আন্দোলন ও জনগণের নিরাপত্তা দুটোইগুরুত্বপূর্ণ

হেফাজতে ইসলাম নামের নতুন একটি ধর্মীয় গোষ্ঠী মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। হেফাজত কোনো রাজনৈতিক দল নয়, কওমি মাদ্রাসাকেন্দ্রিক একটি ধর্মীয় গোষ্ঠী। তাদের অস্তিত্ব তিন মাস আগেও এ দেশের কেউ অনুভব করেনি। তবে তারা ছিল নীরবে, নিভৃতে। ধর্মীয় ওয়াজ-নসিহতের মধ্যেই তাদের তৎপরতা সীমাবদ্ধ ছিল। অনেকে অভিযোগ করেছেন, জামায়াতে ইসলামী হেফাজতের মধ্যে ঢুকে এই আন্দোলন পরিচালনা করছে। তবে হেফাজত জামায়াতের কোনো দাবি নিয়ে আন্দোলন করছে না। তাদের ১৩ দফা একান্তই তাদের দাবি। এ রকম উদ্ভট দাবি এর আগে কোনো দল করেনি। তবে জামায়াত নেপথ্যে থেকে এই আন্দোলনের সুযোগ নিয়ে পরিস্থিতি জটিল করার চেষ্টা করতে পারে। সে রকম আলামত এবং বক্তব্যও পাওয়া যাচ্ছে।
হেফাজতের কথাবার্তা ও কাজকর্ম সম্পর্কে তীব্র সমালোচনার সময় এসেছে। হেফাজত কোনো রাজনৈতিক দল না হয়েও যে ১৩ দফা দাবি পেশ করেছে সেগুলো নীতিগত ইস্যু। এগুলো সেই সরকারই বাস্তবায়ন করতে পারে, যাদের নির্বাচনী ইশতেহারে এসব দাবি থাকে, যাদের জনগণ এ রকম দাবি বাস্তবায়ন করার জন্য ম্যান্ডেট দেয়। অন্যরা এ রকম দাবি নিয়ে তাদের প্রত্যাশার কথা বলতে পারে শুধু। কিন্তু তা পূরণে অন্য দলের সরকারকে অতিরিক্ত চাপ দিতে বা বাধ্য করতে পারে না।
সরকার, নারী সমাজ ও নাগরিক সমাজের একটি অংশ ১৩ দফা দাবির বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার। এই প্রতিবাদের মাধ্যমে তারা ১৩ দফা ও হেফাজতকে অত্যধিক গুরুত্ব দিয়েছে, যা হেফাজত প্রত্যাশা করতে পারে না। হেফাজত কোনো রাজনৈতিক দল নয়। তারা কখনো সরকার গঠন করতে পারবে না। তাদের দাবি একান্তই মুখের বুলি। হেফাজতের ১৩ দফা দাবির প্রতি কর্ণপাত করাই ঠিক হয়নি। ইতিহাসের ও গণতন্ত্রের পথপরিক্রমায় অনেক ছোট ছোট দল, অনেক গোষ্ঠী, অনেক ব্যক্তি উন্মাদের মতো অনেক কথা বলেন। তাঁদের সব কথাকে গুরুত্ব দিয়ে বিতর্ক করলে আসল কাজ ব্যাহত হয়। প্রলাপকে প্রলাপের মতোই দেখা উচিত। হেফাজত যদি একটি রাজনৈতিক দল হতো, তাহলেও খুব বেশি গুরুত্ব দেওয়ার দরকার হতো না। একটি মাদ্রাসাকেন্দ্রিক গোষ্ঠী, যাদের সামগ্রিক প্রভাব খুবই অল্প, মাদ্রাসার বাইরে যাদের সমর্থক খুঁজে পাওয়া মুশকিল, বহু ইসলামধর্মীয় সংগঠনই যাদের বিরোধিতা করছে, তাদের ১৩ দফা দাবি নিয়ে হইচই করা সময়ের অপচয় বলেই মনে হয়। হেফাজতের ১৩ দফা দাবি সম্পর্কে সরকার শুধু একটি বিবৃতি দিয়ে বলতে পারত, ‘আমরা অন্যায্য দাবি পূরণ করার জন্য ক্ষমতায় আসিনি। হেফাজত যদি মনে করে তাদের দাবি খুবই জনপ্রিয়, তাহলে তার ভিত্তিতে তারা আগামী নির্বাচনে অংশ নিয়ে ক্ষমতায় এসে দাবিগুলো বাস্তবায়ন করতে পারে। দেশের জনগণ তাদের দাবির পক্ষে ভোট দিলে আমাদের বলার কিছু নেই।’
