শিশুপ্রহর ফাঁকা, বিকেলে উপচে পড়া ভিড় by শফিকুল ইসলাম

গতকাল দ্বিতীয় দিনের শিশুপ্রহরও জমেনি অমর একুশে গ্রন্থমেলায়। সকাল ১০টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত শিশুপ্রহর ঘোষণা করা হলেও শিশুদের সাড়া ছিল না গ্রন্থমেলায়।
স্টলে থাকা বিক্রেতারা জানিয়েছেন, ‘শিশুপ্রহর কী? এর কোনো চিহ্ন মেলায় ছিল না। কারণ সকালে রাজধানীর বিভিন্ন স্কুল খোলা ছিল। ফলে মেলাঙ্গনের বেশির ভাগ জায়গাই ছিল ফাঁকা।’ তবে বিকেলে গ্রন্থমেলা সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হলে মেলায় উপচে পড়া ভিড় লেগে যায়। শিশুরা তাদের বাবা-মায়ের হাত ধরে গ্রন্থমেলায় এসে আনন্দে ঘুরে বেড়িয়েছে। কিনেছে ভূতের গল্প, সায়েন্স ফিকশন ও চিত্রায়িত বর্ণমলার বই। গতকাল মেলার নবম দিনে মেলায় গিয়ে দেখা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি থেকে এবং দোয়েল চত্বর থেকে বইমেলায় প্রবেশপথ পর্যন্ত সব বয়সী নারী-পুরুষের উপচে পড়া ভিড়। শেষ বিকেলে বই বিক্রিতে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন প্রকাশকেরা।

শিশুপ্রহর ফাঁকা : অভিভাবকদের সাথে নিয়ে শিশুরা যেন স্বাচ্ছন্দ্যে বইমেলায় ঘুরতে পারে এবং বই কিনতে পারে এ জন্য চার দিন শিশুপ্রহরের ঘোষণা দিয়েছে বাংলা একাডেমী কর্তৃপক্ষ। কিন্তু গতকাল শিশুপ্রহরের দ্বিতীয় দিনেও শিশুদের তেমন উপস্থিতি ছিল না। ফলে মেলায় সকালে বিক্রিও বেশি হয়নি। ঐতিহ্য প্রকাশনীর স্টল ইনচার্জ আমজাদ হোসেন কাজল বলেন, মেলায় শিশুপ্রহর কী এর কোনো চিহ্ন আমরা মেলায় দেখিনি। তিনি বলেন, কোনো ধরনের প্রচারণা বা পূর্বঘোষণা ছাড়াই শিশুপ্রহর ঘোষণা করা ঠিক না। এ ছাড়া সকালে স্কুল খোলা থাকায় শিশুরা মেলায় আসেনি বলে তিনি মন্তব্য করেন। একই ধরনের মন্তব্য করেন আগামী প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী ওসমান গনি, জাগৃতি প্রকাশনীর ম্যানেজার মো: আলাউদ্দিন, অনুপমের মালিক মিলন কান্তি নাথসহ অনেকেই।

মিরপুর থেকে রফিকুর রহমান  ও শর্মিলা আক্তার দম্পতি শিশু রুকাইয়া রাব্বিকে নিয়ে মেলায় এসেছিলেন। তারা বলেন, ‘রাব্বি বায়না ধরায় আনিসুল হক রচিত ‘পাঁচ পরীর গল্প’ বই কিনেছেন।

