প্রশাসনে রাজনৈতিক পদোন্নতি by শওকত ওসমান রচি

শেষ বছরে এসে সরকার প্রশাসনে ঢালাও পদোন্নতি-রদবদল শুরু করেছে। আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখেই এ পদোন্নতি ও রদবদল করা হচ্ছে বলে জানালেন সরকারের সাধারণ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
ইতোমধ্যে প্রশাসনজুড়ে চাউর হয়েছে, এটা রাজনৈতিক পদোন্নতি-রদবদল। আজ থেকে যেকোনো দিন জনপ্রশাসনে ১৭ ভারপ্রাপ্ত সচিবকে সচিব হিসেবে পদোন্নতি প্রদানের ঘোষণা আসবে। এ ব্যাপারে সোমবার সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ডের (এসএসবি) বৈঠকের পর ফাইল এখন প্রধানমন্ত্রীর টেবিলেÑ এ তথ্য দিয়ে কর্মকর্তারা জানান, সরকারের শেষ বছরে শুধু সচিব পদে নয়, উপসচিব থেকে অতিরিক্ত সচিবÑ এ তিন স্তরেও পদোন্নতি প্রদানের প্রক্রিয়া চলছে। এ ব্যাপারে শিগগির এসএসবির বৈঠক ডাকা হচ্ছে বলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা জানান। এসব পদে পদোন্নতির জন্য দলীয় আস্থাভাজনদের একটি তালিকা তৈরি হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বর্তমান আ’লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের আমলে বিগত চার বছরে প্রশাসনে প্রতিবারই পদোন্নতি প্রদানের ক্ষেত্রে দলীয়করণের অভিযোগ উঠেছে। সব ধরনের যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও বঞ্চিত হয়েছেন অনেকেই। আগামীতেও পদোন্নতিবঞ্চিতদের সংখ্যা বেড়ে যাবে বলে আশঙ্কা করছেন ভুক্তভোগীরা। এ নিয়ে প্রশাসনে কর্মকর্তাদের মধ্যে দেখা দিয়েছে গভীর ক্ষোভ ও হতাশা। বর্তমান সরকার ইতোমধ্যে ১৯০৬ জন কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দিয়েছে। তাদের মধ্যে ৬০ জন সচিব, ২৯৩ জন অতিরিক্ত সচিব, ৬৮৮ জনকে যুগ্মসচিব এবং ৮৬৫ জনকে উপসচিব পদে পদোন্নতি দেয়া হয়। অভিযোগ রয়েছে, সব ধরনের যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও প্রায় সমসংখ্যক কর্মকর্তা পদোন্নতিবঞ্চিত হয়েছেন এই চার বছরে। এসব কর্মকর্তার পদোন্নতি-বঞ্চনার বিষয় পুনর্বিবেচনার ঘোষণা দেয়া হলেও অবস্থান পরিবর্তন করে সরকার। ফলে জনপ্রশাসনে সঙ্কটের নতুন নতুন মাত্রা যোগ হচ্ছে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে স্বাভাবিক কাজের গতি আগেই স্তিমিত হয়ে পড়েছে। পরিস্থিতি সামাল দেয়ার বদলে আবারো উপসচিব ও তদুর্ধ্ব মোট চার স্তরে পদোন্নতির উদ্যোগ নেয়ায় প্রশাসনজুড়ে ক্ষোভ আর হতাশা এখন চরমে।

শুধু জনপ্রশাসনই নয়, পুলিশ বিভাগেও ইতোমধ্যে অনেক পদোন্নতি ও বদলির ঘটনা ঘটেছে। এটা অব্যাহত থাকবে বলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। সর্বশেষ গত মঙ্গলবার পুলিশের ৭২ কর্মকর্তাকে বদলি করা হয়েছে। এর আগে গত ১২ জানুয়ারি ৬২ জন কর্মকর্তাকে বিভিন্ন পদে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে ২৫ জন পুলিশ সুপারকে (এসপি) অতিরিক্ত উপ-মহাপরিদর্শক (অ্যাডিশনাল ডিআইজি) পদে এবং ৩৭ জন অতিরিক্ত পুলিশ সুপারকে (অ্যাডিশনাল এসপি) পুলিশ সুপার পদে পদোন্নতি দেয়া হয়।

সোমবার অনুষ্ঠিত এসএসবির বৈঠকে ভারপ্রাপ্ত সচিব থেকে সচিব পদে পদোন্নতির জন্য যাদের নাম প্রস্তাব করা হয়েছে তারা হলেন প্রাথমিক ও গণশিা মন্ত্রণালয়ের নিয়াজউদ্দিন মিয়া, জাতীয় সংসদের মাহফজুর রহমান, শিল্প মন্ত্রণালয়ের মঈনুদ্দিন আব্দুল্লাহ, সেতু বিভাগের খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম, বিদ্যুৎ বিভাগের মনোয়ার ইসলাম, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, পরিকল্পনা বিভাগের ভূঁইয়া শফিকুল ইসলাম, সড়ক বিভাগের এম এ এন সিদ্দিক, খাদ্য মন্ত্রণালয়ের মোশফেকা ইকফাৎ, ভূমি আপিল বোর্ডের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান কাজী আকতার হোসেন, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব খোরশেদ আলম চৌধুরী, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত মিকাইল শিপার, ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের আবু বক্কর সিদ্দিক এবং পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের নজিবুর রহমান।

সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রচলিত আইনে মঞ্জুরিকৃত পদের বিপরীতেই কেবল পদোন্নতি প্রদানের স্পষ্ট বিধান থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। দলীয় কর্মকর্তাদের চাপে পড়ে জুনিয়ররা সিনিয়রদের ডিঙিয়ে পদোন্নতি পাচ্ছেন। বিগত দিনে পদোন্নতি পাওয়া অনেকেই এখনো পদ পাননি। এতে প্রশাসনের শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ছে। পাশাপাশি সরকারি ব্যয়ের স্বচ্ছতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। কর্মকর্তাদের পদোন্নতির সাথে তার বেতনভাতাদিসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা জড়িত। এর জন্য জাতীয় বাজেটে বাড়তি চাপ সৃষ্টি হবে। বর্তমানে বাজেটে সরকারি কর্মচারীদের যানবাহন ব্যয় ছাড়াই রয়েছে ১৫ শতাংশ। এ পদোন্নতিতে ব্যয় বেড়ে যাবে। আগের পদে বহাল রাখায় উপসচিবের কাজ করে একজন কর্মকর্তাকে যুগ্মসচিবের এবং যুগ্মসচিবের কাজ করে একজন কর্মকর্তাকে অতিরিক্ত সচিবের বেতনভাতা ও সুযোগ-সুবিধা দেয়া হবে। এর ফলে রাষ্ট্রের আর্থিক ক্ষতি বেড়ে যাবে। এ ছাড়া তিন স্তরে পদোন্নতিপ্রাপ্ত অনেক কর্মকর্তাকে ওএসডি করে বসিয়ে রেখে বেতনভাতা দিতে হবে। এ প্রসঙ্গে কর্মকর্তারা বলেছেন, পদ সৃষ্টি না করেই পদোন্নতি দেয়ার বিধান রীতিমতো রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। অথচ প্রচলিত আইনে পদ সৃষ্টি করে তবেই পদোন্নতির বিধান স্পষ্ট করা রয়েছে। পদ না থাকলেও বেতন ঠিকই পাবেন। এটিকে আর্থিক শৃঙ্খলাপরিপন্থী বলে তারা মনে করেন। তারা জানান, বিভিন্ন সময় একাধিক নীতিমালা প্রণীত হলেও নিয়োগ, বদলি, পদায়ন, পদোন্নতির েেত্র এসব নীতিমালা মানা হচ্ছে না। সব কিছুই হয় ক্ষমতাসীন সরকারের নীতিনির্ধারকদের ইচ্ছেমাফিক।

প্রচলিত ২০০২ সালের বিধান অনুযায়ী শিক্ষাগত যোগ্যতার জন্য ২৫ নম্বর রয়েছে। বিগত পাঁচ বছরের বার্ষিক বা গোপনীয় প্রতিবেদনের (এসিআর) গড় ৩০ নম্বর, চাকরিজীবনের শুরু থেকে বিগত পাঁচ বছরের আগ পর্যন্ত সব বছরের বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদনের গড় নম্বর ২৫, সামগ্রিক চাকরিজীবনে বার্ষিক গোপনীয় অনুবেদনে কোনো বিরূপ মন্তব্য না থাকার জন্য বোনাস নম্বর ১০ এবং সামগ্রিক চাকরি জীবনে কোনো শাস্তি না থাকার জন্য ১০ নম্বর নির্ধারিত রয়েছে। অন্য দিকে প্রস্তাবিত নতুন বিধিমালা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। প্রচলিত বিধিমালায় ‘চাকরিজীবনের শুরু থেকে বিগত পাঁচ বছরের আগ পর্যন্ত সকল বছরের বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদনের গড় নম্বর ২৫’ বিধানটি সম্পূর্ণ বাতিল করা হবে। ১০০ নম্বরের মধ্যে ‘সাক্ষাৎকার’ এর জন্য ১০ নম্বর রাখার জন্য নতুনভাবে সংযোজন করা হয়েছে, যা ভবিষ্যতে রাজনৈতিক প্রভাবের ক্ষেত্র সৃষ্টি করতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন কর্মকর্তারা। এ ছাড়া শিক্ষাগত যোগ্যতার জন্য ২৫ নম্বর, বিগত পাঁচ বছরের বার্ষিক বা গোপনীয় প্রতিবেদনের গড় ৩০ নম্বরের পরিবর্তে ‘৫০ নম্বর’, সামগ্রিক চাকরিজীবনে বার্ষিক গোপনীয় অনুবেদনে কোনো বিরূপ মন্তব্য না থাকার জন্য বোনাস নম্বর ১০ এবং সামগ্রিক চাকরিজীবনে কোনো শাস্তি না থাকার জন্য ১০ নম্বরের পরিবর্তে ‘৫ নম্বর’ দেয়র প্রস্তাব রাখা হয়েছে।

