হরতাল ডেকেই ফের জামায়াত-শিবিরের 'ঘূর্ণিসন্ত্রাস'

সারা দেশে আজ বৃহস্পতিবার হরতালের ডাক দিয়ে গতকাল বুধবার দুপুর থেকেই রাজধানীতে গাড়ি ভাঙচুর ও ককটেল বিস্ফোরণ শুরু করে জামায়াত-শিবির।
রাজধানীর বায়তুল মোকাররমের সামনে সমাবেশের অনুমতি না দেওয়ায় গতকাল দুপুরে এক বিবৃতিতে প্রথমে সারা দেশে সকাল-সন্ধ্যা এবং পরে আলাদা বিবৃতিতে ঢাকা ও চট্টগ্রামে অর্ধদিবস হরতালের ডাক দেওয়া হয়। হরতালের ঘোষণা দেন জামায়াতের কেন্দ্রীয় ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল রফিকুল ইসলাম খান।
ঢাকায় সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির বার্ষিক অনুষ্ঠান এবং চট্টগ্রামে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের কারণে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুরোধে হরতাল অর্ধদিবস করা হয়। জামায়াতের এ হরতালের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের শরিক জাগপা, এনপিপি, কল্যাণ পার্টি, এলডিপি, ন্যাপসহ বিভিন্ন সমমনা দলও সমর্থন জানিয়েছে।
এদিকে হরতালের ঘোষণা দেওয়ার পরপরই রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীরা ঝটিকা মিছিল নিয়ে গাড়ি ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ শুরু করে। দুপুর দেড়টা থেকে আড়াইটার মধ্যে তারা কমলাপুর, মিরপুর, শাহবাগ ও দোয়েল চত্বর এলাকায় বেশ কয়েকটি গাড়ি ভাঙচুর করে এবং আগুন লাগায়। এদিকে শেরে বাংলানগর এলাকা থেকে ৪০ হাজার চকোলেট বোমা উদ্ধার করেছে পুলিশ।
জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল হরতালের ঘোষণা-সংক্রান্ত বিবৃতিতে বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল বাতিল করে আটক জামায়াত ও বিরোধী দলের সব নেতা-কর্মীর মুক্তি, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহাল এবং জনদুর্ভোগ লাঘবের দাবিতে ঢাকাসহ দেশব্যাপী প্রতিবাদ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছিল। কর্মসূচি পালনের অনুমতির আবেদন করা হলেও সরকার অনুমতি না দিয়ে যারা আবেদন করেছিল উল্টো তাদের গ্রেপ্তার করেছে। সরকারের এমন অন্যায় ও অগণতান্ত্রিক আচরণের নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে আটক ব্যক্তিদের অবিলম্বে মুক্তির দাবিতে আন্দোলনের কোনো বিকল্প নেই। তিনি বলেন, 'বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে আগামীকাল ৩১ জানুয়ারি সারা দেশে সকাল-সন্ধ্যা সর্বাত্মক হরতাল পালনের কর্মসূচি ঘোষণা করছি।'
হরতালের আওতামুক্ত : গ্যাস, বিদ্যুৎ, হাসপাতাল, অ্যাম্বুল্যান্স, ওষুধের দোকান, ফায়ার সার্ভিস, কর্তব্যরত সাংবাদিক, সংবাদপত্র, সংবাদ সংস্থা ও মিডিয়ার গাড়ি হরতাল কর্মসূচির আওতার বাইরে থাকবে বলে জামায়াতের বিবৃতিতে জানানো হয়।
বিএনপির সমর্থন : বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য তরিকুল ইসলামের বরাত দিয়ে দপ্তরের দায়িত্বে থাকা যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী গত রাতে হরতালের প্রতি সমর্থনের কথা জানান সাংবাদিকদের। তিনি বলেন, বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেটে বুধবার বিকেল ৩টায় জামায়াতে ইসলামীর সমাবেশ হওয়ার কথা ছিল। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কাছে আবেদনও করেছিল জামায়াত। কিন্তু সমাবেশ আয়োজনের কোনো লিখিত বা মৌখিক অনুমতি না পাওয়ায় জামায়াতের শীর্ষ নেতারা আজ বৃহস্পতিবার হরতালের ডাক দেন। তিনি বলেন, জামায়াত ইসলামী নিবন্ধকৃত রাজনৈতিক দল। তাদের সভা-সমাবেশ করার অধিকার রয়েছে। এর পরও সরকার তাদের সমাবেশ করার অনুমতি দেয়নি। এই অগণতান্ত্রিক আচরণের প্রতিবাদে যেহেতু হরতাল আহ্বান করা হয়েছে, তাই বিএনপিও এই হরতালের প্রতি সমর্থন জানায়।
শিবিরের ঝটিকা মিছিল : হরতালের সমর্থনে রাজধানীর মহাখালী, কমলাপুর ও পান্থপথে লাঠিসোঁটা নিয়ে ঝটিকা মিছিল করেছে শিবির। ওই সময় কমলাপুর থেকে দুই শিবিরকর্মীকে আটক করে পুলিশ।
