‘ব্যাটিং জিনিসটাই আমার খুব প্রিয় ছিল’ by উৎপল শুভ্র

উৎপল শুভ্র: এত বছর ক্রিকেট খেলার পর, যে ক্রিকেট একরকম জীবনই হয়ে গিয়েছিল আপনার, সেটি ছেড়ে দেওয়ার পর কখনো শূন্যতার একটা অনুভূতি হয়নি?
ব্রায়ান লারা: নট রিয়েলি। আমি মনে করি, আমার ক্যারিয়ারটা পরিতৃপ্তির স্বাদই দিয়েছে আমাকে। ১৭ বছর ওয়েস্ট ইন্ডিজের পক্ষে খেলেছি। এরও আগে ত্রিনিদাদ অ্যান্ড টোবাগোর হয়ে খেলেছি; খেলেছি স্কুল ক্রিকেট, বয়সভিত্তিক ক্রিকেটে। কম তো আর খেললাম না। অবসর নেওয়ার সময়ে আমার মনে হয়েছিল, সেটিই উপযুক্ত সময়। সিদ্ধান্তটা নেওয়ার অনেক কারণই ছিল। ছয় বছর পরে এসেও মনে করি, ঠিক সময়ে ঠিক সিদ্ধান্তটাই নিয়েছি। জীবন এগিয়ে যাচ্ছে। এই ছয় বছরে অনেক কিছুই করেছি। এই যেমন আবার বাংলাদেশে এলাম চিটাগং কিংসের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হয়ে। আমি খুব সুখী। ক্রিকেট যে একেবারে খেলি না, তা নয়। মাঝে মাঝে চ্যারিটি ম্যাচ খেলার জন্য আবার প্যাড-ট্যাড পরি। সব মিলিয়ে আমি খুব ভালো আছি।
উ. শু.: ২০০৭ বিশ্বকাপে বারবাডোজে যে সংবাদ সম্মেলনে অবসরের ঘোষণা দিয়েছিলেন, সেটিতে আমি উপস্থিত ছিলাম। আপনার ঘোষণাটা এমন আকস্মিক ছিল যে, সাংবাদিকেরা সবাই হকচকিয়ে গিয়েছিল। আগেই ভেবে-টেবে ওই সিদ্ধান্তটা নিয়েছিলেন, নাকি তা ছিল তাৎক্ষণিক?
লারা: ওই বিশ্বকাপটা আমাদের পরিকল্পনামতো হয়নি। তবে সত্যি বলছি, ওই সময় আমার মনে হয়েছিল, দলটার নতুন একজন নেতা দরকার এবং তাঁর মাথার ওপর সাবেক অধিনায়ক বা বেশি সিনিয়র খেলোয়াড় না থাকাই ভালো। আমি মনে করি, ওয়েস্ট ইন্ডিজের ভালোর জন্য ঠিক সময়ে ঠিক সিদ্ধান্তটাই আমি নিয়েছিলাম।
উ. শু.: গত বছর কলম্বোতে আইসিসি হল অব ফেমে অন্তভুর্ক্তির পর বক্তৃতা দেওয়ার সময় আপনার প্রয়াত বাবা প্রসঙ্গে খুব আবেগাক্রান্ত হয়ে পড়েছিলেন। আপনার জীবনে কি বাবার প্রভাবই সবচেয়ে বেশি?
