পদ্মার নিঃসঙ্গ ভেলায় by ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী

বাংলা সাহিত্যের এক বিশাল দিকপাল সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় মনসামঙ্গল কাব্যের কিংবদন্তি ব্যবহার করে লিখেছিলেন যে, ‘জীবনের নিঃসঙ্গ ভেলায়, বেহুলাও নেই সাথে/লখিন্দর একা ভেসে যায়।’
মনসামঙ্গল  কাব্য পূর্ববাংলার অন্তজ শ্রেণীর মানুষের দ্রোহের কাব্য। এ অঞ্চলের মানুষ কতটা প্রতিবাদী, কতটা প্রতিরোধী, কতটা আত্মমর্যাদাসম্পন্ন, এ কাব্য বিশ্লেষণ করলে তার স্বরূপ উন্মোচিত হতে পারে। ড. আবদুল হাননান এ বিষয়ে গবেষণা করে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন। সেটা পূর্ব বাংলা তথা বাংলাদেশের মানুষের জীবন-প্রকৃতির বিশ্লেষণ। হাননান আমার অতি স্নেহভাজন। সরকারি চাকরি করতেন। এখনো করেন কি না জানি না। আমার এই প্রশংসায় তার কোনো ক্ষতি হবে কি না, তা-ও বলতে পারি না। কারণ সরকার ভয়ঙ্কর।

মনসামঙ্গল অন্তজ শ্রেণীর মানুষের বিদ্রোহের কাব্য। বাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে অন্তজ শ্রেণীর মানুষের যে বিজয় এই কাব্যে তাই বিধৃত। অন্তজ শ্রেণীর মানুষের দেবতা মনসা। বাহ্মণকে সেই দেবতার পূজা করতে বাধ্য করেছিল অন্তজরা। মনসার ক্ষোভে লখিন্দরের লোহার বাসরেও ছিদ্র তৈরি করা হয়েছিল। সেই ছিদ্রের মধ্য দিয়ে মনসার এক প্রতিনিধি বাসরে ঢুকে লখিন্দরকে দংশন করেছিল। মারা গিয়েছিল লখিন্দর। তার পরও তাকে ভেলায় নিয়ে বেহুলা পাতালে মনসার মন জয় করতে গিয়েছিল তার স্বামীর জীবন ফিরে পেতে। সে কাহিনী লম্বা।

আধুনিক কবি-ঔপন্যাসিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তার কবিতায় লিখেছেন, ‘জীবনের নিঃসঙ্গ ভেলায়, বেহুলাও নেই সাথে/লখিন্দর একা ভেসে যায়।’ অর্থাৎ আধুনিক মানুষ চিরন্তন একাকী। বেহুলা তো তবু মনসা দেবীর আসরে গিয়ে নেচে-গেয়ে তাদের মনোরঞ্জন করে লখিন্দরের জীবন ফিরিয়ে এনেছিল। কিন্তু আধুনিক মানুষ নিরন্তর একাকী। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আধুনিক মানুষের সেই নিঃসঙ্গতাকেই সম্ভবত লিপিবদ্ধ করতে চেয়েছিলেন। ফলে বেহুলাকেও তিনি বাদ দিয়েছেন। মৃত লখিন্দর একা ভেসে যাচ্ছে। আশাহত। কেউ তার পাশে নেই।

আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আধুনিক মানুষ। অ-নে-ক উচ্চশিক্ষিত। যদিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি তার সামান্যই। ফলে পিএইচডি তিনি উপহার হিসেবে পেয়েছেন বা সংগ্রহ করেছেন। এত সব কিছু করে তিনি বড় বেশি নিঃসঙ্গ হয়ে গেছেন। এ নিয়ে আধুনিক মানুষের সম্ভবত কোনো ক্ষোভ থাকার কথা নয়। ভেলার ওপর শুয়ে দিকহীন লখিন্দর যেমন একা ভেসে যাচ্ছিল, তেমনি একা ভেসে যাচ্ছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার টনটনে সাহিত্যজ্ঞান আছে। তিনি নানা সময়েই ভুলভাল হলেও আমাদের কবিতা আবৃত্তি করে শোনান। অন্য কার কী ধারণা জানি না, আমি খুব এনজয় করি। একজন প্রধানমন্ত্রী আমাদের ঐতিহ্যের কবিতা আবৃত্তি করতে পারেন। এর চেয়ে আনন্দের কিছু নেই।

