ছাত্ররাজনীতি- উপদ্রুত ক্যাম্পাস ও সরকারের ঔদাসীন্য by আলী ইমাম মজুমদার

২৩ জানুয়ারি একটি দৈনিকের প্রধান শিরোনাম ‘ছাত্রলীগের তাণ্ডবে শিক্ষার সাফল্য ম্লান’। আরেকটি দৈনিকের খবর ‘ছাত্রলীগ থামছে না’। ২৪ জানুয়ারি এ দৈনিকটির প্রধান শিরোনাম ‘ছাত্রলীগের নেতাদের ধরছে না পুলিশ’। ইদানীং এ ধরনের খবরে বিচলিত ও শঙ্কিত হচ্ছে সচেতন মানুষ।
আবার এসব খবর প্রকাশের জন্য কেউ কেউ দুষছেন গণমাধ্যমকে। ক্ষোভ প্রকাশ করছেন সুশীল সমাজের ওপর। অথচ ঘটনাগুলো অসত্য বা অতিরঞ্জিত, এটা কেউ বলছে না। তবে কিছু ক্ষেত্রে বলা হচ্ছে, দায়ী ব্যক্তিরা ছাত্রলীগের নয়। কিংবা তারা আগেই দল থেকে বহিষ্কৃত। মোটামুটি ব্যতিক্রমহীনভাবে সব কটি পত্রপত্রিকা আর টিভি চ্যানেলের বক্তব্য অভিন্ন।
মূল বক্তব্যে যাওয়ার আগে ছাত্রলীগ নামক সংগঠনটির অতীত কিছুটা আলোচনার দাবি রাখে। এ প্রতিষ্ঠানটি ছিল ভাষা আন্দোলনে। তারা অগ্রণী ছিল সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনসহ বাঙালির স্বার্থ রক্ষায় পরবর্তী অন্য আন্দোলনগুলোতে। প্রধান রূপকার ছিল ১১ দফা আন্দোলনের মাধ্যমে উনসত্তরে গণ-অভ্যুথানের। এতে স্বাধীনতাসংগ্রামের মূল পটভূমি রচিত হয়ে যায়। আর এ আন্দোলনের ফলেই ঐতিহাসিক আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধুসহ সব বন্দীকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। ছাত্রলীগের সাংগঠনিক কাঠামোটি পুরোপুরিভাবে ব্যবহূত হয় স্বাধীনতা আন্দোলনে, যার মূল প্রেরণা ছিল গভীর দেশপ্রেম। এ সংগঠনের বিভিন্ন স্তরের কমিটিগুলো নির্বাচিত হতো। জাতীয় কাউন্সিলে নির্বাচিত হতো কেন্দ্রীয় কমিটি। এ গৌরবোজ্জ্বল উত্তরাধিকার স্বাধীনতা অর্জন পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি ধরে রেখেছিল। এর পরেই বিপরীতমুখী যাত্রা শুরু হয়। সর্বনাশা পথে চলছে তাদের কার্যক্রম। তাই সহানুভূতিশীল ব্যক্তিরা দাবি তোলেন এদের সামলাতে। কেউ বা বলেন একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য তাদের কার্যক্রম বন্ধ করতে।
প্রশ্ন আসে, এ ধরনের বিতর্কিত কার্যক্রমের সঙ্গে আর কোনো ছাত্রসংগঠন জড়িত আছে কি না? নিশ্চয় আছে। দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সমর্থনপুষ্ট সব কটি ছাত্রসংগঠনের ভাবমূর্তি কম-বেশি একই ধরনের। গত দুই দশক যখন যে দল ক্ষমতায় থাকছে, তাদের সমর্থিত বা সহযোগী ছাত্রসংগঠন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজসহ নামকরা কলেজগুলোতে একচ্ছত্র কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। মেধা বা ভোটের জোরে নয়। সরকারি আনুকূল্যে পেশিশক্তির বলে। অস্ত্রের দাপটে।
