চিকিৎসার নামে এক নাপিত ডাক্তারের হাতে কিশোরীর জীবন বিপন্ন by এরশাদ আলী

পল্লীকবি জসীমউদ্দীন রচিত বাঙ্গালীর হাসির গল্প বইয়ের নাপিত ডাক্তারের মতো এক ডাক্তারের কথা জানা গেছে। তবে দু’য়ের মধ্যে একটু তফাত রয়েছে। নাপিত স্বপরিচয়ে অস্ত্রোপচার করতেন।
আর ইনি করেন আরেক ডাক্তারের নামে। নাপিতের ফোড়া অপারেশনে কোনো রোগীর অবস্থা খারাপ হয়েছিল কি না গল্পে তা লেখা নেই, কিন্তু আমাদের আলোচ্য ঘটনার রোগী অপারেশনের পরে মরতে বসেছিল। তাকে বাঁচাতে আরো বড় অপারেশন করতে হয়েছে। অপারেশনের পর রোগী খুলনা মহানগরীর একটি কিনিকে চিকিৎসাধীন রয়েছে। আর তার ভূমিহীন বাবা লাখখানেক টাকার দেনার দায়ে চোখে সর্ষেফুল দেখছেন।

মেয়েটির নাম সাবিনা। বয়স ১৪ বছর। সপ্তম শ্রেণীতে পড়ে। বাবা আলী মনসুর। তাদের বাড়ি যশোর জেলার কেশবপুর উপজেলার বেগমপুর গ্রামে। নভেম্বর মাসে তার এপেন্ডিসাইটিস শনাক্ত হয়। অপারেশনের জন্য কথা বলা হয় কেশবপুরের কপোতাক্ষ সার্জিক্যাল কিনিকে। তারা জানায়, খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের ডাক্তার আবুল কালাম আজাদ অস্ত্রোপচার করবেন। চুক্তি হয় দুই হাজার ৩০০ টাকায় অস্ত্রোপচার হবে। ২৭ নভেম্বর অপারেশন হয়। কিনিকের কাগজপত্রে সার্জনের নাম লেখা ডা: এ কে আজাদ এবং সহসার্জন ডা: ফিরোজ কবির (ডিএমএফ)। অস্ত্রোপচারের পর থেকে সাবিনার বমি শুরু হয় । এ অবস্থায় দুই দিন পরে তাকে কিনিক থেকে রিলিজ করে দেয়া হয়। অপারেশনকারী ডাক্তার কিনিকের গন্ধে বমি হচ্ছে, ওষুধ খেলে ঠিক হয়ে যাবে বলে আশ্বাস দেন। কিন্তু বাড়ি যাওয়ার পরও বমি বন্ধ হয়নি সাবিনার। উপরন্তু ক্ষতস্থান থেকে রক্তপাত শুরু হয়। ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি ওষুধ বদলে দেন। কিন্তু পরিস্থিতির অবনতি হতে থাকলে তাকে নেয়া হয় কেশবপুর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ডাক্তার জি কে এম শামসুজ্জামানের কাছে। তিনি ব্যয়বহুল হবে জানিয়ে দরিদ্র আলী মনসুরকে হাসপাতালে মেয়েকে ভর্তি করতে বলেন।

এরপর তিনি মেয়েকে নিয়ে আসেন খুলনায়। খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ও ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে একবার করে কয়েক দিন চিকিৎসা করেন বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা। অবস্থা ভালো দেখে বাড়ি পাঠানো হয়। খুমেক হাসপাতালে ভর্তি থাকার সময় তাদের দেখা হয় ডা: আবুল কালাম আজাদের সাথে। তখন তারা বুঝতে পারেন অপারেশন তিনি করেননি। করেছেন ফিরোজ কবির। হাসপাতাল থেকে বাড়ি গিয়ে সাবিনার আবার খারাপ অবস্থা হয়। এবার অবস্থা এমন হয় যে রাত ২টার সময় তাকে এনে খুমেক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পর দিন সার্জারি বিশেষজ্ঞ ডা: রফিকুল ইসলামের কিনিকে তার অপারেশন করা হয়। কারণ তিনি দয়াপরবশ হয়ে কম অর্থ নিতে রাজি হন এবং খুমেক হাসপাতালে সিরিয়াল পাওয়া যায়নি।