গতকাল বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে শিবিরের একটি মিছিল পান্থপথ থেকে কারওয়ান বাজারের দিকে যাওয়ার পথে পুলিশ ও ছাত্রলীগের কর্মীরা ধাওয়া দেয়। বাধার মুখে দিগ্বিদিক পালিয়ে যায় মিছিলকারীরা। ওই সময় তারা মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার বন্ধ করার এবং হরতালের সমর্থনে স্লোগান দেয়।
বিকেলে মহাখালী বাসস্ট্যান্ড থেকেও একটি ঝটিকা মিছিল বের করে শিবির। ওই সময় আশপাশে বিচ্ছিন্নভাবে কয়েকজন পুলিশ থাকলেও বাধা দেয়নি তারা। মিছিলটি শুরু হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই কয়েক শ শিবিরকর্মী এতে যোগ দেয়। পরে পুলিশের সংখ্যা বাড়ার আগেই এলাকা ত্যাগ করে তারা। এ নিয়ে এলাকায় আতঙ্ক সৃষ্টি হয়।
এর আগে শিবিরকর্মীরা রাজধানীর কমলাপুর এলাকায় এক পুলিশ কর্মকর্তার গাড়িতে আগুন দেওয়ার চেষ্টা করলে স্থানীয় জনতা প্রতিরোধ করে। জনতার বাধার মুখে পালিয়ে যাওয়ার সময় দুই শিবিরকর্মীক আটক করে পুলিশ।
মগবাজারে বাসে আগুন : গতকাল সন্ধ্যায় রাজধানীর মগবাজারে একটি বাসে আগুন দেওয়া হয়েছে। মগবাজারের উত্তরা ব্যাংকের সামনে রেলগেটের কাছে মতিঝিল থেকে আসা ৬ নম্বর বাসে আগুন দেওয়া হয়। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকেও আগুন জ্বলছিল। পরে পৌনে ৭টার দিকে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা আগুন নিয়ন্ত্রণে আনেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, পর পর দুটি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়ে বাস থেকে যাত্রীদের নামিয়ে দিয়ে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। এতে সেখানে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
৪০ হাজার চকলেট বোমা উদ্ধার : এদিকে ৪০ হাজার চকলেট বোমা উদ্ধার করেছে শেরে বাংলানগর থানার পুলিশ। এ ছাড়া উদ্ধার করা হয় ৫০০টি আতশবাজি। এ ঘটনায় দুজনকে আটক করা হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। পুলিশের ধারণা, জামায়াতের ডাকা হরতালে আতঙ্ক সৃষ্টির জন্যই এসব চকলেট বোমা রাজধানীতে ঢোকানো হয়েছে।
ঢাকায় আটক ৩৮ : পুলিশ জানায়, গত রাতে গাড়ি ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় রাজধানীতে ৩৮ জনকে আটক করা হয়েছে।
চট্টগ্রামে জামায়াত-শিবিরের তাণ্ডব : আমাদের চট্টগ্রাম অফিস জানায়, মহানগরীতে গতকাল সন্ধ্যায় ককটেল বিস্ফোরণ এবং গাড়ি ভাঙচুর করে তাণ্ডব চালিয়েছে জামায়াত-শিবির। সন্ধ্যার পরপরই নগরীর বিভিন্ন স্থানে আচমকা ককটেল বিস্ফোরণ, টায়ার জ্বালানো এবং যাত্রীবাহী গাড়িতে ইটপাটকেল ছুড়ে ভাঙচুর চালানো হয়। শিবিরের হামলার মুখে সড়কে দায়িত্ব পালনরত কোনো কোনো পুলিশ সদস্যকেও জনতার সঙ্গে মিশে আশপাশে আশ্রয় নিতে দেখা গেছে।
পুলিশ সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য মতে, চট্টগ্রাম কলেজ, জামালখান, রাহাত্তরপুল, নিমতলা, গোলপাহাড় মোড়, লাকী প্লাজা, হোটেল সেন্টমার্টিন, হালিশহর, পাহাড়তলী ও খুলশী এলাকায় ককটেল বিস্ফোরণ হয়েছে। এ ছাড়া পাহাড়তলী ও খুলশী থানা এলাকায় কয়েকটি গাড়ির কাচ ভাঙচুর করা হয়েছে। টায়ার জ্বালিয়ে ভাঙচুর করা হয়েছে বিভিন্ন মোড়ে।
সিলেটে ককটেল বিস্ফোরণ : সিলেট অফিস জানায়, নগরের দুটি স্থানে গতকাল সন্ধ্যার পর হরতালের সমর্থনে জামায়াত-শিবিরকর্মীরা ঝটিকা মিছিল করেছে। ওই সময় তারা ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করা হয়।
পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, সন্ধ্যা ৭টার দিকে নগরের বন্দরবাজার ও ধোপাদীঘিরপাড় এলাকা থেকে হরতালের সমর্থনে ঝটিকা মিছিল বের করে জামায়াত-শিবির। ওই সময় তারা অন্তত ২০টি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটায়।
এর আগে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় শহরের রিকাবীবাজারে জামায়াত-শিবির ঝটিকা মিছিল বের করে। সেখানেও তারা কয়েকটি ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটায়। গতকাল সিলেটের বিভিন্ন স্থান থেকে পুলিশ জামায়াত-শিবিরের ২০ কর্মীকে আটক করেছে।

No comments

Powered by Blogger.