বিএনপি ৫ মে হেফাজতের অবরোধ ও মহাসমাবেশের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করেছিল। কিন্তু হেফাজতের ১৩ দফা দাবির প্রতি বিএনপির অবস্থান কী, তা এখনো স্পষ্ট করেনি। আমরা আশা করব, বিএনপি ১৩ দফা সম্পর্কে তাদের অবস্থান স্পষ্ট করবে। যদি ১৩ দফা তাদের পছন্দ হয়, তাহলে আগামী নির্বাচনে তারা এই দাবিগুলো নিয়ে ভোটারদের কাছে যেতে পারে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিকে দূরে সরিয়ে রেখে হেফাজতের পক্ষে রাজনীতি করতে গিয়ে বিএনপি নিজেদের ক্ষতি করছে না লাভ করছে, তা শিগগিরই তারা অনুভব করতে পারবে বলে মনে হয়। বিএনপির উচিত এখন আগামী নির্বাচন প্রশ্নে সরকারের সঙ্গে আলোচনায় বসে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিটি আদায়ের চেষ্টা করা। এবং এই আলোচনার জন্য কোনো পূর্বশর্ত আরোপ না করা। আলোচনার মাধ্যমেই তাদের দাবি আদায়ের চেষ্টা করতে হবে। বিএনপির অনেকের ধারণা, আন্দোলনের (হরতাল) মাধ্যমে দেশ অচল করে দিয়ে তারা দাবি আদায় করতে পারবে। হয়তো পারবে। হয়তো পারবে না। রাজনৈতিক আন্দোলন হিসেবে অবরোধ বা অবস্থান কর্মসূচিকে হেফাজত একেবারে পচিয়ে দিয়েছে। এই দুই অস্ত্র আর আন্দোলনে কাজে লাগবে বলে মনে হয় না। তা ছাড়া ঢাকার ব্যবসাকেন্দ্রবেষ্টিত মতিঝিলে আর রাজনৈতিক কর্মসূচির অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না। জনসভা বা অবস্থান কর্মসূচির জন্য এখন থেকে কোনো ময়দান বা মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে সরকার অনুমতি দিলে জনগণের স্বস্তি হবে। বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ, শাপলা চত্বর ও নয়াপল্টনে আর কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচির অনুমতি দিলে সরকার খুবই নিন্দিত হবে। দোকান, অফিস, ব্যাংকবেষ্টিত কোনো জনবহুল এলাকায় আর রাজনৈতিক কর্মসূচি করতে দেওয়া উচিত হবে না। গণতন্ত্র শুধু রাজনৈতিক দলের জন্য নয়; দোকানদার, ব্যবসায়ী, পথচারী, ক্রেতা-বিক্রেতা—সবার জন্য গণতন্ত্র নিশ্চিত করতে হবে। বর্তমান সরকার শুধু বিভিন্ন দল ও হেফাজতের গণতন্ত্র রক্ষা নিয়ে চিন্তিত, তা ঠিক নয়। জনগণের জীবন বিঘ্নিত করার কোনো অধিকার কোনো দল, গোষ্ঠী ও সরকারের নেই। জনগণের নির্বিঘ্ন জীবনকে সবার ওপরে স্থান দিতে হবে।
গত ৫ ও ৬ মে ঢাকার বুকে হেফাজত ও তাদের ছত্রচ্ছায়ায় আরও অনেক সন্ত্রাসী গোষ্ঠী যে তাণ্ডব চালিয়েছে, তাদের বিচারের মাধ্যমে শাস্তি প্রদান করা উচিত। তারা শাস্তি না পেলে ভবিষ্যতে এ রকম তাণ্ডব আরও হতে পারে। পুরানা পল্টন এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জন্য হেফাজতের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করা উচিত। হেফাজতকেই এই ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। কারণ, তাদের কর্মসূচিতেই এই তাণ্ডব ঘটেছে। তারা এই দায় অস্বীকার করতে পারে না। বহিরাগত কেউ তাণ্ডব চালালে তাদেরও শাস্তি পাওয়া উচিত। নিজেদের কর্মসূচির ওপর যদি হেফাজতের নিয়ন্ত্রণ না থাকে, তাহলে তার দায় তাদেরই নিতে হবে।
