স্নোডেন কত দিন রাশিয়ায় থাকবেন?

এডওয়ার্ড স্নোডেন
আমেরিকান হুইসলব্লোয়ার এডওয়ার্ড স্নোডেনের বাবা লনি স্নোডেন গত মাসে রাশিয়ায় ছেলের সঙ্গে এক সপ্তাহ কাটানোর পর আমেরিকা ফিরে গিয়ে সাংবাদিকদের বলেছেন, তাঁর ছেলের কাছে আরও অনেক গোপন তথ্য আছে, সেগুলোর প্রকাশ নিশ্চিত করতে তাকে আরও কিছুদিন রাশিয়াতেই থাকতে হবে। কিন্তু রাশিয়ায় রাজনৈতিক আশ্রয় পাওয়ার সময় স্নোডেন বলেছিলেন, তিনি রাশিয়ায় কোনো গোপনীয় তথ্য নিয়ে যাননি। হাওয়াই থেকে হংকংয়ে চলে যাওয়ার সময় তিনি তাঁর ব্যবহূত চারটি ল্যাপটপের সব কটি সঙ্গে নিয়েছিলেন কি না, এ বিষয়ে তিনি পরিষ্কার করে কিছু বলেননি। ধারণা করা হয়, মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থা (এনএসএ) গোয়েন্দা-তথ্যের ভান্ডার থেকে তিনি যে বিপুল পরিমাণ অতি-গোপনীয় নথিপত্র ‘চুরি’ করেছিলেন, সেগুলো সংরক্ষিত ছিল ওই চারটি ল্যাপটপেই। তিনি নিজে সেগুলো ইন্টারনেটে প্রকাশ না করে প্রথমে যুক্তরাজ্যের গার্ডিয়ান ও যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকার সাংবাদিকদের হাতে তুলে দিয়েছেন। তথ্যভান্ডারটি এতই বিশাল যে, কোনো কোনো সংবাদমাধ্যম হিসাব করে বলেছে, সেগুলোর পুরোটা প্রকাশ করতে ৩০ বছর লেগে যাবে। বর্তমানে ২৯ বছরের যুবক স্নোডেন ৫৯ বছরের প্রৌঢ় হয়েও দেখতে পাবেন, তাঁর দেওয়া গোপনীয় নথিপত্রের ভিত্তিতে সাংবাদিকেরা চাঞ্চল্যকর একেকটা সংবাদ পরিবেশন করছেন। সর্বশেষ চাঞ্চল্য সৃষ্টি হলো অস্ট্রেলিয়ায়: স্নোডেনের দেওয়া গোপনীয় নথিপত্রের ভিত্তিতে লন্ডনের গার্ডিয়ান পত্রিকা ও অস্ট্রেলিয়ান ব্রডকাস্টিং করপোরেশন (এবিসি) ফাঁস করে দিয়েছে, অস্ট্রেলিয়ার গোয়েন্দারা ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট ও তাঁর অতি ঘনিষ্ঠ আটজন নেতার টেলিফোনে আড়ি পেতেছিল। 
এই খবরে ভীষণ ক্ষিপ্ত হয়ে ইন্দোনেশিয়ার সরকার ক্যানবেরায় নিয়োজিত তাদের রাষ্ট্রদূতকে দেশে ফিরিয়ে নিয়েছে এবং অস্ট্রেলীয় সরকারকে এই বলে হুমকি দিয়েছে যে অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে ইন্দোনেশিয়ার বিভিন্ন ক্ষেত্রে যেসব সহযোগিতার সম্পর্ক আছে, সেগুলো তারা রাখবে কি না, তা পর্যালোচনা করবে। এর আগে স্নোডেনের দেওয়া নথিপত্রের ভিত্তিতে বিভিন্ন দেশের সংবাদমাধ্যম খবর পরিবেশন করেছে যে মার্কিন এনএসএর গোয়েন্দারা তাদের গোয়েন্দা নজরদারি ব্যবস্থার অংশ হিসেবে নিয়মিতভাবে জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালি, স্পেন, ব্রাজিল, মেক্সিকো, ভারতসহ বেশ কয়েকটি দেশের সাধারণ নাগরিক, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, সরকারপ্রধান ও রাজনৈতিক নেতাদের মোবাইল ফোনে গোপনে আড়ি পেতেছে, কথোপকথন রেকর্ড করেছে, টেক্সট মেসেজ কপি করেছে এবং ইন্টারনেটে আদান-প্রদান হয়েছে, এমন অনেক তথ্য গোপনে সংগ্রহ করেছে। মাত্র ৩০ দিনে তারা ফ্রান্সের নাগরিকদের সাত কোটি ফোনকল রেকর্ড করেছে—এমন খবর প্রকাশের পর ফরাসি প্রেসিডেন্ট ওলাঁদ প্রেসিডেন্ট ওবামাকে ফোন করে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন। ঠিক তার পরপরই জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল ওবামাকে ফোন করে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘আপনারা কি আমার মোবাইল ফোনে আড়ি পেতে রেখেছেন?’ ম্যার্কেল নিজের গোয়েন্দা বাহিনীকে হুকুম দিয়েছিলেন পরীক্ষা করে দেখতে, সত্যিই তাঁর মোবাইলে মার্কিন গোয়েন্দারা আড়ি পেতেছিল কি না। তারা পরীক্ষা করে নিশ্চিত হয়েছে যে ঘটনা সত্য।
