প্রসবজনিত মাতৃমৃত্যু রোধে সচেতনতা by মুহাম্মদ আবদুল মুনিমখান

গর্ভবতী নারীর নিরাপদ মাতৃত্ব লাভের অধিকার ও মাতৃস্বাস্থ্য পরিচর্যার ব্যাপারে ইসলামের দিকনির্দেশনা রয়েছে। সন্তান গর্ভে এলে গর্ভবতী নারীকে ধর্মীয় অনুশাসন ও অনেক কঠিন স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হয়, তা না হলে মা ও শিশু উভয়েরই মৃত্যুর আশঙ্কা হতে পারে। ভবিষ্যতে যিনি মা হবেন, তাঁকে অবশ্যই স্বাস্থ্য উন্নয়ন, সচেতনতা বৃদ্ধি ও যথেষ্ট পরিচর্যা করতে হবে। একজন পরিপক্ব সুস্থ মা-ই একজন সুস্থ শিশুর জন্ম দিতে পারেন। সুস্থ শিশুর জন্য নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিত করা দরকার। এ জন্য গর্ভবতী মায়ের প্রয়োজনীয় বিশ্রাম, যত্ন ও সেবা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রকৃতপক্ষে নিরাপদ মাতৃত্ব প্রত্যেক গর্ভবতী নারীরই ন্যায্য প্রাপ্য বা ন্যায়সংগত অধিকার। একজন নারী নিরাপদে মা হবেন, এ দায়িত্ব সবার। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা ঘোষণা দিয়েছেন, ‘আর সন্তানের পিতার দায়িত্ব হলো মাতার খাওয়া-পরার উত্তম ব্যবস্থা করা।’ (সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২৩৩)
অথচ দেশের অধিকাংশ গর্ভবতী নারীই নানা অপুষ্টির শিকার। ফলে তাঁদের নবজাতকও হয় পুষ্টিহীন। স্ত্রী বা সন্তানের মা যাতে প্রয়োজনীয় পরিমাণে প্রোটিন ও ভিটামিনসমৃদ্ধ খাদ্য গ্রহণে যত্নবান হন, সেদিকে পরিবারপ্রধান বা স্বামীর দৃষ্টি রাখা অবশ্যকর্তব্য। গর্ভবতী মায়ের জন্য পুষ্টিকর ও বেশি খাবার প্রয়োজন। কেননা, তাঁর খাবারে একটি নয়, দুটি প্রাণ বাঁচে। বিশেষ করে গর্ভকালীন ও শিশুকে মাতৃদুগ্ধদানকালে এ ব্যাপারে বেশি সতর্কতা দরকার। তাই গর্ভবতী স্ত্রীর খাবারের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করে রাসুলুল্লাহ (সা.) বাণী প্রদান করেছেন, ‘তোমরা (স্বামীরা) যা খাবে, তাদের (নারীদের) তা-ই খেতে দিবে।’
গর্ভবতী মায়ের যত্ন মূলত শিশুর যত্ন। সন্তান যে মুহূর্তে মাতৃগর্ভে আসে, ঠিক তখন থেকেই শিশুর যত্নের সঙ্গে সঙ্গে গর্ভবতী মায়ের যত্ন নিতে হয়। সন্তান গর্ভে এলে মা অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে জীবন যাপন করবেন। তা না হলে মা ও শিশু উভয়েরই সমূহ বিপদ হতে পারে। গর্ভবতী মাকে অবশ্যই তাকওয়া বা আল্লাহভীতি অবলম্বন করতে হবে। তাঁকে সব ধরনের খারাপ কাজ, অসদাচরণ ও দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত থাকতে হবে। সন্তান গর্ভে এলে মায়ের শরীরে প্রচুর পরিমাণে খাদ্য ও পুষ্টির দরকার হয়। এ সময় মায়ের নিজের ও গর্ভের শিশুর দুজনের খাদ্য প্রয়োজন। তাই গর্ভবতী মাকে বেশি করে পুষ্টিকর ও পরিমিত সুষম খাবার খেতে হবে। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘আল্লাহ প্রদত্ত রিজিক থেকে তোমরা উত্তম খাবার খাও।’ (সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৭২)
