জন-আন্দোলন ও জনকষ্ট by মে. জে. (অব:) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম

বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ভারত এক সময় একটিমাত্র রাজনৈতিক ভূখণ্ড ছিল (ইংরেজিতে : ওয়ান পলিটিক্যাল এনটিটি)।১৯৪৭ সালের আগস্টের ঘটনার আগে এর নাম ছিল ব্রিটিশ ভারত।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান ও ভারত নামে আলাদা দু’টি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। কেন পাকিস্তান সৃষ্টি হয়েছিল বা কেন একটি রাজনৈতিক ভূখণ্ড টিকে থাকেনি, সেই আলোচনা এই কলামের মুখ্য বিষয় নয়। এতটুকু বলাই যথেষ্ট যে, পাকিস্তান নামে রাষ্ট্রে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ ছিলেন মুসলমান তথা দ্বীন ইসলামের অনুসারী। সেই পাকিস্তানে দুইটি প্রদেশ ছিল; পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তান। জনসংখ্যার দিক থেকে পূর্ব পাকিস্তান ছিল গরিষ্ঠ। ধর্মীয় আঙ্গিকে পূর্ব পাকিস্তানে ১৫ শতাংশের কিঞ্চিৎ বেশি ছিল হিন্দু ধর্মাবলম্বী। অপরপে পাকিস্তানে সংখ্যালঘু ধর্মাবলম্বী ৫ শতাংশের নিচে ছিল। পাকিস্তান রাষ্ট্রটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ায় স্বাভাবিক কামনা ছিল যে, রাষ্ট্র ইসলামের মূল ভিত্তিগুলো মেনে চলবে। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ইসলামের মূল ভিত্তি কী কী তার তালিকা উপস্থাপন করছি না। কিন্তু নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, জনগণের অংশীদারিত্বের গণতন্ত্র এবং সুষম অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড অবশ্যই ইসলাম অনুমোদিত ভিত্তিগুলোর অন্যতম। পাকিস্তানে ইসলামের অনেক মূলনীতি লঙ্ঘিত হয়েছিল। লঙ্ঘিত ওইরূপ মূলনীতির মধ্যে মাত্র দু’টি উল্লেখ করছি। প্রথমে বলব, পূর্ব পাকিস্তানের মানুষকে তাদের মাতৃভাষা থেকে বিচ্যুত করার ষড়যন্ত্র এবং দ্বিতীয়ত, অর্থনৈতিকভাবে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে বঞ্চিত করা।

শুধু মুখে মুখে ভ্রাতৃত্ববোধ দেখালে সমাজ ও রাষ্ট্র যে টেকে না, তার উদাহরণ পাকিস্তান। মুখে মুখে দ্বীন ইসলামের প্রশংসা করলে সমাজ টেকে না, তার উদাহরণ পাকিস্তান। নির্যাতন, বঞ্চনা, শোষণ এবং গণতান্ত্রিক প্রতিবাদ কার্যক্রমেও বাধা ইত্যাদি যখন চরম পর্যায়ে পৌঁছায় তখন মুক্তিযুদ্ধ অনিবার্য হয়ে উঠেছিল। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালেও পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী হইচই ফেলে দিয়েছিল এই বলে যে, পাকিস্তান যদি ভেঙে যায় তাহলে এই ভূখণ্ডে দ্বীন ইসলাম বিপন্ন হবে। অতএব, ইসলামকে রা করার জন্য বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ দমন করতেই হবে। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর এই ধারণা ও মনোভাব যে কত বড় ভুল ছিল, সেটা ইতিহাস স্যা দিচ্ছে। পাকিস্তান রাষ্ট্রটি এই মুহূর্ত পর্যন্ত জাতীয় নিরাপত্তার আঙ্গিকে স্থিতিশীল নয়Ñ এটাই বাস্তবতা। আমার দৃষ্টিতে, এর অনেক কারণ আছে। সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে, ১৯৭১ সালের পূর্বেকার পাকিস্তানে ইসলামের শাশ্বত শান্তির এবং ধৈর্যের বাণী যেমন নীরবে নিভৃতে কাঁদত, তেমনি এখনো কাঁদছে বলে অনুভব করি। ১৯৭১ সালের আগের পাকিস্তান নামে রাষ্ট্রে সামাজিক ও অর্থনৈতিক েেত্র সুবিচার ও সুষমতা কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ ছিল।

