১২ ঘাটে চাঁদা দিয়ে টিকতে হয় ব্যবসায়ীদের by জিয়াউল হক মিজান

সারা দেশে নীরব চাঁদাবাজি চলছে বিভিন্ন সন্ত্রাসী গ্রুপ, রাজনৈতিক দল, সহযোগী ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন-সংস্থার নামে। তালিকায় রয়েছে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনাকারী বিভিন্ন সরকারি সংস্থা যেমন জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর,
পরিবেশ অধিদফতর, বিএসটিআই, ডেসা, ওয়াসা, তিতাস, রাজউক, সিটি করপোরেশন এবং র‌্যাব-পুলিশের নাম। চাঁদাবাজি চলছে পালিয়ে থাকা শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নামেও। অন্তত ১২ ঘাটে চাঁদা দিয়ে প্রতিষ্ঠান চালু রাখতে হচ্ছে ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের। ফলস্বরূপ উৎপাদন খরচ বাড়ছে, বাড়ছে মূল্যস্ফীতি, সামাজিক অস্থিরতা ও দ্রব্যমূল্য। বেশির ভাগ চাঁদাবাজিই চলছে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায়। তালিকায় দীর্ঘ অবস্থান নিয়ে আছে সরকারি সংস্থাগুলো। আর অরক্ষিত মহাসড়কগুলোয় চলছে মালবাহী ট্রাক ছিনতাইয়ের মহোৎসব।

বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের সাথে কথা বলে জানা যায়, সরকারি-বেসরকারি চাঁদাবাজদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে ব্যবসায়ী-শিল্পোদ্যোক্তারা। তার ওপর বিভিন্ন সরকারি সংস্থার উপর্যুপরি অভিযানকালে চাঁদা দিতে দিতে ফতুর হয়ে পড়ছেন তারা। ত্যক্তবিরক্ত এসব ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তা এখন ব্যবসা ছেড়ে পালানোর পথ খুঁজছেন। পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছেছে, চাঁদাবাজ-সন্ত্রাসী এসব ব্যক্তি, সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের নাম মুখে উচ্চারণ করারও তারা সাহস পাচ্ছেন না। জীবন ও সম্মান বাঁচাতে অনেকেই টাকার বিনিময়ে চাঁদাবাজদের সাথে আপস করতে বাধ্য হচ্ছেন বলেও জানা গেছে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, দেশের অর্থনীনৈতিক কর্মকাণ্ডের অন্যতম প্রধান কেন্দ্রস্থল সূত্রাপুর-কোতোয়ালির ব্যবসায়ীদের প্রতিদিনই মোটা অঙ্কের চাঁদা গুনতে হচ্ছে। মোটা অঙ্কের চাঁদা দিতে হচ্ছে রাজধানীর নতুন অংশে গড়ে ওঠা বিভিন্ন ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানকেও। রাজনৈতিক চাঁদাবাজদের পাশাপাশি বেপরোয়া চাঁদাবাজিতে লিপ্ত হয়েছে সঙ্ঘবদ্ধ সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোও। বিদেশে পালিয়ে থাকা শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নামে আদায় হচ্ছে কোটি কোটি টাকার চাঁদা। এ কাজে যুক্ত হয়েছে একশ্রেণীর মানবাধিকার কর্মী ও ভুয়া সাংবাদিকও। চাঁদাবাজির শিকার ব্যবসায়ীরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহযোগিতা তো পাচ্ছেনই না, উল্টো র‌্যাব-পুলিশকে জানানোর অপরাধে প্রাণ হারাতে হচ্ছে। পরিস্থিতি বুঝে বেশির ভাগ ব্যবসায়ীই বাধ্য হচ্ছেন গোপন লেনদেনের মাধ্যমে চাঁদাবাজদের সাথে আপসরফা করতে।