কর্মকর্তারা জানান, পরীার মাধ্যমে কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দেয়ার বিষয়ে সরকার নীতিগতভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকলেও পরে পিছিয়ে এসেছে। সিদ্ধান্ত হয়েছিল, পরীার মাধ্যমে যিনি পদোন্নতির যোগ্য হবেন, শুধু তিনিই পদোন্নতি পাবেন। প্রতিটি স্তরের সরকারি কর্মকর্তাদের পদোন্নতি পেতে হলে লিখিত পরীায় উত্তীর্ণ হতে হবে। এ জন্য আলাদা একটি বোর্ড গঠন করা হবে। এ বোর্ড জনপ্রশাসনে বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তাদের পদোন্নতির পরীার ব্যবস্থা করবে। কোনো কর্মকর্তা পদোন্নতি পরীায় উত্তীর্ণ হলেই তাকে পদোন্নতি দিতে বাধ্য থাকবে কর্তৃপ। এ েেত্র পদ শূন্য না থাকলেও পদোন্নতি দেয়া হবে। প্রয়োজনীয় যোগ্যতা থাকার পরও পদোন্নতিবঞ্চিত হওয়ার কোনো সুযোগ থাকবে না।

কর্মকর্তারা জানান, চলতি বছর সচিবসহ চার স্তরে পদোন্নতি দেয়ার পরই সরকার পদোন্নতিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন নীতিমালা প্রণয়ন করবে। এর মধ্যে থাকবে ‘সরকারি কর্মচারী আইন-২০১২’। অভিযোগ উঠেছে, সংবিধানে সিভিল সার্ভিস আইনের কথা থাকলেও সরকার প্রায় তিন বছর ধরে সিভিল সার্ভিস অ্যাক্ট প্রণয়নের নামে কালক্ষেপণ করেছে। বিপুল অর্থও ব্যয় হয়েছে এ সময়। সম্প্রতি সরকার সিভিল সার্ভিস অ্যাক্ট প্রণয়নের সে উদ্যোগ বাতিল করে নতুন আইন ‘সরকারি কর্মচারী আইন-২০১২’ প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছে। এর ৫ ধারায় সন্নিবেশিত ‘আউটসোর্সিং’-এর বিধানটি বিতর্কের মধ্যেই থেকে গেল। সরকারের প্রশাসন ক্যাডারসহ ২৬ ক্যাডার ও প্রকৃচির কর্মকর্তারা প্রস্তাবিত আইনের এ ধারাটি বাদ দেয়ার জন্য সোচ্চার। তাদের সাথে যুক্ত হয়েছেন বিভিন্ন সরকারি কর্মচারীদের সংগঠনের নেতৃবৃন্দ। এ ‘আউটসোর্সিং’ নিয়ে ইতোমধ্যে তোলপাড় শুরু হয়েছে জনপ্রশাসনে। বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভে ফুঁসছেন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এ ক্ষোভের মধ্যেও সরকারের নীতিনির্ধারকেরা নতুন এ আইন প্রণয়নে জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। প্রস্তাবিত সরকারি কর্মচারী আইনের খসড়ার ৫ নম্বর ধারায় রয়েছে, সরকার প্রয়োজন মনে করলে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে নির্দিষ্ট শ্রেণী, প্রকৃতি বা কর্মের সেবা সম্পূর্ণ বা আংশিক নিতে পারবে। কোনো নির্দিষ্ট শ্রেণী বা শ্রেণীর কর্ম পর্যায়ক্রমে বিলুপ্ত করতে পারবে। কর্মকর্তারা জানান, আইনের খসড়ার এ ৫ নম্বর ধারা নিয়ে কর্মকর্তারা ইতোমধ্যে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে আপত্তি জানান। তারা বলেন, আউটসোর্সিংয়ের কথা বলে বাইরের লোক নিয়োগ করা হলে সরকারি চাকরিতে বিশেষ করে প্রশাসনে দলীয়করণ প্রাতিষ্ঠানিকতা পাবে। সরকার বাইরে থেকে শীর্ষপর্যায়ে লোক বসালে দলীয় বা পছন্দের লোকই বসাবে। এ ছাড়া এর কারণে কর্মকর্তাদের ওপরে ওঠার সুযোগ কমবে। ওই ধারা নিয়ে আপত্তির বিষয়টি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কেও জানানো হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.