এক বছরে লোপাট সাড়ে ৫০০ কোটি টাকা- সরকারি ব্যাংক বীমায় দুর্নীতি by সৈয়দ সামসুজ্জামান নীপু

নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে এক বছরে বিভিন্ন সরকারি ব্যাংক-বীমা থেকে লোপাট করা হয়েছে সাড়ে ৫০০ কোটি টাকা।
ক্ষমতার অপব্যবহার করে ফোর্সড লোন সৃষ্টি, যাচাই-বাছাই না করেই বিপুল ব্যাক-টু-ব্যাংক এলসি খোলা, কারণ ছাড়াই অতিরিক্ত ঋণ দেয়া, বন্ধ প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেয়া, পর্যাপ্ত জামানত ছাড়া ঋণ দেয়া, অনিয়মিতভাবে ঋণ দেয়া, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অবৈধভাবে সুযোগ-সুবিধা দেয়াসহ বিভিন্ন ধরনের দুর্নীতির মাধ্যমে এ বিপুল অর্থ লোপাট করা হয়েছে। বাংলাদেশ কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেলের কার্যালয়ের (সিজিএ) করা সর্বশেষ এক নিরীক্ষা প্রতিবেদনে এ তথ্য দেয়া হয়েছে। গত মাসে রাষ্ট্রপতি মো: জিল্লুর রহমানের কাছে এ প্রতিবেদনটি প্রদান করা হয়েছে।

সিজিএ প্রতিবেদন অনুযায়ী নিরীক্ষার বছর হিসেবে ধরা হয়েছে ২০০৯-২০১০ অর্থবছরকে। সরকারি মোট আটটি ব্যাংক ও বীমাপ্রতিষ্ঠানে এ অডিট চালানো হয়েছে। অডিট পরিচালিত ব্যাংকগুলোর মধ্যে রয়েছেÑ সোনালী ব্যাংক (বিবি অ্যাভিনিউ করপোরেট শাখা, স্থানীয় কার্যালয়, প্রধান কার্যালয়, চট্টগ্রামের লালদীঘি ও আগ্রাবাদ করপোরেট শাখা)। রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের জয়পুরহাট, নওগাঁ ও রংপুরের জোনাল অফিস। রূপালী ব্যাংকের বরিশাল সেন্ট্রাল বাস টারমিনাল শাখা, জিন্নাগড়, চড়ফ্যাসন ও লালমোহন শাখা। অগ্রণী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়। জনতা ব্যাংকের খুলনা খান এ সবুর রোড শাখা, চুয়াডাঙ্গা এরিয়া শাখা ও প্রধান কার্যালয় এবং বগুড়া এরিয়া শাখা ও পাবনা এরিয়া শাখা। বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের পাবনা শাখা। রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের প্রধান শাখা। সাধারণ বীমা করপোরেশনের প্রধান কার্যালয় ও ঢাকা জোনাল অফিস এবং জীবন বীমা করপোরেশনের প্রধান কার্যালয়।

উল্লেখযোগ্য কয়েকটি অনিয়ম : অডিট প্রতিবেদন অনুসারে আলোচ্য অর্থবছরে সবচেয়ে বড় চুরি বা অনিয়ম করে অর্থ লোপাট করা হয়েছে ‘ফোর্সড লোন’ সৃষ্টির মাধ্যমে। উল্লেখ করা হয়েছে, ‘ক্ষমতার অপব্যবহার করে প্রধান কার্যালয় কর্তৃক লিমিট (সীমা) অতিরিক্ত এলসি খুলে ফোর্সড লোন সৃষ্টির মাধ্যমে বিলমূল্য পরিশোধ এবং অনিয়মিতভাবে বিভিন্ন সুবিধা প্রদানের ফলে ব্যাংকের ক্ষতি হয়েছে ৮৫ কোটি ৫০ লাখ ৭৫ হাজার টাকা, যার পুরোটায় লোপাট করে দেয়া হয়েছে। কনসোর্টিয়াম লোন অ্যাগ্রিমেন্ট অনুযায়ী ঋণ বিতরণ করার কথা ছিল। কিন্তু তা করা হয়নি, দেয়া হয়েছে অতিরিক্ত ঋণ, বন্ধকী জমির পরিমাণও ছিল অপ্রতুল। ফলে ওয়ান গ্রুপের কাছে একটি সরকারি ব্যাংকের ঝুঁকিপূর্ণ দায় সৃষ্টি হয়েছে ৬৩ কোটি চার লাখ ২২ হাজার টাকা। এ ঋণ আর আদায় হওয়ার সম্ভাবনা নেই বলে জানা গেছে।

