সিডনির মেলব্যাগ- প্রিয় কাগজ ও প্রিয় বইমেলা by অজয় দাস গুপ্ত

জনকণ্ঠ অফিসে পৌঁছানোর পর প্রতিবারের মতো এবারও সুখদ অনুভূতিতে মন ভরে গেল। অনায়াস পাড়ি দেয়ার সামান্যতম পথও দুঃসাধ্যের ঢাকা এক যান দৈত্যের শহর, বেড়াজাল ছিন্ন করে গনত্মব্যে পেঁৗছানো যেমনি কানত্মিকর তেমনি কঠিন।
এ যাত্রায় ভ্রমণ আনন্দদায়ক যতটা ততটাই পরিশ্রমের। সেই কবে সিডনি ছেড়ে এসেছি। কুয়ালালামপুর, সিয়ামরিন, নমপেন, ব্যাঙ্কক হয়ে ঢাকায়। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা গেলেও বিশ্রামের বিকল্প নেই। শুধু জার্নি নয়, নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগ, সদা সতর্ক স্নায়ু আর স্নায়ুযুদ্ধে দেহমনের অবসন্নতা একেবারেই স্বাভাবিক। এত সব ঝক্কি-ঝামেলা ভুলিয়ে দিতে যথেষ্ট জনকণ্ঠে অভ্যর্থনার দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মচারীর হাসিমুখ। একবার চোখ বুলিয়েই বলে দিলেন 'আপনি তো সিডনি থেইক্যা আইছেন? যান উপরে যান।' উপরে পৌঁছানোর জন্যেই যাওয়া। এ পত্রিকার সঙ্গে লেখার যোগাযোগ তো বটেই আত্মারও একটা সম্পর্ক আছে, সে অভিন্ন বন্ধনের নেপথ্য নায়ক জনাব আতিকুলস্নাহ খান মাসুদ। অভিভাবকতুল্য উপদেষ্টা সম্পাদক কিংবদনত্মি সাংবাদিক জনাব তোয়াব খানের সঙ্গে সাৰাত না করে ঢাকা ত্যাগ? আমার জন্যে সে হবে গুরম্নতর পাপ। শুভাথর্ী স্বদেশ দা তো আছেনই।
অনত্মরের টানে এক মধ্যাহ্নে গিয়ে হানা দিলাম। শেষবার যখন জনকণ্ঠে এসেছিলাম, তখন তার সর্বত্র ভয়ের ছাপ। অচেনা, ভুতুরে বাড়ির মতো বিশাল ভবনটিকে মনে হচ্ছিল একাত্তরের ভয়ার্ত কোন ভবন। একদিকে সমরাস্ত্র সজ্জিত পোশাকী রৰীদল। অন্যদিকে বিষণ্ন ও ভয় মাখানো চেহারার জনকণ্ঠ পরিবার। এক এগারো নামের পরিবর্তনকারীরা এ কাগাজটিকে নিমর্ূল করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল। সংবাদপত্র ও গণতন্ত্রের মধ্যেকার বন্ধন পছন্দ করত না তাঁরা, ফলে পছন্দমতো কাগজ ব্যতীত অন্যদের ওপর নেমে এসেছিল আক্রমণের খড়গ। এখনও মনে আছে ঢাকার অনেক প্রথিতযশা সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী বন্ধুরা সায় দিতে পারেননি। কেউ চোখ তুলে প্রশ্নমাখা দৃষ্টি ছুড়ে জানতে চেয়েছিলেন, 'জনকণ্ঠে যাবেন? আপনি নিশ্চিত তো?'
উত্তর দেয়ার প্রয়োজন বোধ করিনি। তবে আমি নিশ্চিত ছিলাম যে আমি যাচ্ছি। গিয়েছিও। সে সময়কালের সঙ্গে তুলনা করলে এখন সে আবার জীবনত্ম ও প্রাণময়, ডেস্কে কর্মরত বন্ধুরা আগের মতো কর্মচঞ্চল। বিক্রি অথবা প্রচার সংখ্যায় শীর্ষে নেই বটে, তার অবস্থান এক এগারোর কালো অধ্যায় পেরিয়ে আবারও আলোর মুখে।
মনে পড়ছিল সিডনির প্রতিবাদমুখর সমর্থনের অতীত, অধুনালুপ্ত সোনার বাংলা পত্রিকা আয়োজিত সমাবেশটিতে সিডনি প্রবাসী বাঙালীর ঢল নেমেছিল, আদর্শ ও ভালবাসার টানে ছুটে এসে ছিলেন তাঁরা, একটাই চাওয়া, জনকণ্ঠ যেন অব্যাহত গতিতে চলতে থাকে। মনে পড়ে হতাশা ও আতঙ্কে উদ্বিগ্ন প্রবাসীদের ভয় তাড়াতে বলেছিলাম। আদর্শ যার সঙ্গী, তার মৃতু্য নেই। ধ্বংসসত্মূপ থেকেও সে ফিনিক্স পাখির মতো উড়ে দাঁড়ানোর শক্তি রাখে। সে বক্তব্য যিনি সংবাদ আকারে পাঠিয়েছিলেন সে রিপোর্টারও আজ কাগজটির সাথে নেই অথবা থাকতে পারেননি। তাতে কি জনকণ্ঠ ফের মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে।