লারা: অবশ্যই। ক্রিকেটার হিসেবে, মানুষ হিসেবে আমাকে আর কেউ এত প্রভাবিত করেনি। আমি ছিলাম বাবার শেষ সন্তান। আমাদের পরিবার ছিল অনেক বড়—১১ জন ভাইবোন। সবার ছোট হলে যা হয়, আমার সঙ্গে উনি প্রচুর সময় কাটাতেন। অন্য ভাইবোনেরা হয়তো এ জন্য আমাকে ঈর্ষাও করত। আমাদের সম্পর্কটাও ছিল দারুণ। ক্রিকেটের ব্যাপারে সব সময়ই তাঁর সমর্থন পেয়েছি। হি ওয়াজ আ গ্রেট ম্যান। আমি জীবনে যা করেছি, এতে তাঁর অনেক বড় অবদান আছে। আমার বোন অ্যাগনিসেরও খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। আমার এত উপরে উঠে আসায় আমার পরিবার, প্রয়াত জোয়ি ক্যারু (ওয়েস্ট ইন্ডিজ ব্যাটসম্যান), স্যার গারফিল্ড সোবার্স...এমন আরও অনেকের অবদান আছে। তবে বাবা তো বাবাই। তাঁর কোনো তুলনা হয় না।
উ. শু.: আপনার ব্যাটিংয়ের মধ্যে একটা মাদকতা ছিল। তা বোঝাতে মায়াবী বলব না জাদুকরি, বুঝতে পারছি না। আপনার ব্যাটিং অন্যরা বিশ্লেষণ করেছে, আমরা অনেকে অনেক লেখা লিখেছি। কিন্তু আপনাকেই যদি কোনো নির্দিষ্ট কিছুর কথা বলতে বলি, যা ব্রায়ান লারাকে সবার চেয়ে আলাদা করে দিয়েছিল?
লারা: আলাদা কি না জানি না। এটা বলতে পারি, আমি রান করতে ভালোবাসতাম। সব সময়ই আমি রান করার সুযোগ খুঁজতাম। মনমানসিকতায় ও খেলায় আমি ছিলাম খুব আক্রমণাত্মক। রান ছিল আমার আত্মবিশ্বাসের জ্বালানি। আরেকটা ব্যাপার ছিল, কোনো মাইলফলক ছুঁলে আমি সেটিকেই যথেষ্ট মনে করতাম না। ব্যাটিং করতে আমি খুব ভালোবাসতাম। সেই স্কুল ক্রিকেটে খেলার সময় থেকেই আমি ছিলাম দলের মূল ব্যাটসম্যান। ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলে ঢোকার পর তা হতে তিন-চার বছর লেগেছে। ডেসমন্ড হেইন্স, রিচি রিচার্ডসনরা অবসর নেওয়ার পর সেই দায়িত্বটা আমার ওপর পড়ল। আমি এই চাপটা খুব উপভোগ করতাম। চাপ যেহেতু বললাম, আমি সেটি ভালোভাবেই সামলেছি।
উ. শু.: ১৯৯৪ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের তখনকার প্রধান নির্বাচক ডেভিড হলফোর্ড আমাকে বলেছিলেন, আপনার মতো বল গ্যাপে মারতে তিনি আর কাউকে দেখেননি। আগের প্রশ্নটা মাথায় এল এ কারণেই...
লারা: হ্যাঁ, এটা আমি খুব ভালো পারতাম। খুব কম বয়স থেকেই আমি যখন ব্যাট করতাম, আশপাশে হয়তো ফুলের টব থাকত, গাছ থাকত—আমি ওসবের মধ্য দিয়ে মারতে পারতাম। আমি জানি না, সেটিই পরে কাজে লেগেছে কি না। তবে এটা বলতে পারি, আমি সব সময়ই দ্রুত রান করতে পছন্দ করতাম। বোলিং দলকে চাপে ফেলতে চাইতাম। এটাই ছিল আমার শক্তির দিক। ঠুকঠুক করে রান করাটা আমার কখনোই পছন্দ ছিল না। আমি চাপটা বোলারদের ওপর ফিরিয়ে দিতে চাইতাম। আসলে এক কথায় বলতে গেলে, ব্যাটিং জিনিসটাই আমার খুব প্রিয় ছিল।
উ. শু.: ফিল্ড প্লেসিং দেখার পর সেটি কি আপনার মনে আঁকা হয়ে যেত?