পদ্মা সেতু নিয়ে যে মহাকেলেঙ্কারির ঘটনা তার সরকার ঘটিয়েছে, তা পৃথিবীর ইতিহাসে খুব কমই ঘটেছে। অন্তত ঘটেছে কি না এমন আমার জানা নেই। কোনো দেশের প্রধানমন্ত্রী কোনো দুর্নীতিবাজের পক্ষে এমন কঠোর অবস্থান নিয়ে গোটা দেশের ভবিষ্যৎ সঙ্কটাপন্ন করে তুলতে পারেন, এমন উদাহরণ পৃথিবীতে শেখ হাসিনা ব্যতীত আর একটিও নেই। পদ্মা সেতুতে ঋণদানের প্রধান অংশীদার ছিল বিশ্বব্যাংক। সহযোগী ছিল এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), জাপানি উন্নয়ন সংস্থা (জাইকা) ও ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক (আইডিবি)।

পদ্মা সেতুতে তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের দুর্নীতি ধরা পড়ে বিশ্বব্যাংকের কাছে। বিশ্বব্যাংক শর্ত দেয় যে, সৈয়দ আবুল হোসেনকে দুর্নীতির দায়ে আইনের আওতায় আনতে হবে এবং তার বিচার করতে হবে। বিশ্বব্যাংকের এই ঘোষণায় শেখ হাসিনা মনসার মতো একেবারে ফণা তুলে দাঁড়ালেন। কী যে বললেন এবং কী যে বললেন না, সে বিষয়ে তার সুস্পষ্ট ধারণা ছিল কি না, সেটা বলাও মুশকিল। কিন্তু সৈয়দ আবুল হোসেনকে বিশ্বব্যাংক যখন দুর্নীতিবাজ বলল এবং তাকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে বলল, তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একেবারে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন।

তিনি বলতে গেলে কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে বলেই ফেললেন, বিশ্বব্যাংকই বিরাট দুর্নীতিবাজ প্রতিষ্ঠান। এবং আশ্চর্য ঘটনা এই যে, তিনি বিশ্বব্যাংককে অডিট রিপোর্ট তার কাছে জমা দেয়ার জন্য বিশ্বব্যাংককে নির্দেশ দিয়ে বসলেন। কোনো মানুষ কাণ্ডজ্ঞান হারালে যা হয়, এটা তাই। তিনি বললেন, সৈয়দ আবুল হোসেন সাঙ্ঘাতিক কাজ করেছেন, তিনি প্রশংসার যোগ্য। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ? এ-ও কি সহ্য করা যায়? সহ্য করেননি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

পদ্মা সেতু এমন কিছু নয়। এটা তার একটি নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি মাত্র। তিনি যেসব নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তার কোনোটাই রক্ষা হয়নি। কোনোটাই বাস্তবায়ন করতে পারেননি। দশ টাকা কেজি চাল খাওয়াবেন। বিনামূল্যে কৃষককে সার দেবেন। বিরতিহীন বিদ্যুতে গোটা দেশ হাসবে। প্রতি পরিবারে অনন্ত একজনকে চাকরি দেবেন। প্রশাসনকে দলীয়করণ না করে যোগ্যতার ভিত্তিতে পরিচালনা করবেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিরপেক্ষভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ করবেনÑ এমন অসংখ্য প্রতিশ্রুতি তিনি দিয়েছিলেন। এমনকি কারওয়ান বাজারের এক জনসভায় তিনি বলেছিলেনÑ আমাকে নির্বাচিত করুন, আপনারা যা যা চান, তার সব কিছুই দেয়া হবে। সেভাবেই তিনি পদ্মা সেতু নির্মাণ করবেনÑ এমন একটি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কাজও বেশ এগিয়ে গিয়েছিল। নকশা প্রণয়ন, পদ্মা সেতুর ভেতর রেল সংযোগÑ আরো কত কী। আমরা স্বপ্নচোখে সেই ছবি এখন পত্রপত্রিকায় দেখি। পদ্মা সেতু স্বপ্নঘোর। এখন সেটি স্বপ্নঘোরেরও অধিক হয়েছে।