সে কথা চ্যান্সেলরকে জানানোর পরই ম্যার্কেল ওবামাকে ফোন করেছিলেন। ওবামাকে তিনি প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করেছিলেন উত্তর পাওয়ার জন্য নয়, কারণ উত্তর তো তিনি জেনেই গেছেন। তিনি ওবামাকে ফোন করেছিলেন তাঁকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলতে। ওবামা প্রশাসনের জন্য সত্যিই এক বিরাট অস্বস্তিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে স্নোডেনের কারণে। একের পর এক তথ্য ফাঁসের মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হচ্ছে যে আমেরিকা তার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্রদেশগুলোকেও বিশ্বাস করে না, সেসব দেশের সরকারপ্রধানদের ব্যক্তিগত মোবাইল ফোনের কথোপকথনও আমেরিকান গোয়েন্দারা সিস্টেম্যাটিক্যালি রেকর্ড করে। মিত্রদের প্রতি এই অনাস্থা ও অবিশ্বাস আমেরিকান গোয়েন্দাব্যবস্থার অবিচ্ছেদ্য অংশ। মার্কিন সেনাসদস্য ব্র্যাডলি ম্যানিং আর উইকিলিকসের প্রতিষ্ঠাতা জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের কারণে ওবামা প্রশাসন যে বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছিল, তার থেকে অনেক বেশি বিব্রতকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে এনএসএর সাবেক কন্ট্রাক্টর এডওয়ার্ড স্নোডেনের কারণে। উইকিলিকসের কেবলগেটের নথিপত্রগুলো ছিল মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের তারবার্তা, যার মধ্যে টপ-সিক্রেট বা অতি-গোপনীয় তথ্য একটিও ছিল না। কিন্তু স্নোডেনের চুরি করা নথিভান্ডারের অধিকাংশই ‘টপ-সিক্রেট’ শ্রেণীর গোয়েন্দা তথ্য। স্নোডেন সেগুলো নিজের কম্পিউটারে ডাউনলোড করেছিলেন,
যখন তিনি মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর কর্মী ছিলেন। সিআইএর গোপনীয় নথিপত্রে সিংহভাগ কখনোই ‘ডিক্ল্যাসিফাই’ বা প্রকাশ করা হয় না। স্নোডেন এগুলো সংবাদমাধ্যমকে না দিলে এবং ভবিষ্যতে আর কোনো হুইসলব্লোয়ার এমন সুযোগ না পেলে আমরা এখন মার্কিন গোয়েন্দাবৃত্তির অন্যায়-অবৈধ অনুশীলনের যেসব প্রমাণের কথা জানতে পারছি, কখনোই তা জানা সম্ভব হতো না। আঙ্গেলা ম্যার্কেলও জানতে পারতেন না যে তাঁর বন্ধু বারাক ওবামার গোয়েন্দা গোপনে তাঁর মোবাইল ফোনের সব কথোপকথন রেকর্ড করে আসছিল (এখন বন্ধ করেছে। কিন্তু গার্ডিয়ান-এর সূত্রে পাওয়া আরও গুরুতর তথ্য হলো, ম্যার্কেলের ফোনে মার্কিন গোয়েন্দা আড়ি পেতে আসছিল এক দশক ধরে)। স্নোডেনের বাবা আমেরিকায় ফিরে গিয়ে সাংবাদিকদের বলেছেন, তাঁর ছেলে রাশিয়ায় বেশ ভালো আছে। সংবাদমাধ্যম থেকে আমরা জানি, স্নোডেন রাশিয়ায় একটি ওয়েবসাইটে কাজ শুরু করেছেন। রাশিয়ার লোকজন তাঁকে আপন করে নিয়েছেন। কিন্তু যে মুক্ত-স্বাধীন জীবন তাঁর ছিল, সে তুলনায় এখন তাঁর অবস্থা অনেক কষ্টকর।