আল্লাহ তাআলা গর্ভবতী নারীকে প্রদান করেছেন নিরাপদ মাতৃত্বের অধিকার তথা গর্ভধারণের ক্ষমতা। যদিও নারীর গর্ভধারণ ও শিশু জন্মদানের প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। প্রতিবছর সারা বিশ্বে পাঁচ লাখ নারী সন্তান জন্মদানসংক্রান্ত জটিলতায় মারা যান। সন্তান প্রসবজনিত কারণে বিশ্বে প্রতি মিনিটে একজন মা মারা যান। মাতৃস্বাস্থ্যের একটি ভয়াবহ দিক হচ্ছে মৃত্যু; অন্যটি হচ্ছে দীর্ঘদিনের লম্বা-চওড়া অসুস্থতা, যেমন প্রসবজনিত ফিস্টুলা। যে অসুস্থতায় নারীদের অধিকার, এমনকি মান-মর্যাদা পর্যন্ত নষ্ট হয়ে যায়। প্রসবজনিত ফিস্টুলা একটি মারাত্মক ও যন্ত্রণাদায়ক রোগ। এর কারণে রোগী একাধারে শারীরিক, মানসিক, পারিবারিক ও সামাজিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন। এর চিকিৎসা না করালে জ্বালাপোড়া ও ক্ষত বাড়তেই থাকে। মাতৃমৃত্যু যদি রোধ করা যায়, তবে প্রসবজনিত ফিস্টুলাও রোধ করা সম্ভব। প্রসবকালীন ফিস্টুলার কারণে কেউ আজীবন অসুস্থ জীবন যাপন করেন। অথচ নবী করিম (সা.) চিকিৎসা গ্রহণের কথা বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা রোগ এবং দাওয়া (ওষুধ) দুটিই পাঠিয়েছেন এবং প্রতিটি রোগেরই ওষুধ পাঠিয়েছেন। সুতরাং তোমরা চিকিৎসা গ্রহণ করো।’ (আবু দাউদ)
ইসলামে প্রসূতি মা ও নবজাতকের জীবন রক্ষায় চিকিৎসার তাগিদ দেওয়া হয়েছে। শিক্ষার অভাব ও ধর্মীয় গোঁড়ামির কারণে গ্রামাঞ্চলে মেয়েরা প্রতিবছর সন্তান ধারণ করে থাকেন, তাই মাতৃত্বকালীন অপুষ্টির কারণে রোগাক্রান্ত মায়েদের স্বাস্থ্যহানি ঘটায় অনেক সময় মা ও নবজাতকের মৃত্যুর আশঙ্কা থাকে। সাধারণত বাল্যবিবাহ ও গর্ভসঞ্চার, অপরিকল্পিত গর্ভধারণ, কিশোরী মায়ের পুষ্টিহীনতা, রক্তস্বল্পতা, গর্ভাবস্থায় রক্তক্ষরণ, প্রসবজনিত ফিস্টুলা ও সুচিকিৎসার অভাব প্রভৃতি কারণে নারীর নিরাপদে মা হওয়ার স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়। সুতরাং নবজাতক ও শিশুমৃত্যু রোধ করতে হলে গর্ভধারণের আগে থেকেই সন্তানসম্ভবা মায়ের প্রতি যত্নশীল হওয়া উচিত। তা ছাড়া গর্ভকালীন ও প্রসবের পর একাধিকবার প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ নিশ্চিত করা দরকার। এ জন্য পরিবারের সবাই গর্ভবতী হওয়া থেকে প্রসব-পরবর্তী সময় পর্যন্ত মাকে ধর্মীয় দিকনির্দেশনা, সৎ পরামর্শ ও উৎসাহ দিতে পারেন। আল্লাহর ওপর ভরসার পাশাপাশি ব্যবস্থাপত্র গ্রহণ করাও ইসলামের শিক্ষা। ইসলামে সন্তান প্রসবকালীন পবিত্রতা ও সাবধানতা অবলম্বনের ব্যাপারে দিকনির্দেশনা রয়েছে। সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার সময় মাতৃমৃত্যু প্রতিরোধের জন্য প্রসবকালীন একজন দক্ষ সেবিকার প্রয়োজন। গর্ভকালীন চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী সুচিকিৎসা না করালে জীবন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে। তাই প্রসূতি মা ও শিশুকে বাঁচাতে হলে প্রতিটি গ্রামে গণসচেতনতামূলক ব্যবস্থাসহ ইসলামের আলোকে পরিবার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য ধর্মীয় নেতাদের সম্পৃক্ততা প্রয়োজন। ঘন ঘন সন্তান প্রসব থেকে বিরত রাখার জন্য মাঠপর্যায়ে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের এগিয়ে এসে জনগণকে সচেতন করতে সঠিক পরামর্শ দিতে হবে। যেসব মা স্বাস্থ্যসেবা পান না, তাঁদের কাছে মাতৃস্বাস্থ্যসেবা পৌঁছাতে হবে।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, গবেষক ও কলাম লেখক।
dr.munimkhan@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.