বিশ্বায়নের কাল- ডাভোসে বিতর্ক ও বাংলাদেশে অভিনব প্রতিবাদ by কামাল আহমেদ

রাজনৈতিক ও করপোরেট জগতের ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের বার্ষিক মিলনমেলা শেষ হয়েছে শনিবার, আল্পস পবর্তমালার সবচেয়ে উঁচুতে অবস্থিত অবকাশকেন্দ্র সুইজারল্যান্ডের ডাভোসে। অবশ্য ক্ষমতাধরদের এই সপ্তাহব্যাপী সম্মিলনীতে বুদ্ধিবৃত্তিক জগতের অনেক যশোধর পণ্ডিতও আমন্ত্রিত ছিলেন।
বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামে এসব রথী-মহারথীর মতবিনিময়ে সাধারণ মানুষের কতটা উপকার হয়, তা নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। তবে তাঁদের বক্তৃতা-বিবৃতি থেকে বিশ্ব অর্থনীতির গতি-প্রকৃতি এবং রূপান্তরের ধারা সম্পর্কে কিছু আকার-ইঙ্গিত মেলে।
২০০৮ থেকে চলতে থাকা বৈশ্বিক মন্দার কারণে পাশ্চাত্যজুড়ে জনজীবনে যে অসন্তোষ এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছে, তার মধ্যেও এই সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী ব্যাংকার, করপোরেট নির্বাহী এবং নীতিনির্ধারকদের মধ্যে একটা স্বস্তির ভাব লক্ষণীয় ছিল। তাঁদের এই নিরুদ্বেগ ভাব দেখে তাঁদেরই একজন সুইস ব্যাংক ইউবিএসের চেয়ারম্যান অ্যাক্সেল ওয়েবার বলেছেন, ‘আমার মতে, এখানে (ডাভোসে) একধরনের আত্মতৃপ্তির ভাব দেখছি।’
পুরো সপ্তাহে ডাভোসে এসব শীর্ষস্থানীয় কর্তার প্রায় সবাই আশার বাণী শুনিয়েছেন। তাঁদের আলোচনার সারকথা: বৈশ্বিক মন্দার সবচেয়ে সংকটময় পর্যায় আমরা পার হয়ে এসেছি এবং অর্থনীতি আবারও দৃঢ়ভাবে প্রবৃদ্ধির ধারায় সচল থাকবে। তাঁদের এই আশাবাদের কারণ শীর্ষস্থানীয় কোম্পানিগুলোর মুনাফা অর্জনের হার এবং ওয়াল স্ট্রিট আর লন্ডনের শেয়ারবাজারগুলোতে ২০০৮ সালের পর এই প্রথম ধীরগতিতে একটানা ঊর্ধ্বযাত্রা।
তবে মন্দা থেকে উত্তরণ যে সবার মুখে হাসি আনতে পারেনি, সে বিষয়টির কথাও কেউ কেউ তাঁদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। সরকারগুলোর কৃচ্ছ্রসাধন কর্মসূচি এবং মুদ্রাস্ফীতির কারণে যখন সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জীবন ওষ্ঠাগত, তখন এসব বহুজাতিক বা বৃহদাকার কোম্পানিগুলোর পরিচালক ও শেয়ারহোল্ডারদের সম্পদের ভান্ডার আরও সমৃদ্ধ হয়েছে। স্বভাবতই, এর পরিণতিতে রাজনৈতিক অঙ্গনে সৃষ্টি হয়েছে একধরনের অস্বস্তি। সম্পদের এই বৈষম্য ধনী ও দরিদ্রের মধ্যকার ক্রমবর্ধমান দূরত্ব দেশে দেশে ক্ষমতাসীনদের মধ্যেও একধরনের উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে।
অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট বা উই আর দি নাইন্টি নাইন পার্সেন্ট-এর মতো আন্দোলন তো আছেই। কিন্তু, তার ওপর রয়েছে ব্যালট। জার্মানির মতো একাধিক দেশে এ বছরেই হবে সাধারণ নির্বাচন। বৃহৎ পুঁজির সহায়ক নীতিমালা (যেমন—করপোরেট ট্যাক্সের হার ইউরোপের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নামিয়ে আনার অঙ্গীকার) অনুসরণে সবচেয়ে এগিয়ে থাকা ইউরোপীয় রাজনীতিকদের অন্যতম ডেভিড ক্যামেরনের কণ্ঠে তাই এখন বাণিজ্যে নৈতিকতার কথা শোনা যাচ্ছে। ডাভোসেই মি. ক্যামেরন কফিশপ চেইন, স্টারবাকসের নাম উল্লেখ করে বলেছেন, আইনের ফাঁক গলিয়ে কর ফাঁকি দেওয়ার চর্চা অনৈতিক। এ ধরনের নীতিবর্জিত ব্যবসায়িক ধারা বন্ধের জন্য তিনি শিল্পোন্নত দেশগুলোর জোট জি এইটে সমঝোতার জোর চেষ্টা চালাবেন বলে আবারও জানিয়েছেন। ব্রিটেনে পার্লামেন্টের একটি কমিটির তদন্তে সম্প্রতি প্রকাশ পায় যে স্টারবাকস, গুগল ও আমাজনের মতো অনেক বহুজাতিক কোম্পানি শত শত কোটি পাউন্ডের ব্যবসা করলেও কর দিয়েছে সামান্য অথবা একেবারেই দেয়নি। আর তা হয়েছে আইনের ফাঁক গলিয়ে। ক্যামেরন সরকারের বাজেটে কৃচ্ছ্র শুরু হওয়ার পর থেকে শুধু গত তিন বছরেই ব্রিটেনে স্টারবাকসের ব্যবসা হয়েছে ৪০ কোটি পাউন্ড, কিন্তু কর দেওয়ার পরিমাণ শূন্য।
ডাভোসে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের সম্মেলনে আরও একজন খুব নিষ্ঠুর এক সত্য উচ্চারণ করেছেন। ডাচ কোম্পানি রয়্যাল ডিএসএমের প্রধান ফেইকে সিয়েবস্মা বলেছেন, ‘কোম্পানিগুলোর কাছে এখন এত টাকা এবং এত ক্ষমতা, যা অতীতে কখনোই ছিল না।’ তাঁর ওই বক্তব্যের পরের অংশগুলো আরও তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি বলেছেন, ‘এসব কোম্পানি পৃথিবীর যেকোনো একটা বড় অংশ ধ্বংস করে ফেলার ক্ষমতা রাখে।’ তারপর তিনি বলেছেন, যারা এত প্রভাবশালী, তাদের দায়িত্বও বেশি। সরকারগুলো বিশ্বের সব সমস্যার সমাধান করতে পারবে না। জলবায়ুর পরিবর্তন, খাদ্যসংকট এবং সম্পদের স্বল্পতার ক্ষেত্রে কোম্পানিগুলোকেও এগিয়ে আসতে হবে।
তাঁর কথারই প্রতিধ্বনি করে হার্ভার্ডের ম্যানেজমেন্ট প্র্যাকটিসের প্রফেসর উইলিয়াম ডব্লিউ জর্জ বলেছেন, কোম্পানি পরিচালনায় শুধু শেয়ারহোল্ডার বা মালিকদের স্বার্থ দেখলে চলবে না, সমাজের জন্যও কিছু করতে হবে। তা না হলে দীর্ঘমেয়াদি এসব কোম্পানি সংকটের মুখে পড়বে।
ডাভোসে যেসব করপোরেট কর্তা ও নীতিনির্ধারক এসব সাবধানবাণী শুনেছেন, তাঁরা এসব কথায় কতটা গুরুত্ব দেবেন, তার প্রমাণ মিলবে ভবিষ্যতে। তবে ইউরোপজুড়ে যে হারে বেকারত্ব বাড়ছে, তাতে সামাজিক স্থিতিশীলতা আরও দুর্বল হয়ে পড়াটা মোটেও অস্বাভাবিক হবে না। গ্রিসে অস্থিরতা এখনো চরমে। জানুয়ারির শুরুতে সেখানে গণপরিবহনের শ্রমিকেরা ধর্মঘট করেছেন প্রায় ১০ দিন। বিক্ষোভ-প্রতিবাদ সহিংস রূপ নেওয়ার বিষয়টি সেখানে প্রায় নিত্যকার উপসর্গ হয়ে দেখা