আলী মনসুরের দ্বিতীয় ছেলে বড়, মেয়েটি সবার ছোট। নসিছন চালিয়ে তার সংসার চলে। মাত্র তিন শতাংশ জমির ওপরে ঘর। মেয়ের চিকিৎসায় এ পর্যন্ত ৭০-৮০ হাজার টাকা ধারকর্জ করে ব্যয় হয়েছে। এখন এ টাকা শোধ দিতে ভিটেটুকু যাওয়ার আশঙ্কায় তিনি দিশেহারা। কিনিকে মেয়ের বেডের পাশে বসে তিনি জানান, ডাক্তার আজাদ অপারেশন করেননি জেনে ফিরোজ কবিরের সাথে কথা বলি। সে আমাদের ৫০০ টাকা দিয়ে ঘটনা চেপে যেতে বলে। তার কিছুই হবে না বলে সে সাফ জানিয়ে দিয়েছে। থানায় গিয়েছি। আমি গরিব মানুষ বলে কোনো গুরুত্বই দেয়নি পুলিশ। উকিলের সাথে কোর্টে মামলা করার জন্য কথা বলেছি। দেড় হাজার টাকা লাগবে। টাকা যোগাড় হচ্ছে না। মামলা না করার জন্য হুমকিও দেয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে ০১৭১৭১৯৭৭৪০ নম্বর মোবাইল ফোনে কথা হয় ফিরোজ কবিরের সাথে। তিনি কেশবপুরের সাগরদাঁড়ি পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রের সাব অ্যাসিস্টান্ট কমিউনিটি মেডিক্যাল অফিসার বলে নিজের পরিচয় দেন। তার বাড়ি বাগেরহাটের রামপাল। রামপাল খুলনার মেয়র ও আওয়ামী লীগের খুলনা মহানগর সভাপতির এলাকা। ফিরোজ বলেন, সাবিনার অপারেশন করেন ডা: আবুল কালাম আজাদ সাহেবই। আমি দেখাশোনা করেছি। এখন আমাকে দোষারোপ করা হচ্ছে। তার সাথে যোগাযোগ করে রোগীর আত্মীয়দের ৫০০ টাকা দেয়া এবং আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাদের দিয়ে ভয় দেখানোর অভিযোগ সম্পর্কে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ওরা বিএনপির গফুরকে দিয়ে আমার ওপর চাপ দিয়েছে।

খুমেক হাসপাতালের ডা: আজাদের সাথে কথা বলা হলে তিনি বলেন, আমি কেশবপুরে অপারেশন করি। তবে এটা আমি করিনি। ফিরোজ করেছে। সে আমার নাম ভাঙ্গিয়ে অনেক দিন এ কাজ করছে। তার শাস্তি হওয়া উচিত। ডা: আজাদের অবশ্য সার্জারির কোনো ডিপ্লোমা বা কোর্স করা নেই। তিনি এমবিবিএস ডিগ্রিধারী। পোস্টিং হাসপাতালের সার্জারি বিভাগে।

সাবিনার শেষ অপারেশনকারী ডা: রফিকুল ইসলাম জানান, এপেনডিক্স অপারেশনের সময় তার নাড়ি পেঁচিয়ে গিয়েছিল। এটাকে চিকিৎসার ভাষায় ইনটেস্টিনাল অবস্ট্রাকশন বলা হয়। এখন ভাগ্য ভালো হলে সে সুস্থ হয়ে যাবে।

No comments

Powered by Blogger.