বিশেষ পরিস্থিতির মুখোমুখি দেশ সর্বদলীয় বৈঠক ডাকার আহ্বান

কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের দ্বিবার্ষিক সম্মেলনের উদ্বোধনী পর্বে বক্তারা বলেছেন, দেশ এখন এক বিশেষ পরিস্থিতির মুখোমুখি।
সরকারকে শাহবাগে ‘গণজাগরণ মঞ্চ’ থেকে তারুণ্যের প্রতিবাদী কণ্ঠের উচ্চারণের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে দ্রুত এর একটি গ্রহণযোগ্য সমাধান বের করতে হবে। মঞ্চের চারপাশে সরকারি দলের লোকজন নানা ছদ্মবেশে ঘোরাফেরা করছে। এই আন্দোলনকে তারা তাদের পক্ষে নেয়ার চেষ্টা করছে। এ আন্দোলনকে কোনো মহল যেন রাজনীতিকীকরণ কিংবা দলীয়করণ করতে না পারে, তরুণ প্রজন্মকে এই ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। নতুন প্রজন্মের ঢেউ থেকে বার্তা নিয়ে সংবিধান, সংসদ, ট্রাইব্যুনাল ও আইনের সমন্বয় ঘটিয়ে দেশের রাজনীতিকদেরই এর সমাধান বের করতে হবে। এজন্য জরুরি ভিত্তিতে সর্বদলীয় বৈঠক ডেকে আলোচনায় বসার জন্য তারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।

গতকাল রাজধানীর রমনায় ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশ (আইইবি) চত্বরে অনুষ্ঠিত এ সম্মেলনে তারা এই আহ্বান জানান। কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর আবদুল কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে সাবেক রাষ্ট্রপতি, বিকল্পধারার প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ডা: এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী, স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলক জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডি সভাপতি আ স ম আব্দুর রব, জাতীয় পার্টি-জাপা মহাসচিব এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার এমপি, বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল নোমান, জাতীয় পার্টি-জেপি মহাসচিব শেখ শহীদুল ইসলাম, সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরী, ডাকসুর সাবেক ভিপি নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না, গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মহসীন মণ্টু, জেএসডির সাধারণ সম্পাদক আবদুল মালেক রতন, দলের সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান তালুকদার বীরপ্রতীক, কাদের সিদ্দিকীর স্ত্রী নাসরিন সিদ্দিকী ও বোন সেলিনা খান বক্তৃতা করেন। এ সময় জাপার প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ ও বিকল্পধারার মহাসচিব মেজর (অব:) আবদুল মান্নান উপস্থিত ছিলেন।

জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে কাউন্সিলের উদ্বোধন করা হয়। অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরী জাতীয় পতাকা ও বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম দলীয় পতাকা উত্তোলন করেন। এ সময় জাতীয় পার্টি-জেপি চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন মঞ্জু উপস্থিত ছিলেন।

বি. চৌধুরী বলেন, দেশ আজ চরম সঙ্কটের মুখোমুখি। শাহবাগে তারুণ্যের প্রতিবাদী কণ্ঠ জেগে উঠেছে। প্রতিবাদের ঢেউ মহাসাগরের ঢেউয়ে পরিণত হয়েছে। সারা দেশ আজ উত্তাল। ভয়েস অব পিপল, ভয়েস অব গড। জনতা যে সিদ্ধান্ত দেয় সেটি সরকারকে মানতেই হবে। সংবিধান, সংসদ, ট্রাইব্যুনাল, আইনÑ সবকিছুর সমন্বয়ে সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিতে হবে যেন দেশে শান্তি আসে। দেশ যেন সাংঘর্ষিক অবস্থায় চলে না যায়, সেজন্য জাতীয় দায়িত্ব থেকে প্রধানমন্ত্রীর উচিত অনতিবিলম্বে সব দলকে নিয়ে বসা। তিনি বলেন, শাহবাগের প্রজন্ম স্কয়ারকে আওয়ামী লীগ দলীয়করণ ও রাজনীতিকীকরণের চেষ্টা করছে। এটা করবেন না, করলে ভবিষ্যতে মুশকিল আছে। আপনারা যদি মনে করেন এ থেকে রাজনৈতিক ফায়দা নেবেন তাহলে মারাত্মক ভুল করবেন। কারণ ট্রাইব্যুনালের বিচারের পেছনে রাজনৈতিক আঁতাত আছে বলে লোকে মনে করছে। কিন্তু যারা হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করেছে তাদের ক্ষমা করা যায় না। তিনি বলেন, নিজেদের অধীনে নির্বাচন করার চেষ্টা করবেন না। করলে মস্তবড় ভুল করবেন। দলীয় সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন হবে না। এ ধরনের নির্বাচনের চেষ্টা করে দেশকে গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দেবেন না।