দুই.
ঢাকার বইমেলাটি নিয়ে লেখালেখি, আলোচনার বিরাম নেই। রেডিও, টিভি, ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় অহরহ চলছে সে প্রক্রিয়া। এ লেখাটি যখন বেরম্নবে বইমেলা যাবে ফুরিয়ে। দেশবাসীর আশা-আকাঙ্ৰার পাশাপাশি আনত্মর্জাতিক বাঙালী তথা বাংলাদেশীদেরও ভরসাস্থল এই বইমেলা। এর পরিকাঠামো বা অবকাঠামো নিয়ে ভাবনা-চিনত্মার প্রয়োজন। এখন অবদি যা হচ্ছে তার সঙ্গে আবেগ-অনুভূতি যতটা যৌক্তিকতা ততটা পরিলৰিত হচ্ছে না। মেলায় ঢোকার পথে দীর্ঘ লাইন, একটি মাত্র সিকিউরিটি দরজা, নিম্নমানের নিরাপত্তা নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের ব্যবহার দেখে বিস্মিত হয়েছি। অনতিবিলম্বে এসব বিষয়ে তদারকির বিকল্প নেই। মনে হচ্ছে এমন একসময় আসন্ন বইমেলার দশনার্থীরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়েও বাড়ি ফিরে যেতে বাধ্য হবেন। পানীয় জলের অব্যবস্থা তাৎৰণিক চিকিৎসার অপ্রতুলতায়ও বিস্মিত হয়েছি। মেলা প্রাঙ্গণে ঘুরে বেড়ানো দেশবরেণ্য চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মীদের সহযোগিতায় এ কাজটি করা কঠিন কিছু নয়। তারস্বরে বই প্রকাশের অবিরাম ঘোষণার বিরতিও শব্দদূষণ প্রতিরোধে সাহায্য করতে পারে। বাংলা একাডেমী এই গুরম্ন দায়িত্ব পালন করবেন নাকি এর জন্যে অন্যান্য সংস্থাকে জড়িত করবে সেটা তাদের বিবেচনা। তবে মহাপরিচালকের সত্য ভাষণ ভাল লেগেছে। জনাকীর্ণ মেলাটিকে আবেগ আর ভালবাসার বাইরে যুক্তি দিয়ে দেখেছেন বলেই বৃহত্তর অঙ্গনে নেয়ার কথা তুলেছেন তিনি। একে মুক্তচিনত্মা দিয়ে দেখলেই মঙ্গল। জনবহুল রাজধানীর বৃহত্তম বইমেলাটি বড় উদ্যানে জায়গা নিলে তর্ক তোলার কারণ দেখি না।
সবশেষে বইয়ের কথায় ফিরে আসি, বই বের হওয়াটা অবশ্যই সুলৰণ। যশপ্রত্যাশী তরম্নণ-তরম্নণী, নবীন লেখক-লেখিকার মুখ ঢেকে যাওয়া বইপত্রে বাংলাদেশের শিহরণ নিশ্চয়ই গৌরবের। কিন্তু অতিপ্রজ লেখকদের সাবধানতাও এখন প্রয়োজনীয়, তারপরও বই হচ্ছে হবে। শেষ করব জনকণ্ঠের প্রসঙ্গ দিয়ে। মেলায় এসেছে বন্ধু ছড়াকার লুৎফর রহমান রিটনের ছড়া সমগ্র দুই। মুখবন্ধে যশস্বী রিটন জনকণ্ঠের চুতরঙ্গ ও উপদেষ্টা সম্পাদক তোয়াব খানের জন্য তার শ্রদ্ধা উগরে দিতে কার্পণ্য করেননি। কারণ? চতুরঙ্গই প্রথম সম্পাদকীয় পাতা যা ছড়াকে আশ্রয় দিয়েছে, পুষ্ট করে তুলতে সাহয্য করেছে। মাভৈর! পত্রিকার পাতা, পত্রিকাও তার ভূমিকা তো এভাবেই ইতিহাস হয়। বেঁচে থাকে বাঙালীর মননে।

ফধংমঁঢ়ঃধধলড়ু@যড়ঃসধরষ.পড়স

No comments

Powered by Blogger.