যে কেউ জানতে চাইবে, কী তাদের লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য। কাগজে-কলমে হয়তো বা অনেক কিছুই লেখা আছে। বাস্তবে নিজ নিজ নেতাদের বন্দনা তাদের মুখে। আর মনোযোগ উন্নয়নকাজের বখরা আদায়, ছাত্রভর্তি আর কর্মচারী নিয়োগ-বাণিজ্য আর আশপাশের দোকান, হাটবাজার থেকে চাঁদাবাজি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই প্রতিপক্ষের ছাত্রসংগঠন ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত। স্থবির তাদের কার্যক্রম। প্রধানত সক্রিয় থাকে সরকারি দলের সমর্থিত ছাত্রসংগঠন। প্রতিপক্ষ বিনাশে তারা দেশীয় অস্ত্র দা, চাপাতি, লাঠি আর হকিস্টিকে সীমিত থাকছে না। ব্যবহূত হয় আগ্নেয়াস্ত্র। সুযোগ পেলে প্রতিপক্ষও একই প্রক্রিয়া নেয়। একটি ছাত্রসংগঠন হাত-পায়ের রগ কেটে দেয় এর প্রতিপক্ষের কর্মী-সমর্থকদের। আর প্রতিপক্ষকে হটিয়ে যারা একক কর্তৃত্ব নেয়, তাদের মাঝে অচিরেই দেখা যায় দলাদলি। এটাও নীতি বা কর্মসূচি নিয়ে নয়, ভাগ-বাঁটোয়ারার জন্য। ছাত্রনেতা হওয়া এখন বিত্তবৈভব অর্জনের পথ খুলে দেয়। তাই দলাদলি রূপ নেয় সহিংসতায়।
এরপর দেখা যাক এ ছাত্রনেতা কারা আর কীভাবে অর্জন করে নেতৃত্ব। তারা কেউ কেউ ছাত্র বটে, তবে সবাই নয়। আর সে নেতৃত্ব নির্বাচিতও হয় না। মনোনয়ন দেয় কেন্দ্রীয় কমিটি কিংবা উপজেলা বা এ ধরনের স্তরের জন্য জেলা কমিটি। আর এ মনোনয়নেও বাণিজ্যের বিষয়টি এখন ওপেন সিক্রেটই বটে। আর কেন্দ্রীয় নেতা? কাউন্সিল হয় বটে, তবে সেখানে নির্বাচনের বালাই নেই। এদের পৃষ্ঠপোষক দলটির নেতৃত্ব এ মনোনয়নের দায়িত্ব নেয়। তাহলে এটা পরিষ্কার হয়ে যায়, আমাদের জাতীয় রাজনীতিতে যে অবক্ষয়, তারই প্রতিফলন ঘটছে ছাত্ররাজনীতিতে। স্বাধীনতা-পূর্বের সময়ের সঙ্গে আরেকটি ব্যতিক্রম লক্ষণীয়। তা হচ্ছে, তখন প্রায় প্রতিটি ছাত্রই কোনো না কোনো ছাত্রসংগঠনের কর্মী বা সমর্থক ছিল। এর পেছনে ছিল একটি আদর্শ, একটি স্বপ্ন। এখন তা আছে খুব কমসংখ্যক ছাত্রের মধ্যে। মিটিং-মিছিলে যেতে বাধ্য হয় দলীয় ক্যাডারদের দ্বারা লাঞ্ছিত হওয়ার ভয়ে।
গত কয়েক মাসের অল্পসংখ্যক চিত্র তুলে ধরা যাক। বর্তমান সরকার-সমর্থক ছাত্রসংগঠনটির বিরুদ্ধে অভিযোগের পাহাড়। খবর এসেছে ‘পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজের দরপত্র দাখিল নিয়ে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষ। ক্যানটিন ও বিশ্ববিদ্যালয়সংলগ্ন বাজারের অর্ধশত দোকান ভাঙচুর’। আরেক ঘটনায় বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজের ছাত্রীনিবাসে মধ্যরাতে ছাত্রলীগ নেতারা প্রবেশ করতে গেলে দারোয়ান গেট না খোলায় তাঁকে হকিস্টিক দিয়ে পেটানো হয়। এর কদিন আগে কুষ্টিয়ায় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের সঙ্গে ছাত্রদল-সমর্থকদের গুলিবিনিময় হয়। ছাত্রলীগের কর্মীরা পুলিশের শটগান কেড়ে নিয়ে প্রতিপক্ষের ওপর গুলি ছোড়ে। এর সচিত্র প্রতিবেদন আমরা খবরের কাগজে দেখেছি। অতি সম্প্রতি পাঁচ মাস বন্ধ থাকার পর বিশ্ববিদ্যালয়টি খুলেছে। মাত্র