দিয়েছে। স্পেন ও পর্তুগালে বেকারত্বের হার ১০ শতাংশের ওপর। সরকারি পরিসংখ্যানে জানা যাচ্ছে, পর্তুগালের কর্মক্ষম তরুণদের ২ শতাংশ ইতিমধ্যেই ভাগ্যের সন্ধানে দেশ ছেড়েছে। টেলিভিশনের খবরে দেখানো হচ্ছে, স্পেন থেকে প্রতিদিন বিমান বোঝাই করে তরুণ-তরুণীরা জার্মান শহরগুলোতে ভিড় জমাচ্ছেন কাজের আশায়। পার্টটাইম অথবা স্ব-কর্মসংস্থানের আড়ালে ব্রিটেনে বেকারত্বের চিত্র অতটা খারাপ না বলা হলেও যুব বেকারত্বের হার ৮ শতাংশের মতো। ব্রিটেনেই বেসরকারি দাতব্য প্রতিষ্ঠানগুলো জানাচ্ছে, তাদের প্রতিদিন গড়ে তিনটি করে ফুড-ব্যাংক (লঙ্গরখানার সমতুল্য) খুলতে হচ্ছে। বিপরীতে, বড় বড় কোম্পানির পরিচালকদের আয় বৃদ্ধি ঠিকই বজায় আছে।
ডাভোসে ফেইকে সিয়েবস্মার বৈশ্বিক কোম্পানিগুলোর যে দাপটের কথা বলেছেন, তার সঙ্গে বাংলাদেশের করপোরেট জগতের কোনো তুলনাই হয়তো চলে না। কারণ, বাংলাদেশের কোম্পানিগুলো আকার-আকৃতিতে খুবই ছোট। তবে, তাদের অনেকের দাপট কিন্তু যথেষ্ট। তা সে পরিবেশ ধ্বংসকারী প্রকল্প বাস্তবায়নে হোক, অথবা ভোক্তা অধিকারকে বুড়ো আঙুল দেখানোতেই হোক।
তবে এ ধরনের করপোরেট অনাচারের বিরুদ্ধে সবাই যে দিনের পর দিন মুখ বুজে থাকবেন, তেমনটি ভাবলে ভুল করা হবে। বিশেষ করে ইন্টারনেটের এই যুগে, যখন যোগাযোগটা প্রায় সবারই নাগালের মধ্যে। ভোক্তাদের এ রকম একটি ব্যতিক্রমী প্রতিবাদের আয়োজন ছিল গত রোববার (২৭ জানুয়ারি)। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকের সহায়তায় বাংলাদেশের একদল মোবাইল ফোন ব্যবহারকারী এই অভিনব প্রতিবাদে অংশগ্রহণকারী। এতে সংবাদমাধ্যমের তেমন একটা নজর না পড়লেও তার ব্যাপ্তি যে উপেক্ষণীয় নয়, সেটা ফেসবুকে ভালোই টের পাওয়া গেছে।
ইন্টারনেট সংযোগ সেবাদানকারী মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলোর সেবার মানে ক্ষুব্ধ এবং ক্ষুব্ধ গ্রাহকদের ভাষায় তার মূল্য ‘অযৌক্তিক ও অনৈতিক‘ হওয়ায় তাঁরা প্রতিবাদ হিসেবে এদিন সকাল থেকে দুপুরের মধ্যে একটি নির্দিষ্ট সময়ে একে অন্যকে মিসড কল দিয়ে নেটওয়ার্কগুলো ব্যস্ত রাখার চেষ্টা চালান। প্রতিবাদের এই প্রক্রিয়া তাঁরা অব্যাহত রাখার পরিকল্পনার কথাও জানিয়েছেন।
এই প্রতিবাদ কতটা ব্যাপক হয়েছে বা তার কোনো চাপ মোবাইল নেটওয়ার্কগুলোর ওপর পড়েছিল কি না, পড়ে থাকলে কতটা এবং তার প্রতিক্রিয়ায় কোনো পরিবর্তন ঘটবে কি না, তা বলা মুশকিল। তবে ফেসবুকে এ বিষয়ে যতটা আলোচনা দেখা গেছে, তার গুরুত্ব যদি ওসব কোম্পানির সোশ্যাল মিডিয়াবিষয়ক উপদেষ্টারা বুঝে থাকেন, তাহলে করপোরেট কর্তারা বিষয়টিকে বেশি দিন উপেক্ষা করতে পারবেন বলে মনে হয় না।
কামাল আহমেদ: প্রথম আলোর লন্ডন প্রতিনিধি।

No comments

Powered by Blogger.