স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু ও পুলিশের আইজি হাসান মাহমুদ খন্দকারের উপস্থিতিতে এফবিসিসিআই আয়োজিত আইনশৃঙ্খলাবিষয়ক এক সেমিনারে বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি আমির হোসেন বলেন, প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে চাঁদাবাজি হচ্ছে। অপরাধের পরিমাণ এত বেড়েছে যে ব্যবসায়ীদের এখন গুলি খেয়ে রাস্তায় মরতে হয়। একই অনুষ্ঠানে কুরিয়ার সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন সভাপতি আবু নাসের বলেন, কাভার্ডভ্যানে পণ্য পরিবহন করতে নানাভাবে পুলিশ হয়রানি করে থাকে। এতে তারা পার্সেল নির্ধারিত সময়ে পৌঁছাতে পারছেন না। সুনামগঞ্জ চেম্বার সভাপতি খায়রুল হক চপল বলেন, সীমান্ত এলাকায় পুলিশের নাম ব্যবহার করে চাঁদাবাজি করা হচ্ছে। এসব অপরাধ বন্ধ করার জন্য তারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।

বিজিএমইএ পরিচালক মোহাম্মদ নাসির বলেন, ঢাকা থেকে তৈরী পোশাক নিয়ে যাত্রা শুরু করার পর প্রতিদিনই ট্রাকসহ পণ্য ছিনতাই হচ্ছে। এতে নির্ধারিত সময়ে পণ্য সরবরাহ করতে না পারার কারণে বায়ারদের কাছে দেশের সুনাম নষ্ট হচ্ছে। অনেক সময় বিমানবন্দর ও রেলওয়ে স্টেশনের আইসিডি থেকে আমদানিকৃত পণ্যও চুরি হচ্ছে বলে তিনি জানান। কাভার্ডভ্যান পরিবহন অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মকবুল আহমেদ বলেন, ফেনীসহ বেশ কয়েকটি জায়গায় কাভার্ডভ্যান থেকে গার্মেন্টপণ্য চুরি হচ্ছে। এসব এলাকার একটি সঙ্ঘবদ্ধ চক্র এখন সুতাও চুরি করতে শুরু করেছে।

রিরোলিং মিল মালিক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মাসুদুল আলম মাসুদ বলেন, রাস্তার মধ্য থেকে রডভর্তি ট্রাক ছিনতাই হচ্ছে। ডিসেম্বর মাসে এমন তিনটি ট্রাক ছিনতাই হয়েছে বলে তিনি জানান। এফবিসিসিআইয়ের পরিচালক মনোয়ারা হাকিম আলী বলেন, মহিলা উদ্যোক্তারা যখন কোনো অভিযোগ করতে থানায় যায় তখন তাদেরকে নানা বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। এ জন্য তিনি প্রতিটি থানায় মহিলাদের জন্য আলাদা বুথ স্থাপনের পরামর্শ দেন। যেখানে দায়িত্ব পালন করবে একজন মহিলা পুলিশ। এতে সহজে মহিলারা থানায় অভিযোগ করতে পারবেন বলে তিনি মনে করেন।

অভিযোগের জবাবে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু বলেন, শৃঙ্খলার যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে আমরা ক্ষমতায় এসেছি তা সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন করতে পারিনি। তবে আমরা চেষ্ট করছি। সময়ের স্বল্পতার কারণেও সব প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি বলে তিনি জানান। আইনশৃঙ্খলা উন্নয়নে সবার সহযোগিতা কামনা করে তিনি বলেন, পুলিশ বাহিনীর গুণগত মানোন্নয়নে সরকার কাজ করছে। পুলিশ মানুষের শত্রু নয়। আইনশৃঙ্খলা উন্নয়নে পুলিশকে আধুুনিক করতে হবে মন্তব্য করে তিনি বলেন, এর অংশ হিসেবে সারা দেশের থানাগুলোর অবকাঠামো উন্নয়নের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। একই সাথে পুলিশ বাহিনীর যাতায়াত সমস্যা দূূর করতে ৮৭৫টি গাড়ি ও চার হাজার মোটরসাইকেল কেনার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
       


No comments

Powered by Blogger.