কাদের সিদ্দিকী বলেন, শাহবাগে সাধারণ মানুষ নিজ থেকে মেতেছে। শুধু রাজাকারদের নয়, যারা রাজাকার বানিয়েছে সেই বাবাদেরও ফাঁসি চাই। মন্ত্রিসভায় ‘রাজাকার’ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রেখে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা যায় না। মুক্তিযুদ্ধের সময় এখনকার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহিউদ্দীন খান আলমগীর ময়মনসিংহের এডিসি ছিলেন। তখন তিনি পাকিস্তান প্রশাসনের পক্ষে এবং বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কাজ করেছেন। তাই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদ থেকে তাকে বরখাস্ত ও গ্রেফতার করে রাজাকার হিসেবে তার বিচার করতে হবে, আমি তার বিরুদ্ধে আদালতে সাক্ষ্য দেবো। তেমনিভাবে মুক্তিযুদ্ধকালে টাঙ্গাইলের ডিসি থাকা আশিকুর রহমান এখন আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ। পািকস্তান প্রশাসনের এসব ‘দালাল’দেরও বিচার করতে হবে। তিনি বলেন, শাহবাগে নতুন প্রজন্মের দাবির প্রতি সম্পূর্ণ সমর্থন জানাই। তবে এই মঞ্চ যদি আওয়ামী লীগের ইশারায় পরিচালিত হয় তাহলে আমাদের সমর্থন নেই। সেখানে ‘জয়বাংলা’ স্লোগান চলছে, এর সাথে জয় বঙ্গবন্ধু স্লোগান থাকতে হবে। এটা ছিল মুক্তিযুদ্ধের সার্বজনীন স্লোগান; কিন্তু এখন আওয়ামী লীগ এটাকে দলীয় স্লোগান বানিয়ে ফেলেছে। আগামী সংসদ নির্বাচনকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য যদি এই খেলা হয় তাহলে জনগণ এর বিরুদ্ধে দাঁড়াবে। ব্যবসায়ী, বাটপার ও লুটেরাদের দখলে আজ জাতীয় সংসদ। গামছা (কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের নির্বাচনী প্রতীক) দিয়ে গলা পেঁচিয়ে তাদেরকে সেখান থেকে বের করে দিতে হবে। আওয়ামী লীগের উদ্দেশে তিনি বলেন, যদি জামায়াতের সাথে বিএনপি না যেত তাহলে আপনারা বিশ বছরেও ক্ষমতায় আসতে পারতেন না। বিএনপি মুক্তিযোদ্ধার দল, কিন্তু রাজাকারদের সাথে গিয়ে তারা নিজেরাও রাজাকার হয়ে গেছে। তাদের সঙ্গ না ছাড়লে জনগণ বিএনপির দিকে মুখ তুলে তাকাবে না।

আ স ম আব্দুর রব বলেন, দেশে এখন একটি বিশেষ পরিস্থিতি বিরাজ করছে। ‘জয়বাংলা’ স্লোগান কিভাবে এলো তা সিরাজুল আলম খান ও আমিসহ কয়েকজন ছাড়া আর কেউ জানে না। অথচ আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে এখন নিজ দলীয় স্বার্থে কাজে লাগাতে চায়। আমরা নতুন ধারার ও তৃতীয় রাজনৈতিক শক্তির জন্য রাজনীতি করছি। এ আন্দোলন সফল করতে জাতিকে ’৭১-এর মতো আবার ঐক্যবদ্ধ হতে হবে, আরেকটি মুক্তিযুদ্ধ করতে হবে।