গত এক-দুই বছর ধরে পাকিস্তানে বিভিন্ন প্রকারের ঘটনা চমক সৃষ্টি করেই যাচ্ছে। পাঁচ-ছয় মাস আগে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। প্রধানমন্ত্রী গিলানির পদত্যাগের পর নতুন প্রধানমন্ত্রী হলেন রাজা পারভেজ আশরাফ। ১০-১২ দিন আগে সুপ্রিম কোর্ট দুর্নীতির মামলায় আদেশ দিলেন যে, প্রধানমন্ত্রী আশরাফ রাজাকে গ্রেফতার করা হোক। পাঠক খেয়াল করুন, রাষ্ট্রের তথা সরকারের তিনটি অঙ্গÑ নির্বাহী বিভাগ, আইন প্রণয়ন বিভাগ ও বিচার বিভাগ। পাকিস্তানের বিচার বিভাগের প্রধান, নির্বাহী বিভাগের প্রধানকে গ্রেফতার করার হুকুম দিচ্ছেন! যাদের ওপর গ্রেফতার করার দায়িত্ব অর্পণ করা হলো, তারা বলল যে, গ্রেফতার করার মতো যথেষ্ট প্রমাণ বা সংশ্লিষ্টতা তাদের হাতে নেই, অতএব গ্রেফতার করা যাবে না। এরূপ একটি শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিতে যখন দেশের মানুষ জীবনযাপন করছে, তখন ঘটে গেল আরেকটি ঘটনা।

মোহাম্মদ তাহির উল কাদরি একজন ধর্মীয় শিাবিদ ও ধর্ম প্রচারকের নাম, যার বয়স ৬২ বছর। তিনি বিদেশে থাকতেন। তিনি মিনহাজুল কুরআন নামে একটি আন্তর্জাতিক সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা, যে প্রতিষ্ঠানের বয়স এখন প্রায় ২০ বছর। তিনি দ্বীন ইসলামের শান্তির মর্মবাণী এবং শরিয়ত ও তরিকত তথা সুফিবাদের মিশ্রিত একটি বাণী উপস্থাপন করতে সচেষ্ট দুই যুগ ধরে। এর আগে তিনি একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনের অধ্যাপক ছিলেন এবং তারও আগে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে ১৬ বছর ধরে মাদরাসা শিা সমাপ্ত করেছিলেন। বাংলাদেশের যেসব মানুষ পাকিস্তানভিত্তিক স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেল এআরওয়াই টিভি বা কিউটিভি দেখেন তারা তাকে চেহারায় চিনবেন। ডক্টর মোহাম্মদ তাহির উল কাদরি একটি রাজনৈতিক দলেরও প্রতিষ্ঠাতা, যার নাম পাকিস্তান আওয়ামী তেহরিক। চলমান জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো পাকিস্তানের লাহোর মহানগরী থেকে হাজার হাজার সমর্থক নিয়ে একটি লং মার্চ চালু করলেন তাহির উল কাদরি। তাদের গন্তব্যস্থল পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদে অবস্থিত পাকিস্তানের পার্লামেন্ট ভবন। যেই কথা সেই কাজ। ডক্টর তাহির উল কাদরির নেতৃত্বে প্রচণ্ড শীতের মধ্যে ২৫ থেকে ৩০ হাজার লোকের লং মার্চ পার্লামেন্ট ভবনে গিয়ে পৌঁছে এবং ভবনের বাইরে অবস্থান কর্মসূচি চালু করে। পাকিস্তান আওয়ামী তেহরিক নামের রাজনৈতিক দলের আহ্বানে এত লোক যে, হঠাৎ করে সাড়া দিলো এটা বিস্ময়কর। বৈরী আবহাওয়াকে সহ্য করে তারা যে লং মার্চ ও অবস্থান ধর্মঘট পালন করল এটা আরেকটা বিস্ময়। তারা সরকারবিরোধী কয়েক দফা রাজনৈতিক সংস্কারমূলক দাবি উপস্থাপন করেছে। সরকার পুলিশ বা সামরিক বাহিনী দ্বারা এই লং মার্চ বা অবস্থান ধর্মঘট পালনকারী জনসমুদ্রকে বিতাড়িত করল না। বরং, পাকিস্তান সরকার সিদ্ধান্ত নিলো, তারা অবস্থান ধর্মঘট পালনকারীদের সাথে আলোচনায় বসবে। পাকিস্তানের রাজনৈতিক সরকার, এখন সুপ্রিম কোর্টের প থেকে বিপদের মুখে আছে। তাই সরকার, রাজনৈতিক অঙ্গন থেকেও যুগপৎ আরেকটি বিপদ কামনা করছিল না। এ জন্য তারা আলোচনার মাধ্যমে বেশির ভাগ দাবি মেনে নিলো। অন্য কথায় বলতে গেলে, অতটুকু দাবি মেনে নিলো যতটুকু মানা হলে আপাতত মোহাম্মদ তাহির উল কাদরির আন্দোলন স্তিমিত হয়।