দুই লাখ ডলার বেতনের একটা চাকরি ছিল তাঁর, ছিল সুন্দর এক মেয়েবন্ধু। আর আমেরিকা-ইউরোপজুড়ে ছিল এক ঝাঁক বন্ধুবান্ধব। স্নোডেনের জন্য সবচেয়ে কষ্টের বিষয় হলো, এখন তাঁর চলাফেরা হয়ে পড়েছে ভীষণভাবে সীমাবদ্ধ; নিরাপত্তাহীনতার ঝুঁকি প্রবল। দ্বিতীয়ত, আমেরিকান গোয়েন্দাদের নজরদারির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে যে দেশটিতে তিনি আশ্রয় পেয়েছেন, সেই রাশিয়ায় ভ্লাদিমির পুতিনের গোয়েন্দারা যে তাঁকে সর্বক্ষণ চোখে-চোখে রাখছে—এই মর্মান্তিক সত্য কথাটা তাঁর চেয়ে ভালো করে আর কে জানেন? আমেরিকান সংবিধান নাগরিকের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা বা প্রাইভেসি নামের পবিত্র অধিকারটি যে দৃঢ়তার সঙ্গে রক্ষা করার কথা বলে, রাশিয়ার সংবিধান মোটেও তা করে না। ক্লিনটন-বুশ-ওবামার সরকারেরা জাতীয় নিরাপত্তা আর সন্ত্রাসবাদ দমনের ধুয়া দিয়ে নাগরিকদের মুক্তি, স্বাধীনতা, ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকার সংকুচিত করতে চায় কিন্তু রাশিয়ার শাসকদের মতো অনায়াসে তা করতে পারে না। বরং তাদেরকে নানা রকমের জবাবদিহির মুখে পড়তে হয়। স্নোডেন এনএসএর গোয়েন্দাবৃত্তি সম্পর্কে তথ্য ফাঁস করার পর আমেরিকান কংগ্রেসে মার্কিন গোয়েন্দাব্যবস্থার সংস্কার সাধনের দাবিতে আলোচনা শুরু হয়েছে। হুইসলব্লোয়ার হিসেবে স্নোডেন যা করেছেন, তা করা সম্ভব আমেরিকায়, রাশিয়ায় কারও পক্ষে কোনোভাবেই নয়। রাশিয়া ব্র্যাডলি ম্যানিং, জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ কিংবা এডওয়ার্ড স্নোডেন তৈরি করতে পারে না।
স্নোডেন এসব কথা বেশ ভালোভাবে জানেন। পুতিন রাশিয়ার সের্গেই নাভালনিসহ কতজন উদারপন্থী ব্লগারকে কারাগারে বন্দী করে রেখেছেন, সে হিসাবও স্নোডেনের কাছে আছে। স্নোডেন স্বভাবত এক প্রতিষ্ঠানবিরোধী স্বাধীনচেতা যুবক; কেজিবির উত্তরসূরিদের সার্বক্ষণিক নজরদারিতে তাঁর রুশ-জীবন হয়েছে সত্যিকারের এক সোনার খাঁচা। তিনি জানেন, রাশিয়ায় তাঁকে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে কোনো নৈতিক বা আদর্শিক কারণে নয়, স্রেফ কৌশলগত কারণে। আন্তর্জাতিক রাজনীতির মতিগতিরও যে ঠিকঠিকানা থাকে না, সেটাও তিনি ভালোই বোঝেন। এই সোনার খাঁচা থেকে বেরিয়ে স্নোডেন বরং জার্মানি চলে যেতে চান: খোদ আঙ্গেলা ম্যার্কেলের কাছে চিঠি লিখে তিনি সে ইচ্ছা ব্যক্ত করেছেন। এআরডি নামে জার্মান এক টিভি স্টেশন জনমত জরিপ করে দেখেছে, দেশটির ৬০ শতাংশ মানুষ মনে করে, স্নোডেন একজন বীর বা নায়ক। জার্মান পার্লামেন্টের সদস্যসহ গ্রিন পার্টির দুই নেতা রাশিয়া গিয়েছিলেন স্নোডেনের সঙ্গে দেখা করতে। তাঁরা দেশে ফিরে নিউইয়র্ক টাইমস-এ একটি যৌথ নিবন্ধ লিখেছেন; সেখানে জার্মান সরকারের প্রতি তাঁরা আহ্বান জানিয়েছেন, স্নোডেনকে জার্মানিতে আশ্রয় দেওয়া হোক। তিনি জার্মান পার্লামেন্টে গিয়ে এনএসএর গোয়েন্দাবৃত্তি সম্পর্কে সাক্ষ্য দেবেন। কিন্তু আঙ্গেলা ম্যার্কেলের সরকার ওবামার গোয়েন্দার ওপর যতই ক্ষুব্ধ হোক, আমেরিকার দাগি ফেরারি আসামি স্নোডেনকে জার্মানিতে আশ্রয় দেবে—এমন আভাসও কোথাও নেই।
মশিউল আলম: সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.