লারা: কিছুটা তো বটেই। কোন ফিল্ডার কোথায় আছে, কোথায় মারলে রান হবে না, পাঁচ বা দশ গজ ডানে বা বাঁয়ে মারলে রান পাওয়া যাবে—এমন একটা ছবি তো মনে আঁকা থাকতই। মাথার সামনে শুধু দুটি চোখ নিয়ে তো আর পুরো মাঠটা দেখা যায় না। তবে মাঠে কে কোথায় দাঁড়িয়ে আছে, এমন একটা ছবি তো স্মৃতিতে থাকতই।
উ. শু.: শুধু স্যার গ্যারি সোবার্সের রেকর্ড ভেঙেছেন বলেই নয়; দুজনই বাঁহাতি, দুজনেরই উঁচু ব্যাক লিফট, দুজনই ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান—সব মিলিয়ে অনেকেই আপনাদের মধ্যে সাদৃশ্য খুঁজে পান। আপনি কি কখনো স্যার গ্যারিকে ব্যাটিং করতে দেখেছেন?
লারা: না, স্যার গ্যারির সঙ্গে যখন প্রথম দেখা হয়, তখন আমার বয়স ১৪। বারবাডোজে স্যার গারফিল্ড সোবার্স টুর্নামেন্টে খেলতে গিয়ে। স্যার গ্যারি প্রথম দেখেই আমার ব্যাটিং খুব পছন্দ করে ফেললেন। এর পর থেকেই উনি সুযোগ পেলেই আমার কথা উল্লেখ করতেন। এটা আমার জন্য খুব অনুপ্রেরণাদায়ী ছিল। তবে আমার সত্যিকার ব্যাটিং রোল মডেলের কথা যদি বলি, সেটি ছিলেন রয় ফ্রেডরিকস। সত্তরের দশকে উনি ওয়েস্ট ইন্ডিজের পক্ষে ওপেন করতেন। আমিও তখন ওপেন করি। ফ্রেডরিকসকে দেখে আমিও ব্যাটিংয়ের সময় কবজির কাছে বোতাম লাগানো লম্বা হাতা জামা পরতাম। আমি যদি কারও ব্যাটিং অনুকরণ করার চেষ্টা করে থাকি, সেটি হলেন রয় ফ্রেডরিকস।
উ. শু.: ১৯৯৫ সালে শারজায় আমার নেওয়া আপনার প্রথম সাক্ষাৎকারেও আপনি এ কথা বলেছিলেন। তবে একই সঙ্গে বলেছিলেন, গর্ডন গ্রিনিজের টেকনিক, ডেসমন্ড হেইন্সের টেম্পারামেন্ট ও ধৈর্য, ভিভ রিচার্ডসের দাপট আপনার কেমন মন কেড়েছিল। আপনি কি মনে করেন, নিজের ব্যাটিংয়ে এই সবকিছুর সম্মিলন করতে পেরেছিলেন?
লারা: ওই কথাটা কেন বলেছিলাম, সেটি আগে ব্যাখ্যা করি। আমার প্রথম হিরো ছিলেন রয় ফ্রেডরিকস। তাঁকে ব্যাটিং করতে দেখার পর যেটা হলো, আমিও তাঁর মতো বাঁহাতি, নিজেও ওপেনিং ব্যাটসম্যান, তাই...। তবে বয়স একটু বাড়ার পর যা হয়, আপনি একেক ব্যাটসম্যানের একেক ধরনটা বুঝতে শিখবেন। গর্ডন গ্রিনিজকে ওপেনিং করতে দেখা মানে ছিল দারুণ অভিজ্ঞতা। শিয়ার ক্লাস, সঙ্গে দুর্দান্ত টেকনিক। ডেসমন্ড হেইন্স ছিলেন সত্যিকার এক ফাইটার। দেখতে হয়তো গর্ডন গ্রিনিজের মতো রোমাঞ্চক ছিলেন না, তবে রান কিন্তু কম করেননি। উনি সারা দিন ব্যাট করতেন, কখনোই এমন মনে হতো না যে, সবকিছু তাঁর নিয়ন্ত্রণে আছে। অথচ দিন শেষে দেখা যেত, উনি তখনো আছেন। আর ভিভ রিচার্ডস তাঁর দিনে ছিলেন রীতিমতো বিধ্বংসী। এই যে একেক জনের একেকটা শক্তির জায়গা, সেগুলোকে একখানে করতে কে না চাইবে! আমার মনে হয়, টেলিভিশনে ওদের খেলা দেখে, পোর্ট অব স্পেনে গিয়ে খেলা দেখে, পরে খুব তরুণ বয়সে দলের অংশ হয়ে...আমি যা হয়েছি, সেটি তাঁরাই তৈরি করে দিয়েছেন। আমি সবার কাছ থেকেই কিছু না কিছু নিয়েছি।
উ. শু.: ভিভ রিচার্ডস কি আপনার দেখা সবচেয়ে বিধ্বংসী ব্যাটসম্যান?
