শাহবাগে আন্দোলন চলছে- নয়া দিগন্ত ও আমার দেশ পত্রিকায় আগুন

যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি এবং জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করাসহ বিভিন্ন দাবিতে পাঁচ দিন ধরে রাজধানীর শাহবাগ মোড়ে আন্দোলন চলছে।
প্রতিদিনের মতো গতকালও সকাল থেকে বিভিন্ন স্কুল, কলেজ ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষার্থীরা দলবেঁধে আন্দোলনে যোগ দেন। সকাল ৮টার দিকে বাম ছাত্র সংগঠনের নেতৃত্বে শুরু হয় বিভিন্ন ধরনের স্লোগান। তালে তালে অংশগ্রহণকারীরা সুর মিলান। চলতে থাকে প্রতিবাদী গানসহ অন্যান্য পরিবেশনা। সন্ধ্যায় জ্বালানো হয় অসংখ্য মোমবাতি। ধারাবাহিক অবরোধের পঞ্চম দিনে সকাল থেকেই আন্দোলন শুরু হয়। বেলা বাড়ার সাথে সাথে জনসমাগম আরো বৃদ্ধি পায়। যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে আন্দোলনকারীরা।

এ দিকে আন্দোলনকারীরা দৈনিক নয়া দিগন্ত ও দৈনিক আমার দেশ পত্রিকায় আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। এ ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের একজন শিকও পত্রিকা দু’টিতে আগুন দিয়েছেন বলে জানা গেছে। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিকেরা তীব্র ােভ প্রকাশ করেছেন।

প্রসঙ্গত গত মঙ্গলবার বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে আটক জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিলে ওই দিন থেকেই ‘ব্লগার অ্যান্ড অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট নেটওয়ার্ক’ এ আন্দোলন শুরু করে। এর পর থেকে রাজধানীর শাহবাগ মোড় অবরোধ করে আন্দোলন চলছে।

বামপন্থী ব্লগারদের মাধ্যমে আন্দোলন শুরু হলেও মতাসীন আওয়ামী লীগ ও বাম দলগুলোর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের ব্যাপক উপস্থিতি দেখা যায় শাহবাগের চলমান আন্দোলনে। তবে আন্দোলনের সাথে সংহতি জানাতে এসে আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকে অবরোধমঞ্চে লাঞ্ছিত করা হয়। বাম ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা তাদের লক্ষ্য করে পানির বোতল ছুড়ে মারেন। আওয়ামী লীগ নেতাদের অবরোধ মঞ্চে বক্তব্য দিতে বাধা দেয়া হলেও বাম দলগুলোর অনেক নেতা কয়েকদিন ধরেই অনায়াসে বক্তব্য দিচ্ছেন। গতকালের আন্দোলনে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় ও বিশ্ববিদ্যালয় শাখার শীর্ষ নেতারা উপস্থিত ছিলেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যানেক্স ভবনের শিক লাউঞ্জে একজন শিক দৈনিক নয়া দিগন্ত এবং দৈনিক আমার দেশ পত্রিকা পুড়িয়েছেন বলে জানা গেছে। ওই শিকের নাম চন্দ্রনাথ পোদ্দার। তিনি গণিত বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক। তিনতলা থেকে তিনি পত্রিকা দু’টি সংগ্রহ করে নিচতলায় প্রকাশ্যে আগুন ধরিয়ে দেন বলে সূত্র জানায়। এ ঘটনা স্বীকার করে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক ােভ প্রকাশ করে বলেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক এ ধরনের ঘৃণ্য কাজ করতে পারেন না।

গতকাল অবরোধকারীরাও নয়া দিগন্ত ও আমার দেশ পত্রিকা পুড়িয়ে প্রতিবাদ জানান। তারা হকারদের কাছ থেকে পত্রিকা সংগ্রহ করে শাহবাগের অবরোধস্থলে আগুন ধরিয়ে দেন। এ সময় তারা পত্রিকা দু’টির বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের স্লোগান দেন।

অবরোধ আন্দোলন শুরুর প্রথম দিকে কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবি জানানো হয়। পরে এর সাথে এখন আরো কিছু দাবি যোগ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ‘জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করা, দৈনিক নয়া দিগন্ত, দৈনিক আমার দেশ, দিগন্ত টিভি, দৈনিক সংগ্রাম, ইসলামী ব্যাংক, ইবনে সিনা, সোনার বাংলা ব্লগ বন্ধ করা।’ এ ছাড়া বিভিন্ন সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান জামায়াতের অভিহিত করে তার সেবা বন্ধ করাও তাদের দাবিতে পরিণত হয়েছে।

এ দিকে রাজধানীর অন্যতম ব্যস্ত সড়ক শাহবাগ মোড়ে অবরোধের কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দোয়েল চত্বর থেকে রূপসী বাংলা হোটেল এবং মৎস্যভবন থেকে কাঁটাবন মসজিদ পর্যন্ত রাস্তা বন্ধ করে দেয় আইনশৃঙ্খলা রাকারী বাহিনী। ফলে শাহবাগ মোড় এলাকা দিয়ে চলাচলকারী যানবাহনগুলো বিকল্প রাস্তা ব্যবহার করে চলাচল করছে। অবরোধকারীদের সুবিধার্থে ঢাকা ওয়াসা বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করছে। পাশাপাশি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে পুরুষ ও মহিলাদের জন্য আলাদা অস্থায়ী টয়লেটের ব্যবস্থা করেছে।

গত কয়েক দিনের মতো আন্দোলনস্থলে গতকালও সারা দিনই বিভিন্ন বাম সংগঠনের পে থেকে ব্যানার ও মিছিলসহকারে আসতে দেখা যায়। তারা যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে বিভিন্ন ধরনের স্লোগান দিতে থাকে। বিভিন্ন স্কুল, কলেজ ও বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজের শিার্থীরাও অবরোধে অংশ নেন।

