্বাধিনায়কের ভূমিকায় একাধারে ছায়ানট, কচি-কাঁচার মেলা, পূর্ব পাকিস্তান মহিলা সংসদ প্রতিষ্ঠা ও নারী আন্দোলনের মহিলা সংগ্রাম পরিষদ পরিচালনায় নেতৃত্ব দিয়েছেন। জাতীয় স্বাধিকার আন্দোলনের মূলধারায় নারী আন্দোলনের সম্পৃক্ততার বিষয়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন সুফিয়া কামাল। ১৯৬৮ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত পূর্ণ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, জরুরি আইন প্রত্যাহার, দমননীতি বন্ধ, রাজবন্দীর মুক্তিসহ বিভিন্ন দাবিতে দেশব্যাপী চলতে থাকা গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পাশাপাশি নারীসমাজের বৃহত্তর আন্দোলন অব্যাহত ধারায় সক্রিয় ছিল। পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকাসহ সব জেলা শহরে নারীসমাজ সভা-সমিতিতে সংগঠিত হয়ে, মিছিল-স্লোগানে, প্রতিবাদ-প্রতিরোধে সোচ্চার হয়ে আন্দোলন সংঘটিত করতে থাকেন। ১৯৬৮ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি নারীসমাজের বিরাট মিছিল ঢাকার রাজপথ প্রকম্পিত করে ছাত্রনেতা আসাদ হত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছে। এই নারী আন্দোলন দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে কার্যকর প্রভাব রেখেছিল। এই সময়ের নারী আন্দোলন রাজনৈতিক গণতন্ত্রের দাবিতে, স্বাধীনতার দাবিতে যেমন সোচ্চার ছিল, তেমনি নারী স্বাধীনতা ও নারী অধিকার অর্জনে বদ্ধপরিকর ছিল। ‘মহিলা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করে সুফিয়া কামাল সারা দেশে সর্বস্তরের নারীসমাজকে মানবতার মুক্তিতে একযোগে জাতি গঠনের কাজে এগিয়ে আসতে আহ্বান জানিয়েছিলেন। বিভিন্ন প্রগতিশীল রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক-ছাত্রসংগঠনের সচেতন নারীরা তাঁর নেতৃত্বে সম্মিলিতভাবে সংগ্রাম পরিষদের নারী আন্দোলনের কাজ অব্যাহত চলার পর সাংগঠনিক প্রক্রিয়ায় কাজ করার লক্ষ্যে ‘পূর্ব পাকিস্তান মহিলা পরিষদ’ গঠিত হয় ১৯৭০ সালের ৪ এপ্রিল।
এই সংগঠন মুক্তিযুদ্ধের স্বাধীনতার প্রস্তুতি পর্বে এ দেশের নারী আন্দোলনের রূপায়ণ সাধনে সচেষ্ট ছিল সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে। বাংলাদেশের সমাজে নারীর বিরুদ্ধে রক্ষণশীলতা, যৌতুক, নির্যাতন, বহুবিবাহ, যথেচ্ছ তালাক, ফতোয়া, নির্যাতন, ধর্ষণ, গণধর্ষণ, পারিবারিক নির্যাতনের নিষ্ঠুরতা, পাশবিকতা বাড়তে থাকে। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ ও অন্যান্য নারী সংগঠন সম্মিলিতভাবে এসব সামাজিক-পারিবারিক-রাজনৈতিক-আইনি শোষণ-বঞ্চনা-বৈষম্য ও নির্যাতন থেকে নারীসমাজের মুক্তির আন্দোলন করতে থাকে সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে। বিশ শতকের নব্বইয়ের দশকে স্বৈরতন্ত্র উচ্ছেদের জন্য, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য সাধারণ নির্বাচনে নারীসমাজকে সক্রিয় হওয়ার আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন সুফিয়া কামাল। পরবর্তী সময়ে নির্বাচিত সরকার যখন নারীর সম-অধিকার আন্দোলনের দাবি উপেক্ষা করতে থাকে, তখনো নারী আন্দোলনের সোচ্চার মিছিলে সুফিয়া কামাল অতন্দ্র প্রহরীর মতো নেতৃত্ব দিয়েছেন। ১৯৯৯ সালের ২০ নভেম্বর ইহজীবন অবসানের আগ পর্যন্ত সচেতনভাবে নারীর মানবাধিকার অর্জনের দাবি জানিয়ে নারী আন্দোলনকে আর্থসামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক-বৈষম্য-অসাম্য-নির্যাতনের বিরুদ্ধে অব্যাহতভাবে সোচ্চার থাকা এবং অসহায়, দরিদ্র, নির্যাতিত নারীর শিক্ষা-কর্মসংস্থান-ক্ষমতায়নের জন্য কাজ করার পথ-নির্দেশ দিয়ে গেছেন তিনি।
এই মহীয়সী নারীর প্রয়াণ দিবসে জানাই শ্রদ্ধাঞ্জলি।
মালেকা বেগম: নারীনেত্রী। অধ্যাপক, সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটি, ঢাকা।

No comments

Powered by Blogger.