যে আবুলকে নিয়ে বিশ্বব্যাংকের এত আপত্তি, সে আবুলের পক্ষে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিদেশের মাটিতে বলেছেন যে, আবুল এক মহান দেশপ্রেমিক। তার বিরুদ্ধে তিনি ব্যবস্থা নেবেন কেন? আর বিশ্বব্যাংকও তাদের অডিট রিপোর্ট শেখ হাসিনার কাছে জমা দেয়নি। বিশ্বব্যাংকেরও ঔদ্ধত্যের একটা সীমা থাকা উচিত। তিনি ‘জাতির জনক বঙ্গবন্ধু’র কন্যা। তাকে অর্ডার দেয়ার অধিকার কি বিশ্বব্যাংকের আছে? এরপর বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে তিনি যা খুশি তাই বলে গেলেন।

তার পর একে একে দেউটি নিভে গেছে। বিশ্বব্যাংক চূড়ান্তভাবেই পদ্মা সেতুতে তাদের আকাক্সা অনুযায়ী দুর্নীতির তদন্ত না হলে ফিরে যাওয়ার যে ঘোষণা দিয়েছিল, সে অনুযায়ী সরে গেছে। বিশ্বব্যাংককে অনুসরণ করে এডিবি ও জাইকাও সরে গেছে ঋণচুক্তি থেকে। কোনো কোনো অর্থনীতিবিদ ভবিষ্যদ্বাণী করছিলেন যে, সবাই গেলেও ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক (আইডিবি) পদ্মা সেতুতে অর্থায়নের জন্য রয়ে যাবে। কিন্তু দেখা গেল আইডিবিও সরে গেছে। ইতোমধ্যে আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক, জাইকার অন্যান্য প্রকল্পেরও বেহাল অবস্থা। সারা বিশ্বের বিনিয়োগকারী দেশ ও সংস্থাগুলোর ধারণা সৃষ্টি হয়েছে যে, বাংলাদেশ সরকার পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারগুলোর একটি। ফলে এখানে সাবধান। এ কারণেই চালু প্রকল্পগুলোর ব্যাপারেও তারা অনেক বেশি সতর্ক ও সন্দিহান। সব ক্ষেত্রে নজরদারি আরো জোরদার করা হয়েছে। ফলে সরকার দুর্নীতিতে যে ফ্রি স্টাইল চালাছিল, সেই ফ্রি স্টাইল ভাবটি আর রাখা সম্ভব হচ্ছে না।

আর প্রতিশোধপরায়ণ প্রধানমন্ত্রী উষ্টা খেতে খেতে এক চমকপ্রদ কথা হুট করে বলে বসেন। তা হলো, কেউ যদি না আসে তবে আমরা আমাদের নিজস্ব অর্থেই পদ্মা সেতু বানাব। প্রকল্পগুলো সম্পন্ন করব। এমন ছেলেভুলানো গপ্প এ যুগে খুব কমই হয়ে থাকে। পদ্মা সেতু তৈরিতে প্রয়োজন হবে ২৪ হাজার কোটি টাকা। তার জন্য সরকার এক দানবাক্স খুলেছিল। পত্রপত্রিকার রিপোর্টে দেখা গেল সে দানবাক্সে ইতোমধ্যে মাত্র দুই লাখ টাকা জমা পড়েছে। চাচা, ঢাকা কত দূর? এখনো পর্যন্ত আওয়ামী লীগের কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন একমাত্র মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলছেন যে, বিদেশী সহায়তা ছাড়া পদ্মা সেতু নির্মাণ অসম্ভব।