৬ মে ভোররাতে শাপলা চত্বরে যৌথ অপারেশনে বহু লোক হতাহত হয়েছে বলে হেফাজত ও বিএনপি দাবি করেছে। সরকার বলেছে, তেমন হতাহত হয়নি। অনেকের ধারণা, এত বড় অপারেশনে নিশ্চয় বেশ কিছু মানুষ মারা গেছে। এ ব্যাপারে যেহেতু বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে, সরকার এই বিষয়ে একটি বিচার বিভাগীয় বা সংসদীয় তদন্ত কমিশন গঠন করতে পারে। কমিশন প্রত্যক্ষদর্শী ও সব পক্ষের বক্তব্য ও প্রমাণ দেখে একটা শ্বেতপত্র প্রকাশ করবে। এটা ছাড়া হতাহতের সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক ও রাজনীতির অবসান হবে না। এই তদন্ত কমিশন দ্রুত গঠন জরুরি।
হেফাজত তাদের ১৩ দফা দাবি নিয়ে ঢাকায় একটা শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করতেই পারে। এপ্রিল মাসেও তারা তা করেছে। কিন্তু ‘অবরোধ কর্মসূচিকে’ আমরা গণতান্ত্রিক কর্মসূচি বলতে পারি না। এটা জনগণের বিরুদ্ধে অবস্থান। জনগণ তো এখানে কোনো পক্ষ নয়। হেফাজত তাদের দাবি জানাচ্ছে সরকারের প্রতি। সেই দাবি জানাতে গিয়ে হেফাজত ঢাকার দেড় কোটি লোককে একটি পুরো দিন অবরুদ্ধ করে রেখেছে। এটা গণতন্ত্র হতে পারে না। এটা দাবি আদায়ের গণতান্ত্রিক পথও হতে পারে না। সরকার কী করে এ ধরনের সন্ত্রাসী কর্মসূচিকে অনুমতি দিয়েছে, তা ভেবে অবাক হই। যেকোনো সমাবেশের জন্যও সময়সীমা নির্দিষ্ট করে দেওয়া উচিত। যেহেতু ময়দান বা জনবিরল রাজপথ জনগণকেও ব্যবহার করার সুযোগ দিতে হবে, সেহেতু প্রকাশ্য স্থানে ১২ ঘণ্টার বেশি কোনো সমাবেশের জন্য কোনো দল বা গোষ্ঠীকে অনুমতি দেওয়া উচিত হবে না। যেকোনো সমাবেশ কোনো টিভি চ্যানেল লাইভ প্রচার করতে পারবে। এটা ডিজিটাল যুগ। এই সুযোগে বাধা দেওয়া যাবে না। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সমাবেশস্থল ত্যাগ করতে হবে, এই শর্তে অনুমতি দিতে হবে। প্রয়োজন হলে এ জন্য ৫০ লাখ টাকা জামানত হিসেবে জমা রাখা যেতে পারে। নির্দিষ্ট সময়ে মাঠ না ছাড়লে এ টাকা বাজেয়াপ্ত হয়ে যাবে। ঢাকা বা যেকোনো শহরের ময়দানে বা রাজপথে অনির্দিষ্টকালের জন্য ‘অবস্থান কর্মসূচির’ অনুমতি দেওয়া উচিত নয়। এটা পাকিস্তান আমল নয়। পাকিস্তান আমলের মতো স্বাধীন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে একই স্টাইলে আন্দোলন হতে পারে না। ৫ ও ৬ মে তাণ্ডবের জন্য দোষী ব্যক্তিদের শাস্তি দিয়ে এবং তাদের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। রাজনৈতিক কর্মসূচির নামে জনগণের সম্পদ ধ্বংসে তাণ্ডব চলতে পারে না। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে ১৮-দলীয় জোট দেশে একটি শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করতেই পারে। পাশাপাশি তাদের সংলাপে বসার জন্যও চেষ্টা করতে হবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ জনগণের নিরাপত্তা ও জনমনে শান্তি। আমাদের দুটোই দেখতে হবে।
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: মিডিয়া ওউন্নয়নকর্মী।

No comments

Powered by Blogger.