গতকাল সন্ধ্যায় ছয় হাজার ৮০০ মোমবাতি প্রজ্বলনের মাধ্যমে সন্ধ্যার আন্দোলন কর্মসূচি পালন শুরু হয়। এ ছাড়া দেশের ৬৪ জেলায়ও একই কর্মসূচির অংশ হিসেবে মোমবাতি জ্বালানো হয় বলে জানা গেছে।

গতকাল সকাল থেকেই বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র ও অন্যান্য অনুষঙ্গ নিয়ে আন্দোলনকার্যক্রম চলে। আন্দোলনকারীরা বিভিন্ন ধরনের স্লোগানে মুখরিত করে রাখে পুরো শাহবাগ এলাকা। চলতে থাকে ধারাবাহিক প্রতিবাদী গান। পাশাপাশি চলছে গণস্বার সংগ্রহ কর্মসূচি। এ ছাড়া বিভিন্ন সংগঠনের প থেকে শাহবাগের অবরোধস্থলে নানা কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে।

শাহবাগ অবরোধ কর্মসূচির পঞ্চম দিনেও বিভিন্ন ব্যক্তি এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের প থেকে আন্দোলনে সংহতি জানানো হয়। এর মধ্যে রয়েছেÑ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমিরিটাস অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান, বাংলা বিভাগের অধ্যাপক রফিক উল্লাহ খান, কবি শাহানা জেসমিন প্রমুখ। এ ছাড়া বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের অনেকে আন্দোলনকারীদের সাথে সংহতি জানাতে আসতে পারেন বলে জানা গেছে। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত শাহবাগ মোড়ের অবরোধ কর্মসূচি চলবে বলে আন্দোলনকারীরা আগেই ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন।

এ দিকে গতকাল শাহবাগের অবরোধ কর্মসূচিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের শিকেরা সংহতি প্রকাশ করেন। তারা একত্রিতভাবে সেখানে আন্দোলনে সংহতি প্রকাশ করেন এবং দাবির সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেন। শিকদের সাথে বেশ কয়েকজন শিার্থীও অংশ নেন। আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী কয়েকজন অসুস্থও হয়ে পড়েন। তাদের হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।

চট্টগ্রামে অবস্থান অব্যাহত : চট্টগ্রাম ব্যুরো জানায়, যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির চট্টগ্রাম প্রেস কাব চত্বরে অবস্থান অব্যাহত রয়েছে। সকাল ১০টার দিকে প্রেস কাবের সামনে চতুর্থ দিনের মতো শুরু হয় সমাবেশ। সারা দিন চলে জাগরণী গান, কবিতা আবৃত্তি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি জানিয়ে উপস্থিত অনেকে প্ল্যাকার্ড, ফেস্টুন ও ব্যানার প্রদর্শন করেন।

আন্দোলনকারীরা বলছেন, মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে লড়াই চালিয়ে যাব। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত ঘরে ফিরবেন না বলে জানান আন্দোলনকারীরা।

জামাল খান রোডে উভয় দিকে ঢোকার দুই মুখেই ব্যারিকেড বসিয়ে যান চলাচল বন্ধ করে দেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। জামাল খান সড়ক চার দিন ধরে আন্দোলনকারীদের দখলে রয়েছে, যে কারণে ওই সড়ক দিয়ে যাতায়াতকারীরা দুর্ভোগে পড়েছেন। সমাবেশে বাদ্যযন্ত্র ও বড় বড় মাইক বাজানোয় ড. খাস্তগীর সরকারি হাইস্কুল, আইইউবি, এ জি চার্জ স্কুলসহ বিভিন্ন শিাপ্রতিষ্ঠানের শিার্থীরা বেকায়দায় পড়ে। তাদের পাঠদান বিঘিœত ঘটে। এ ছাড়া জামাল খান সড়কে অবস্থানরত বেশ কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতাল ও কিনিকে আসা রোগীরা দুর্ভোগে পড়েন। অতিরিক্ত শব্দদূষণে জামাল খান এলাকার পরিবেশ বাস অযোগ্য হয়ে উঠেছে।

বরগুনায় নয়া দিগন্ত ও আমার দেশ পত্রিকায় অগ্নিসংযোগ করে যুবলীগ-ছাত্রলীগের উল্লাস : বরিশাল ব্যুরো জানায়, বরগুনায় নয়া দিগন্ত ও আমার দেশ পত্রিকার সব বান্ডিলে অগ্নিসংযোগ করেছে যুবলীগ ও ছাত্রলীগের ক্যাডারেরা। গতকাল বেলা ১টায় জাতীয় পত্রিকাবাহী গাড়ি বরগুনা বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছলে পূর্ব থেকে অবস্থান নেয়া বরগুনা জেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক সাহাবুদ্দিন সাবুর নেতৃত্বে যুবলীগ ও ছাত্রলীগ ক্যাডারেরা পাঁচটি পত্রিকা এজেন্সির সব পত্রিকায় নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। একপর্যায়ে তারা নয়া দিগন্ত ও আমার দেশ পত্রিকার সব কপি লুট করে বরগুনা টাউন হলের সামনে প্রকাশ্যে অগ্নিসংযোগ করে উল্লাস করতে থাকে। যেসব এজেন্সির পত্রিকা লুট হয়েছে সেগুলো হচ্ছেÑ মায়ের দোয়া পেপার এজেন্সি, গ্লোব পেপার এজেন্সি, শাপলা পেপার এজেন্সি, রাকিব পেপার এজেন্সি ও এনায়েত পেপার এজেন্সি।

No comments

Powered by Blogger.