আব্দুল্লাহ আল নোমান বলেন, আমরা এখন সর্বগ্রাসী মহাসঙ্কটে। এই সঙ্কট বিরোধী দলগুলো তৈরি করেনি, করেছে সরকার। দেশে এখন আইনের শাসন নেই, আছে দলীয় শাসন। শাসনের নামে চলছে শোষণ, নির্যাতন-নিপীড়ন। গণ-অভ্যুত্থান ও গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে এ ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন ঘটাতে জাতীয় ঐক্যের প্রয়োজন।

রুহুল আমিন হাওলাদার বলেন, মুক্তিযুদ্ধের পর রাজনৈতিক কারণে আমাদের মধ্যে মতপার্থক্য তৈরি হয়েছে। দু’টি দলের কারণে দেশের অগ্রগতি থেমে গেছে। এভাবে দেশ চলতে পারে না। শাহবাগের নতুন প্রজন্মের ঢল এবার জাতিকে আবার জাগিয়ে তুলেছে। দেশকে আরো অনেক ধাপ এগিয়ে নিতে আজ বিভেদ ভুলে জাতীয় ঐক্য দরকার। আগামীতে সবার অংশগ্রহণে এমন একটি নির্বাচন হতে হবে যা দেশে-বিদেশে গ্রহণযোগ্য হবে।

শেখ শহীদুল ইসলাম বলেন, দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, আইনশৃঙ্খলা, স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব সবকিছু নিয়েই আজ প্রশ্ন উঠেছে। শাহবাগ চত্বর প্রমাণ করে, আমরা এখন এগুলোর অনেক কিছুই হারাতে বসেছি। রাজনীতিবিদরা একে অপরকে বিশ্বাস করতে পারি না। যারা জাতীয় ঐক্যের কথা বলছেন তাদের বলবোÑ লুণ্ঠনকারীদের সাথে নিয়ে জাতীয় ঐক্য হয় না, এতে দেশের উন্নয়নও সম্ভব হয় না।

আবুল হাসান চৌধুরী পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্পে অনিয়মের সাথে নিজের সম্পৃক্ততা সম্পর্কে বলেন, কোনো মুরব্বি অনুরোধ জানালে কথা শোনা আমাদের সংস্কৃতি। সুতরাং এটা যদি অন্যায় হয়ে থাকে কিছু যায় আসে না। আমি প্রয়োজনে পাঁচ হাজার বার মুরব্বির কথা শুনবো।

মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, শাহবাগে সরকারি দলের লোকজন আনাগোনা করছে, যেন এই আন্দোলন তাদের বিপক্ষে না যায়। কেন কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় হলো না, এর জবাব কে দেবে। আওয়ামী লীগও যদি ফাঁসি চায় তাহলে রায় বদলে দেয়ার তরিকা কী? রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা বললেন, আপিল করা হবে, এটা ধোঁকাবাজি। অন্য দিকে বিএনপিও খুব হিসাবি কথা বলছে। তারা কী চায় তাও পরিষ্কার নয়। আসলে এই দু’টি দলের মোহ থেকে আমাদের মুক্ত হতে হবে। এই দু’টি দল আমাদের মুক্তির ভিসা দিতে পারবে না।

মোস্তফা মহসীন মণ্টু বলেন, শাহবাগে জাতীয় বিস্ফোরণ ঘটে গেছে। আমরা যারা রাজনীতি করি তারা দেয়ালের লিখন পড়ি না। নিজেদের রাজা ও সম্রাজ্ঞী মনে করি। কিন্তু শাহবাগে এবার নতুন প্রজন্ম দেখিয়ে দিয়েছে যে, যা খুশি তা করা যায় না। শাহবাগ থেকে শিক্ষা নিন।

আবদুল মালেক রতন বলেন, শাহবাগের মঞ্চের চারপাশে সরকারি দলের লোকজন নানা ছদ্মবেশে ঘোরাফেরা করছে। এই আন্দোলনকে তারা তাদের পক্ষে নেয়ার চেষ্টা করছে। এই ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে নতুন প্রজন্মকে সজাগ থাকতে হবে। কোনো দলের ইঙ্গিতে প্রতারিত হলে এই আন্দোলন বিফলে যাবে।

No comments

Powered by Blogger.