আর তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর এ ধরনের ফুটানি চলে না। ফুটানি যে চলবে না, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাঁ পল সার্ত্রে তার এক নাটকে লিখেছিলেন, এক কমিউনিস্ট নেতা নির্বাচনের আগে ঘোষণা করেন যে, তিনি যদি নির্বাচিত হন, তাহলে কয়লাখনি জাতীয়করণ করবেন। সে খনির মালিকানা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের হাতে। দারিদ্র্যপীড়িত ছেঁড়া জামা, ছেঁড়া জুতার নাগরিকেরা বড় বেশি খুশি হয়ে উঠেছিলেন। সেই কমিউনিস্ট নেতাকে তারা বিপুল ভোটে জয় লাভ করিয়েছিলেন। ওই কমিউনিস্ট নেতা যখন শপথ নিয়ে প্রেসিডেন্ট ভবনে উঠলেন, স্থির হয়ে বসেনওনিÑ এমন সময় তার এক বার্তাবাহক এসে খবর দিলেন যে মার্কিন রাষ্ট্রদূত তার সাক্ষাৎপ্রার্থী। তিনি তাকে ডাকলেন। ভদ্রলোক অতি বিনয়ের সাথে তাকে যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে অভিনন্দন জানালেন। জানিয়েই বললেন, ইওর এক্সেলেন্সি, আপনি ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, নির্বাচিত হলে কয়লাখনি জাতীয়করণ করবেন। আমি যুক্তরাষ্ট্র সরকারের পক্ষ থেকে আপনাকে জানাতে এসেছি যে, যদি আপনি সত্যি সত্যি সে ধরনের ঘোষণা দেন, তাহলে আমাদের সেনাবাহিনী আপনার রাষ্ট্রের চার দিক ঘেরাও করে আছে। তারা প্রেসিডেন্ট ভবনসহ সব স্থাপনা তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেবে। আপনার কল্যাণ কামনা করি। এই পরিস্থিতিতে একেবারেই স্তম্ভিত ও বিমূঢ় হয়ে পড়লেন কমিউনিস্ট নেতা। ঘরময় কিছুক্ষণ পায়চারি করলেন। তারপর অসহায় ভঙ্গিতে চিৎকার করে আদেশ দিলেন, ‘গিভ মি এ গ্লাস অব হুইস্কি।’

কম্পুচিয়ার সাবেক শাসক পল পট বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেছিলেন। এটি নাটক নয়। বাস্তবের ঘটনা। ক্ষমতা দখল করেই তিনি ঘোষণা করেছিলেন, কম্পুচিয়া আর কোনো বিদেশী ঋণ নেবে না। কম্পুচিয়ার সাধারণ মানুষের জন্য কেরোসিন তেল ছাড়া আর কিছু আমদানি করার প্রয়োজন নেই। অল্প কিছু শহুরে মধ্যবিত্তের জন্য সরকারকে বৈদেশিক ঋণের ওপর নির্ভরশীল হতে হয়। তাই কম্পুচিয়ায় শহরেরও প্রয়োজন নেই। শহরগুলো ভেঙে দিয়ে তিনি এই সব মানুষকে গ্রামে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন। কারখানার দক্ষ শ্রমিক রাতারাতি দিনমজুর হয়েছিল। একইভাবে পদস্থ আমলারাও যেতে বাধ্য হন গ্রামে মাটি কাটতে। তছনছ হয়ে যায় গোটা কম্পুচিয়া। তার এই পদক্ষেপের অবাধ্যদের বিরুদ্ধে তিনি হেন কোনো নিষ্ঠুর পদক্ষেপ নেই যা গ্রহণ করেননি। আর শেষ পর্যন্ত ইতিহাসের অমোঘ নিয়মে যা ঘটার তাই ঘটেছিল। পল পট এক ঘৃণিত ও নিষ্ঠুর শাসক হিসেবে ইতিহাসে স্থান পেয়েছেন।

শেখ হাসিনার  রাজিৈনতক স্বপ্ন পদ্মায় ডুবেছে। এখন তিনি পদ্মায় কলাগাছের ভেলায় নিতান্তই একা। বিশ্বব্যাংক, এডিবি, জাইকা, আইডিবি সবাই সরে গেছে। তিনি ভেসে যাচ্ছেন একা।

লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক

rezwansiddiqui@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.