কদিন আগে ময়মনসিংহে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দুটি বিবদমান গ্রুপের তিন দিনব্যাপী সংঘর্ষে অর্ধশতাধিক আহত হয়। শেষ দিনে ক্যাম্পাস-সংলগ্ন গ্রামের রাব্বী নামক এক বালক গুলিতে নিহত হয়। এতে আপাতত যবনিকা ঘটে এ লড়াই পর্বের। নিজ থেকে নয়। নয় প্রশাসনিক প্রচেষ্টায়। ক্ষুব্ধ গ্রামবাসী কর্তৃক যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকটি আবাসিক হল আক্রান্ত হয়, তখন। এর কিছুকাল আগে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের কতিপয় কর্মী একটি রাজনৈতিক কর্মসূচি চলাকালে বিশ্বজিৎ নামক একজন নিরীহ তরুণকে (পেশায় একজন দর্জি) রাজপথে প্রকাশ্যে নৃশংসভাবে হত্যা করে। ঐতিহ্যবাহী সিলেট এমসি কলেজ হোস্টেলটি পুড়িয়ে দেওয়ার কাজটিও একই ছাত্রসংগঠনের কর্মীরাই করেছে বলে অভিযোগ আছে। আবার সেখানে চলমান উন্নয়নকাজের ঠিকাদারকে কাজ শেষ না করার আগেই বিল দেওয়া হয়নি কেন, এর জন্য ছাত্রলীগের জনৈক নেতা শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলীকে মারধর করেন।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে ছাত্রসংগঠনগুলোর অপকর্মের সঙ্গে তাদের রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষক ছাড়া কিছু শিক্ষকও সংশ্লিষ্ট হয়ে পড়েছেন। তাঁদের সংশ্লিষ্টতা মূল দলকে খুশি করে সুযোগ-সুবিধা নেওয়া। এর কিছুটা আলামত আমরা দেখেছি বুয়েট ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমান উপাচার্য নিয়োগ পাওয়ার আগে তাঁর পূর্বসূরির বিরুদ্ধে ছাত্র-শিক্ষকদের একটি আন্দোলন চলমান ছিল। সেখানকার বিভক্ত ছাত্রলীগের একটি অংশের পরিচিতি ছিল ভিসি গ্রুপ বলে। সেই আন্দোলনের সময় তাদের মুখে স্লোগান উচ্চারিত হয়েছিল ‘ভিসি তোমার ভয় নাই, রাজপথ ছাড়ি নাই’। সে ভিসি মহোদয় তাঁর পদটি হারালেও একটি সাংবিধানিক পদে বহাল হয়েছেন।
যে ঘটনাগুলো এখন ঘটে চলেছে, তা সমালোচনা করছে বিরোধী দল। ন্যায্যভাবেই করছে। তবে তাদের শাসনামলে তাদের সমর্থক ছাত্রসংগঠন ছাত্রদলও তাই করত। হয়তো বা দিনে দিনে আওতার প্রসার ঘটছে। নিত্যনতুন ধ্যানধারণা যুক্ত করছে অর্থ কামাইয়ের। ১৯৯১ সালে গণতন্ত্রের পথে নতুন যাত্রার শুরুর বেশ কয়েক বছর আগেই চট্টগ্রাম ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রশিবির অনেকটা একক নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। আর এ প্রক্রিয়াটিও ছিল সশস্ত্র ও সহিংস। সে নিয়ন্ত্রণ অব্যাহত ছিল দীর্ঘকাল। এখনো ফিরে পেতে সচেষ্ট। তবে তাদের নিয়ন্ত্রণমুক্ত হয়ে ভালো কিছু ঘটেছে, এমনটা কিন্তু নয়। আগে ওরা করত আর এখন করে এরা। আবার শিবির তৎপর হয়েছে রাজনৈতিক ইস্যুতে রাজপথে পুলিশের সঙ্গে সংঘাতে।
