ট্রাইব্যুনাল ভেঙে দিয়ে জাতিসঙ্ঘের তত্ত্বাবধানে গঠন করতে হবে

এই ট্রাইব্যুনাল বিতর্কিত। ট্রাইব্যুনালের ওপর কোনো পরেই আস্থা  নেই। এ ট্রাইব্যুনাল ভেঙে দিয়ে জাতিসঙ্ঘের তত্ত্বাবধানে নতুন ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হোক।
আন্তর্জাতিকভাবে এই ট্রাইব্যুনালের কোনো স্বীকৃতি নেই। সাম্প্রতিক সময়ে সিয়েরা লিয়ন ও যুগোস্লাভিয়ায় ট্রাইব্যুনাল হয়েছে। সর্বশেষ কম্বোডিয়ায় ট্রাইব্যুনাল হয়েছে। সেই ট্রাইব্যুনাল জাতিসঙ্ঘের তত্ত্বাবধানে হয়েছিল। এই ট্রাইব্যুনাল ভেঙে দিয়ে জাতিসঙ্ঘের অধীনে নতুন ট্রাইব্যুনাল করতে হবে।

গতকাল সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের অডিটোরিয়ামে মানবাধিকার সংস্থা ন্যাশনাল ফোরাম ফর প্রটেকশন অব হিউম্যান রাইটস আয়োজিত বিচার প্রশাসন ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা শীর্ষক সেমিনারে বক্তারা এ কথা বলেন। সংস্থার সভাপতি ও বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান সিনিয়র অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেনের সভাপতিত্বে এতে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ। বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর, বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী প্রফেসর ড. এমাজউদ্দীন আহমদ, সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রহমান। বক্তব্য রাখেন ঢাকা বার অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট টি এম আকবর ও ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল। সেমিনারে মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম।

রাজনৈতিক হস্তেেপর কারণে বিচারকেরা নিজের ইচ্ছামতো রায় দিতে পারছেন না : ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন, মইন উদ্দিন-ফখরুদ্দীনের আমলে বিচার বিভাগ যে অবস্থায় ছিল এখন তার চেয়েও খারাপ অবস্থায় আছে। আজকে রাজনৈতিক হস্তেেপর কারণে বিচারকেরা নিজের ইচ্ছামতো রায় দিতে পারছেন না। মইন-ফখরুলের আমলে বিচারব্যবস্থা পুরোপুরি সরকারের করায়ত্তে ছিল। তারই ধারাবাহিকতায় বর্তমান সরকার বিচারব্যবস্থা করায়ত্ত করার চেষ্টা করছে। এর থেকে মুক্তির একমাত্র পথ হলো দেশে গণতন্ত্র রা করা। তার জন্য সবচেয়ে প্রয়োজনীয় হলো আগামী নির্বাচন যেন সুষ্ঠু ও নিরপে হয় তা নিশ্চিত করা, যাতে মানুষ যাকে খুশি তাকে ভোট দিতে পারে। এই সুপ্রিম কোর্টকেও যদি নিরপে করতে চাই তাহলে আগামী নির্বাচন কেয়ারটেকার সরকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে হতে হবে।

ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ আরো বলেন, পঞ্চম সংশোধনী আর ত্রয়োদশ সংশোধনী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আদালতের মূল কাজ সমাজে শান্তি বজায় রাখা। এমন কোনো রায় দেয়া উচিত নয়, যাতে দেশে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হয়। পঞ্চম ও ত্রয়োদশ সংশোধনীর ওপর যে রায় দিয়েছেন তা উচ্চ আদালতের উচিত হয়নি। আপনারা কি সমাজের বিভক্তি বাড়ানোর জন্য রায় দিলেন? আমি বিচারক হলে সঙ্ঘাত কমানোর চেষ্টা করতাম। যখন স্বৈরতন্ত্র থাকে তখন এক রকম রায় আর যখন গণতান্ত্রিক সরকার থাকে তখন আরেক রকম রায়।  যে রায় প্রয়োগ করা যায় না সে রায় না দেয়াই ভালো। আমরা প্রবীণ হয়ে এসেছি চলে যাবো। আমি নবীনদের আনুরোধ করি যেন এসব বিষয়ে সতর্ক হন। যে বিচারক পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করেছেন তিনি ইমার্জেন্সি প্রভিশনকে সংবিধানের ওপরে স্থান দেয়ার রায় দিয়েছেন। একই ব্যক্তি দুই রকমের রায় দিচ্ছেন।

আমাদের মনে রাখতে হবে একজন সাধারণ মানুষ রাষ্ট্রের সামনে অসহায়। রাজউক যদি আপনাকে একটি নোটিশ দেয় তাহলে আপনাকে বিচারকের কাছে যেতে হবে। এখন কোর্ট যদি রাজউকের প নিয়ে নেয় তাহলে কিভাবে হয়। বিচারক নিয়োগ দেন সরকার, এটা হয়। কিন্তু যাকে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে তার তো যোগ্যতা থাকতে হবে। শপথ পড়ার পর তো দলের প্রতি আনুগত্য থাকার কথা নয়। এ সরকারের আমলে অনেক জাজ নিয়োগ হয়েছেন যারা ভালো জাজ। কিন্তু অনেকে আছেন যাদের আইনের চেয়ে দলের প্রতি আনুগত্য  বেশি। যে কারণে দিন দিন বিচার বিভাগ দুর্বল হয়ে পড়েছে।