উপচে পড়া ভিড় : গতকাল শনিবার ছিল সরকারি ছুটির দিন। ফলে মেলায় বিকেলের পর থেক বইপ্রেমী মানুষের ঢল নেমেছিল গ্রন্থমেলায়। রাজধানীর শাহবাগ মোড়ে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে বিরতিহীন আন্দোলনে উৎসুক জনতার সমাগম বাড়ছে। তবে আগন্তুকদের বেশির ভাগই আসছেন শাহবাগের পরিস্থিতি দেখতে। কেউ কেউ আন্দোলন দেখে হাততালি দিয়েই প্রস্থান করছেন। সেখান থেকে কিছু লোক বইমেলায় গিয়ে গল্প আর আড্ডায় সময় পার করছেন। মেলাঙ্গনে গিয়ে দেখা যায়, প্রচুর মানুষ বইয়ের স্টলে দাঁড়িয়ে নতুন বইয়ের পাতা উল্টাচ্ছেন। পছন্দ হলে বই কিনছেন তারা।

মেলায় এসেছিলেন দুই যুবক রায়হান কবীর পলাশ ও মো: আতিকুল ইসলাম। দু’জনেই বললেন, ‘মেলার পরিবেশ ভালো। নতুন বই ও নতুন লেখক মেলায় আসছে। তবে মেলার বাইরে রাস্তায় হকারদের সরাতে বাংলা একাডেমীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তারা।’

নেট বইয়ের ছড়াছড়ি : একুশে বইমেলার বাইরে রাস্তায় হকারেরা আরেক বারোয়ারি মেলা বসিয়েছে। বিভিন্ন ধরনের পণ্য তারা বিক্রি করছে। রাস্তার কোনো অংশ বাদ দেয়নি তারা। মাঝখানে বিক্রি করছে বিভিন্ন ধরনের পাইরেটেড ও নেট বই। নামীদামি লেখকের মূল্যবান বই ফটোকপি করে এক রেটে বিক্রি করছে তারা। এতে মেলায় আসা লোকজন একাডেমীর ভেতরে প্রবেশ না করেই স্বল্পমূল্যে বই কিনে চলে যাচ্ছেন। আগামী প্রকাশনীর প্রধান ওসমান গনি বলেন, ‘আমি হতাশ হয়েছি মেলার বাইরে রাস্তায় যেভাবে নকল বই বিক্রি হচ্ছে তা দেখে। গত শুক্রবার সন্ধ্যায় তসলিমা নাসরিনের অনেক বইয়ের নকল কপি তিনি জব্দ করে হকারকে তাড়িয়ে দিয়েছেন।’ যত দ্রুত সম্ভব বাংলা একাডেমীকে এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নেয়ার কথা বলেন তিনি।

গতকালের নতুন বই : শনিবার মেলার নবম দিনে মোট ১৬২টি নতুন বই প্রকাশিত হয়েছে। এসবের মধ্যে গল্প ১৫টি, উপন্যাস ৩০টি, প্রবন্ধ ১৬টি, কবিতা ২৮টি, গবেষণা ২টি, ছড়া ১০টি, শিশুতোষ ৫টি, জীবনী ৩টি, মুক্তিযুদ্ধ ৪টি, নাটক ২টি, বিজ্ঞান ৪টি, ভ্রমণ ৩টি, ইতিহাস ৪টি, রম্য ও ধাঁধা ৪টি, অনুবাদ ৩টি, সায়েন্স ফিকশন ২টি এবং অন্যান্য ২৪টি। নতুন সাতটি বইয়ের মোড়ক উন্মোচন হয়েছে।