সাম্প্রতিক কালে কোনো সরকারই এ উপদ্রুত ক্যাম্পাসগুলোতে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে তেমন কার্যকর ব্যবস্থা নেয়নি। তাই আমাদের প্রধান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো অনেক ক্ষেত্রেই আতঙ্কের স্থানে পরিণত হয়েছে। তারুণ্যের কোলাহলের বদলে সেখানে সময়ে সময়ে শুনছি নিপীড়িতের আর্তনাদ। প্রায় ক্ষেত্রেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিষ্ক্রিয় বা পক্ষপাতসুলভ আচরণ করছে। যেমনটা দেখা গেছে ময়মনসিংহে। এখনো কেউ গ্রেপ্তার হয়নি মর্মান্তিক ঘটনায়।
আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে একটি সমৃদ্ধ জাতি হওয়ার। বাড়ছে শিক্ষার হার। শিক্ষার্থীর সংখ্যাও বেড়ে চলছে। এর জন্য ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন সরকার নানাবিধ প্রণোদনা দিয়ে যাচ্ছে। তবে এ বেদনাদায়ক সত্যটি সবাই স্বীকার করবেন, শিক্ষার মান ক্রম নিম্নমুখী। এ প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে আমাদের স্থান করে নিতে এটা প্রধান প্রতিবন্ধকতা। এর কারণ নানাবিধ। তবে প্রধান কারণ যে উপদ্রুত ক্যাম্পাস; এটা স্বীকার করতেই হবে। কেননা শিক্ষাঙ্গনে নেতিবাচক পরিবেশ শিক্ষার মানের ওপর বিরূপ প্রভাব রাখারই কথা। এটিও নির্মম সত্য, গত দুই যুগ উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে নিয়োগের সময়ে অনেক ক্ষেত্রে মেধার চেয়ে দলীয় আনুগত্য স্থান পায়। সরকারি কলেজের নিয়োগের বেলায় কোটার জোরে মেধাবীদের বাদ দিয়ে শিক্ষক হিসেবে কম মেধাবীরাই ঢুকে পড়ছেন।
কিন্তু এভাবেই কি চলতে থাকবে? কোনো ছাত্রসংগঠনের কার্যক্রম সাময়িক বা স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দেওয়ার কী যুক্তি, এটা দুর্বোধ্য। এরা কি রাষ্ট্রশক্তির চেয়ে বেশি ক্ষমতা রাখে? সরকার যদি আইনের শাসন চালাতে চায়, তবে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাই তাদের দমনে সক্ষম। যে বা যারা সন্ত্রাস বা চাঁদাবাজি করবে আর ভর্তি ও নিয়োগের সময়ে করতে চাইবে বাণিজ্য, তাদের প্রতিহত করতে প্রচলিত আইনই যথেষ্ট। আর এটা পক্ষপাতহীনভাবে প্রয়োগের জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক অঙ্গীকার।
আমাদের দেশ চলবে রাজনৈতিক নেতৃত্বে এবং গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে। এটা স্বাধীনতার চেতনা। তবে আমাদের নেতাদের বর্তমান বৃত্তের বাইরে এসে কালের যাত্রার ধ্বনি শুনতে হবে। অথবা সে রথ নিত্যই উধাও হয়ে যাবে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর শেষের কবিতা নামক ছোট উপন্যাসটি শেষ করেন একটি কবিতা দিয়ে। তার প্রসঙ্গ হয়তো ভিন্ন ছিল। তবে আজকের অবস্থার অনেকটাই মিল খুঁজে পাওয়া যায় তাঁর প্রথম দুটি লাইনে:
‘কালের যাত্রার ধ্বনি শুনিতে কি পাও।
তারি রথ নিত্যই উধাও।’
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
majumder234@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.