ট্রাইব্যুনাল ভেঙে দিয়ে জাতিসঙ্ঘের অধীনে নতুন ট্রাইব্যুনাল করা  হোক : অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, বর্তমান যে অবস্থা তাতে বিচার বিভাগ ধ্বংস হতে চলেছে। আমি দীর্ঘ দিন সুপ্রিম কোর্টে ছিলাম আপনাদের সভাপতি হিসেবে। মওদুদ সাহেব যেমন বলেছেন সুপ্রিম কোর্ট যেমন আমাদের গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় দিয়েছে তেমন কলঙ্কজনক অধ্যায়ও দিয়েছে। আজকে রাস্তায় স্লোগান দেয়া হচ্ছে বিচারক কিভাবে রায় দেবেন।

আজকে একটি বিশেষ গোষ্ঠী ধুয়া তুলেছে যুদ্ধাপরাধীর বিচার চাই। এ বিচার আমিও চাই। কিন্তু বিচার যদি স্বচ্ছ আর আন্তর্জাতিক মানের না হয় তবে তা গ্রহণযোগ্য হবে না। আমরা প্রথমেই বলেছি এ ট্রাইব্যুনাল স্বচ্ছ নয়, নিরপে নয়। আজকে শাহবাগের তরুণ সমাজের অনুভূতির সাথে আমি একমত। কিন্তু তারা ফাঁসির যে দাবি করছেন তা সঠিক নয়। বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষ জানে এ ট্রাইব্যুনাল স্বচ্ছ নয়।

আমাদেরই একজন প্রধান বিচারপতি বলেছিলেন হাত-পা বেঁধে পানিতে ফেলে সাঁতার কাটতে বললে চলবে না। বর্তমান অবস্থা  সে রকম। আন্তর্জাতিকভাবে এই ট্রাইব্যুনালের কোনো স্বীকৃতি নেই। আপনারা জানেন সিয়েরা লিয়নে এ ট্রাইব্যুনাল হয়েছে, যুগোস্লাভিয়ায় ট্রাইব্যুনাল হয়েছে। সর্বশেষ কম্বোডিয়ায় ট্রাইব্যুনাল হয়েছে। সেই ট্রাইব্যুনাল কারা করেছিল? জাতিসঙ্ঘের তত্ত্বাবধানে হয়েছিল। এই ট্রাইব্যুনাল ভেঙে দিয়ে জাতিসঙ্ঘের অধীনে নতুন ট্রাইব্যুনাল করা হোক।

আমরা ’৭৩ সালে ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীকে শনাক্ত করেছিলাম। আমি তখন ঢাকা অঞ্চলের চিফ প্রসিকিউটর ছিলাম। তাদের বিচারের জন্য আমাদের সংবিধানে প্রথম সংশোধন আনা হয়েছিল। আমার দাবি তাদের বিচারের জন্য আনুন। না হলে তাদের প্রতীকী বিচার করা  হোক। আজকে শাহবাগের তরুণেরা যে স্লোগান দিচ্ছে তা বাস্তবায়ন হবে যদি জাতিসঙ্ঘের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল গঠন হয়।

শাহবাগে যে নাটকীয়তা চলছে তা স্বতঃস্ফূর্ত বলে মনে হয় না, এটি ম্যানেজড এবং অরগানাইজড বলেই মনে হয় : ড. এমাজউদ্দীন আহমদ বলেন, ক’দিন ধরে শহবাগে যে নাটকীয়তা চলছে তা স্বতঃস্ফূর্ত বলে মনে হয় না। এটি ম্যানেজড এবং অরগানাইজড বলেই মনে হয়। বর্তমান মতাসীন সরকার সব  েেত্র ব্যর্থ হয়েছে। গত চার বছরে যে দিকে তাকানো যায় সবই ব্যর্থতা। শেয়ারবাজার, হলমার্ক, পদ্মা সেতু দুর্নীতি এখন এ বিষয়গুলো থেকে সাধারণ মানুষের দৃষ্টি সরিয়ে অন্য দিকে নিয়ে আসা ছাড়া আর কিছুই নয় এই প্রতিবাদ।

যখন আদালত থেকে কোনো রায় দেয়া হয় তা বদলাতে হলে একটি সুষ্ঠু প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে করতে হবে। কিছু মানুষ কী বলল তাতে বিচারকের রায় পাল্টে দেয়া হবে এমন হতে পারে না। যখন দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা এমন কথা বলেন তখন তাদের প্রতি করুণা প্রকাশ করা ছাড়া কিছু থাকে না।