ত্রুটিপূর্ণ নীতামালার কারণে এবং ঋণের টাকা আদায়ের পক্ষে আইনগত দলিলাদি ও জামানতের অভাবে অপলোপনেরএক বছর অতিক্রান্ত হওয়া সত্ত্বেও ঋণের কোনো টাকাই আদায় হয়নি। এতে করে ব্যাংকের মোট পাওনা বা ক্ষতি হয়েছে ৪২ কোটি ৩০ লাখ ৯৭ হাজার টাকা। জয়েন্ট ভেঞ্চার অ্যাগ্রিমেন্ট না নিয়ে বিদেশীর নামে অনিয়মিতভাবে ঋণপত্র স্থাপন করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি দেউলিয়া ঘোষিত হওয়ার পর পিএডি দায় সৃষ্টি হয়েছে। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ঋণের বিপরীতে কোনো জামানতও রাখা হয়নি। বর্তমানে বিদেশী ঋণগ্রহীতার কোনো হদিসও পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে ঋণের ৪১ কোটি ৬৫ লাখ ৯ হাজার টাকার পুরোটাই মেরে দেয়া হয়েছে বলে অডিট প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

অডিট প্রতিবেদনে আরো বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। বলা হয়েছে, ফ্যাক্টরির উৎপাদনক্ষমতা যাচাই না করে এবং বারবার রফতানিতে ব্যর্থ হওয়া সত্ত্বেও অনিয়মিতভাবে পুনঃপুন ব্যাংক টু ব্যাক এলসি খোলা হয়েছে। এ এলসির পরিমাণ ৩৪ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। এ অর্থ আর পাওয়া সম্ভব হবে না। ফরেন বিল পারচেজ নিগোসিয়েশনের নামে বিদেশে পণ্য পাচার বা আত্মসাৎ, গ্রাহকের সাথে শাখা কর্তৃপক্ষের যোগসাজশে অনিয়মিত বিটিবি এলসি স্থাপনের মাধ্যমে ফোর্সড লোন সৃষ্টি করে ব্যাংকের ৩৩ কোটি ৬২ লাখ ৪৩ হাজার টাকার আত্মসাৎ করা হয়েছে। মেসার্স ফুয়াদ স্পিনিং মিলস নামে একটি প্রতিষ্ঠানকে দেয়া হয়েছিল প্রকল্প ঋণ। ঋণ পরিশোধে পুনঃপুন ব্যর্থ হওয়ার পর কোম্পানিকে পাঁচবার ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়েছে, তবুও ঋণ পরিশোধ করা হয়নি। এই ঋণের পরিমাণ ৩৭ কোটি ৯৬ লাখ ৭৪ হাজার টাকা। পুরোটাই লোপাট করে দেয়া হয়েছে। ঋণ দেয়া সংক্রান্ত বিধান অমান্য করে ক্ষমতাবহির্ভূত মেয়াদি আমানতের বিপরীতে সীমাতিরিক্ত ঋণ দেয়ায় ঘাটতি হয়েছে ৩০ কোটি ৭৬ লাখ ৪৫ হাজার টাকা। ভুয়া রফতানি এলসির বিপরীতে ফোর্সড লোন সৃষ্টি করে অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে ২৫ কোটি ৬১ লাখ ৮৬ হাজার টাকা।

দুর্নীতির আরো চিত্র দেয়া হয়েছে। প্লেজ গোডাউনের অস্তিত্ব নেই, বীমাদাবি আদায়ে শাখা কর্তৃপক্ষ ব্যর্থ, বারবার পুনঃতফসিলীকরণ সত্ত্বেও কিস্তির টাকা আদায়ে শাখা ব্যর্থ হয়েছে। ঋণের বিপরীতে গ্রাহকের কাছ থেকে অপ্রতুল জামানতও রাখা হয়েছে, এমনকি প্রতিষ্ঠানটি বন্ধও রয়েছে। কিন্তু এর মাধ্যমে লোপাট করে দেয়া হয়েছে ২০ কোটি ৫৪ লাখ ৩৯ হাজার টাকা।

এ ধরনের আরো কয়েয়টি দুর্নীতি ও অনিয়মের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে অডিট প্রতিবেদনে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অডিট বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেছেন, এটি দুর্নীতির একটি চিত্র হলেও তা পরিপূর্ণ চিত্র নয়। আরো বিশদ অডিট করা হলে আরো বড় রকমের অনিয়ম বের হয়ে আসার সম্ভাবনা রয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.