নতুন বইয়ের মধ্যে শিকড় প্রকাশনী থেকে ড. আব্দুল লতিফ মাসুমের রাষ্ট্রনায়ক জিয়া, মহিউদ্দীন খান মোহনের হাওয়া ভবন ও অন্যান্য প্রসঙ্গ, সূচীপত্র থেকে মারুফ কামাল খানের কবিতার বই অসময়ের ফোঁড়, আগামী থেকে মাহবুব সিদ্দিকীর প্রকৃতি ও পরিবেশবিষয়ক বই আম, জাগৃতি থেকে তুষার আব্দুল্লাহর গণমাধ্যমবিষয়ক গ্রন্থ অফ এয়ার সিএসবি থেকে যমুনা, অনুপম থেকে ফারসীম মান্না মোহাম্মদীর বিজ্ঞানবিষয়ক নক্ষত্র, নিউরন ও ন্যানো, আদর্শ প্রকাশনী থেকে মনির জামানের উপন্যাস বাস্তুহারার দল, রওশন আরা মুক্তা রচিত অপ্রাপ্তবয়স্কা, ঐতিহ্য থেকে মাহবুব কবিরের সম্পাদিত গানের বই উকিল মুন্সির গান, রেজাউর রহমানের গল্পের বই তেরো তলার সিঁড়ি, মুরাদ পারভেজের কাব্যগ্রন্থ সুইসাইড নোট, সালাউদ্দীন বইঘর থেকে শামসুজ্জামান শামসের মহাকাশ ভ্রমণ ও নতুন টাইটানিক, মাহবুবুল ইসলাম লাভলু রচিত ভাঙাপথের রাঙা ধুলো ইত্যাদি।

মেলামঞ্চে গতকাল : অমর একুশে গ্রন্থমেলা উপলে গতকাল ১০টায় শিশু-কিশোর সাধারণ জ্ঞান ও উপস্থিত বক্তৃতা প্রতিযোগিতার প্রাথমিক বাছাই অনুষ্ঠিত হয়। এতে ২৫০ জন শিশু-কিশোর অংশগ্রহণ করে। বিচারক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন আলী ইমাম, আনজীর লিটন ও বায়তুল্লাহ কাদেরী।

বিকেল ৪টায় গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে ‘জন্মশতবর্ষে অদ্বৈত মল্লবর্মণ এবং আমাদের দায়’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন গবেষক শান্তনু কায়সার। আলোচনায় অংশ নেন কথাশিল্পী হরিশংকর জলদাস ও অধ্যাপক সফিকুন্নবী সামাদী। সভাপতিত্ব করেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কামাল লোহানী।

প্রাবন্ধিক বলেন, বাংলা সাহিত্যে নিম্নবর্গের মানুষের বিশ্বস্ত কথাকার ছিলেন অদ্বৈত মল্লবর্মণ। কেবল তিতাস একটি নদীর নাম উপন্যাস নয়, বরং তার অন্যান্য উপন্যাস, গল্প, প্রবন্ধ ইত্যাদির মধ্যে দলিত মানুষের স্বর ভাষা পেয়েছে। অদ্বৈত-পাঠ আমাদের মূলত সমৃদ্ধ প্রাচ্যসাহিত্য আস্বাদনের সুযোগ করে দেয়। আমাদের অখণ্ড আত্মপরিচয়ের সন্ধান পেতে অদ্বৈত মলবর্মণের মৃত্তিকালগ্ন সৃষ্টির কাছে ফিরে যেতে হবে।

আলোচকবৃন্দ বলেন, বাংলা সাহিত্যে অদ্বৈত মলবর্মণ স্থায়ী অবদান রেখে গেছেন। শুধু বিষয় নয়; কথাসাহিত্যিক কাঠামো ও ভাষারীতির দিক থেকেও তিনি বিশিষ্টতার দাবি রাখেন।

সন্ধ্যায় নীহার দে আকাশের পরিচালনায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশন করে সুরের আলো সঙ্গীত একাডেমি এবং মোহাম্মদ আলী হায়দারের নির্দেশনায় বটতলায় পরিবেশন করা হয় সামিনা লুৎফা নিত্রা রচিত নাটক ‘খনা’।

মেলামঞ্চে আজকের অনুষ্ঠান : আজ রোববার বিকেল ৪টায় গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে ‘আখতারুজ্জামান ইলিয়াস’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠিত হবে। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন এ. এম মাসুদুজ্জামান। আলোচনায় অংশ নেবেন, ফজলুল আলম, আবদুস সেলিম ও আহমাদ মোস্তফা কামাল। সভাপতিত্ব করবেন কবি বেলাল চৌধুরী।

No comments

Powered by Blogger.