বিচার বিভাগের ওপর জনগণের মাধ্যমে চাপ প্রয়োগ করা যায় না। জনপ্রতিনিধিদের ওপর চাপ প্রয়োগ করা যায়, নির্বাহী বিভাগের ওপর চাপ প্রয়োগ করা যায়, কিন্তু বিচার বিভাগকে কোনোভাবেই চাপ  দেয়া যায় না। এটা কোথাও হয় না।

ড. এমাজউদ্দীন আহমদ আরো বলেন, গণতান্ত্রিক শাসন পরিপূর্ণতা লাভ করে না যতণ না পর্যন্ত আইনের শাসন থাকে। আর বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে কাজ করতে না পারলে তা সম্ভব নয়। দলীয় পর্যায়ে শিক নিয়োগ একটি ঘৃণ্য বিষয়। এর ফলাফল বোঝা যাবে আরো বিশ বছর পর। আরেকটি েেত্র দলীয়করণ ঘৃণ্য। সেটি হলো বিচারব্যবস্থা। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বলেছে, আমাদের বিচার বিভাগ দুর্নীতিগ্রস্ত। বিচার বিভাগকে যদি স্বাধীন করতে না পারি তবে উন্নত গণতান্ত্রিক সমাজ হতে পারে না। এটি মানুষের শেষ ভরসাস্থল।

শাহবাগে যে কী হচ্ছে তা আর বোঝার বাকি নেই, সব কিছুর বক্তব্য দেয়ার পর জয় বাংলা স্লোগান দেয়া হচ্ছে : অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন বলেন, শাহবাগে যে কী হচ্ছে তা আর বোঝার বাকি নেই। সবকিছুর শেষে বক্তৃতা শেষে জয় বাংলা।

আমাদের একজন প্রখ্যাত আইনজীবী সিরাজুল হক সাহেবের সন্তান ইদানীং বিভিন্ন মিডিয়ায় বলছেন, এখনো সুযোগ আছে মৃত্যুদণ্ড  দেয়ার। একজন আইনজীবী কিভাবে এমন কথা বলতে পারেন তা আমার বোধগম্য নয়।

আমাদের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবকে হাইকোর্ট একটা মামলায় জামিন  দেন আর দুইটা মামলায় তাকে গ্রেফতার দেখানো হয়। বর্তমান বিচারব্যবস্থা আসলে চালাচ্ছেন একজন প্রতিমন্ত্রী। মন্ত্রী বলেছেন,  কোর্টের রায় কিছু করার নেই। কিন্তু প্রতিমন্ত্রী বলছেন না, আরো চাপ দিতে হবে। এই চাপ দেয়ার জন্যই এই শাহবাগ।

আমরা শুনেছি বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে। এখন পুরো বিচারব্যবস্থা নিভৃতে কাঁদে। আমরা যারা আইন পেশায় নিয়োজিত তারা আন্দোলন করেছি। আজকে বিচারব্যবস্থা যে ঠিকমতো চলতে পারছে না তা প্রকাশ করার জন্য ধন্যবাদ বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম এবং আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে। তিনি এটি প্রকাশ করে দেশকে বাঁচিয়েছেন এবং বিচার বিভাগের  ভেতর  যে  ভূত ঢুকেছে তা জাতির কাছে স্পষ্ট করেছেন।

সব প্রক্রিয়াই অন্য দিকে ডাইভার্ট করার প্রক্রিয়া কি না : ড. তারেক শামসুর রহমান বলেন, বিশ্বব্যাপী অকুপাই মুভমেন্ট হচ্ছে। এটা হতে পারে। কিন্তু শাহবাগের কিছু বিষয় অস্পষ্ট। নিউ ইয়র্কে মানুষ ধনী-দরিদ্রের বৈষম্যবিরোধী। কিন্তু শাহবাগে কী হচ্ছে? মানুষের জীবনে অনেক সমস্যা। কিন্তু শাহবাগে তা উত্থাপিত হচ্ছে না। মামলায় একটা রায় হয়েছে। এটার একটা আপিল হতে পারে। কিন্তু এভাবে হাজার হাজার মানুষ নিয়ে রায় পরিবর্তিত হতে বলা কি আদালত অবমাননা নয়?

তিনি বলেন, সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি, পদ্মা সেতু, হলমার্ক,  শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির কোনো প্রতিবাদ নেই। প্রজন্ম চত্বরে তা অনুপস্থিত। আমি পত্রিকায় দেখেছি যারা সেখানে বক্তৃতা দেয় তারা একটা রাজনৈতিক দলের সাথে জড়িত। এতে মনে হচ্ছে সব প্রক্রিয়াই অন্য দিকে ডাইভার্ট করার প্রক্রিয়া কি না।

ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল বলেন, ট্রাইব্যুনাল একজনকে যাবজ্জীবন সাজা দিয়েছেন কিন্তু শাহবাগ থেকে তাকে ফাঁসি দিতে বলা হচ্ছে। এটা বিচার বিভাগকে আক্রমণ করার শামিল।
       


No comments

Powered by Blogger.