পাকিস্তানে তাহির উল কাদরির রাজনৈতিক দলটি এত দিন প্রায় অপরিচিত ছিল। এবার সফল লং মার্চ ও অবস্থান ধর্মঘটের মাধ্যমে দলটি হঠাৎ করেই পাকিস্তান ও বহির্বিশ্বের কাছে পরিচিতি লাভ করেছে। তাহির উল কাদরি কি অতি সূক্ষ্মভাবে পরিকল্পনা করে তার আন্দোলনের সময়সূচি নির্ধারণ করেছিলেন? নাকি কাকতালীয়ভাবে ঘটে গেল? ৩০-৩৫ বছর আগে ইরানে আয়াতুল্লাহ খোমেনি বহু দিন নির্বাসনে থেকে হঠাৎ করেই ইরানে ফিরে এসেছিলেন। অনেক বছর ধরে নির্বাসনে থাকা অবস্থায় তিনি ইরানি জনগণের সাথে বহুমাত্রিক যোগাযোগ রাখতেন। শাসক রেজা শাহ্ পাহলভির অপশাসন ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতেন। পাকিস্তানের তাহির উল কাদরির ঘটনার ইরানের ঘটনার সাথে কিছুটা মিল আছে, পুরোপুরি নয়। এখন থেকে তিন অথবা চার মাস পরে পাকিস্তানে যে সংসদীয় নির্বাচন হবে, সে নির্বাচনে তাহির উল কাদরির রাজনৈতিক দলের অবস্থান কী হয়, সেটা দেখার জন্য অপো করতে হবে।

বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্ট শাসক রাজনৈতিক সরকারের প্রতি বৈরী নয়। বাংলাদেশে মোহাম্মদ তাহির উল কাদরি নেই। কিন্তু আন্দোলনের বিষয়বস্তু আছে। আন্দোলন চলছে, এটাও সত্য। আন্দোলনের মাধ্যমে সব দাবিদাওয়া আদায় হবেÑ এমন নিশ্চয়তা নেই। অতএব, বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে অনেক প্রশ্ন, অনেক আশঙ্কা একই সাথে বিরাজমান। যদি আন্দোলন করেই দাবি আদায় করতে হয়, তাহলে সেই আন্দোলনের কৌশল পুনর্মূল্যায়নের দাবি রাখে।  ১৯৯১ সালের ফেব্র“য়ারি মাসে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়েছিল। সাত মাস পর ওই সংসদ সংবিধানে সংশোধনী আনয়ন করে সংসদীয় সরকার পদ্ধতি বহাল করেছিল। সেই সংসদ থেকে রেওয়াজ শুরু হয় সরকারি দল ও বিরোধী দল কে কী রকম আচরণ করবে। ১৯৭৩ সালের মার্চ মাসে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো। কিন্তু এক বছর ৯ মাস পর সংসদীয় পদ্ধতির সরকারব্যবস্থা বাতিল হয়ে গিয়েছিল বাকশাল কায়েমের কারণে। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ১৯৭৭-৭৮ সালে পুনরায় বহুদলীয় গণতন্ত্র চালু করলেও সরকারপদ্ধতি ছিল রাষ্ট্রপতি ব্যবস্থার। এ কারণে ১৯৯১ সাল গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৯১ সালে নির্বাচিত সংসদের আমলে তৎকালীন বিরোধী দল রেওয়াজ স্থাপন করে সংসদ অধিবেশন বর্জন করা, সংসদকে পাশ কাটিয়ে রাজপথ উত্তপ্ত রাখা, জামায়াতে ইসলামীকে সাথে নিয়ে সংবিধান সংশোধনের উদ্দেশ্যে আন্দোলন করার। অপরপে তৎকালীন সরকারি দল রেওয়াজ স্থাপন করেছিল সংসদীয় কমিটির মাধ্যমে মন্ত্রণালয়ের ওপরে নজরদারি বৃদ্ধি, মন্ত্রীদের সংসদের কাছে যৎকিঞ্চিৎ জবাবদিহিতা ইত্যাদি। ১৯৯১ সালের সংসদের রেওয়াজ বহুলাংশেই আজো বিদ্যমান। কিছু আঙ্গিক পরিবর্তিত হয়েছে উন্নতির দিকে এবং কিছু আঙ্গিকের আরো অবনতি হয়েছে। এই মুহূর্তে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে যে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে এর অবসানের জন্য বিরোধী দলের প থেকে শক্তিশালী ও দেশব্যাপী  ব্যাপক আন্দোলন প্রয়োজন অথবা প্রয়োজন সরকারি দলের প থেকে ব্যাপক নিঃস্বার্থ সদিচ্ছার। যেহেতু সরকারি দলের সদিচ্ছা প্রকাশের লণ বড় আকারে দৃশ্যমান নয়, তাই একটি মাত্র বিকল্প থাকেÑ সেটি হলো আন্দোলন। আন্দোলনে অবশ্যই মানুষের কষ্ট হয় এটা যেমন সত্য, কষ্ট না করলে কোনো ফল আসবে না এটাও সত্য। অতএব, সাধারণ মানুষকে মনস্তাত্ত্বিকভাবে বিরোধী দলের আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত করার কাজটিও অতীব গুরুত্বপূর্ণ।

লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি

www.kallyan-ibrahim.com

No comments

Powered by Blogger.