লারা: অবশ্যই উনি আমার দেখা সেরা ব্যাটসম্যান। টেন্ডুলকারকেও আমি ওখানেই রাখব। এই দুজনের মধ্যে একজনকে বেছে নেওয়া কঠিন। কথাটা বলে ফেললাম। তবে আমি মনে করি, ভিন্ন যুগের ব্যাটসম্যানদের তুলনা করাটাই ঠিক নয়, বরং প্রত্যেকের আলাদা আলাদা অসাধারণত্ব উপভোগ করা উচিত। এই দুজনই অসাধারণ। আমি যে এই দুজনকেই ব্যাট করতে দেখেছি, এটাকে বড় পাওয়া বলে মানি।
উ. শু.: টেন্ডুলকারের কথা তুলে ভালোই করলেন। এরপর এই প্রসঙ্গেই আসতাম। এখন যেমন ফুটবল বিশ্বে মেসি-রোনালদো, নব্বইয়ের দশকে ক্রিকেটে তেমনই বড় তর্ক ছিল—টেন্ডুলকার, না লারা? ৩৭৫ ও ৫০১ করে আপনি এগিয়েও গিয়েছিলেন, কিন্তু কেন যেন মনে হয়, পরে আপনি নিজেই এই রণে ভঙ্গ দেন। আসলেই কি তাই?
লারা: ১৯৯৫ সালের পরের বছর তিনেক সময়টা আমার জন্য ছিল খুব কঠিন। বিশ্বরেকর্ড করে ফেলার পর তা নিয়ে যা হয়েছে, সেটি ছিল বড় একটা চাপ। এটা সামলাতে আমার একটু সময় লেগেছে। আমার ক্রিকেটের তাতে ক্ষতিই হয়েছিল। তবে ১৯৯৮-১৯৯৯ এর দিকে আমি আগের রূপে ফিরে আসি। এর পর থেকে বয়স ধরে ফেলার আগ পর্যন্ত আমি অনেক সাফল্যই পেয়েছি।
আমার ক্যারিয়ারটা আসলে তিনটা পর্যায়ে ভাগ করা যায়। ১৯৯৫-এর আগে, ১৯৯৫-এর পরে এবং ১৯৯৮ থেকে শেষ পর্যন্ত। উত্থান-পতন হয়তো ছিল, তবে আমি কোনো কিছুর সঙ্গেই আমার ক্যারিয়ারটা বিনিময় করতে রাজি নই। আমি এটি উপভোগ করেছি। সামর্থ্যের সবটুকু উজাড় করে দিয়েছি। অনেক কিছু শিখেছিও। শুধু ক্রিকেটার হিসেবে নয়, মানুষ হিসেবেও। আমি পরিণত হয়েছি। আমার ক্যারিয়ার নিয়ে আমি খুব গর্বিত।
* বাকি অংশ আগামীকাল

No comments

Powered by Blogger.