ইতিহাস গড়েছেন নারীরা by মজিবর রহমান

ফুরিয়ে আসছে শীতের আমেজ, বসন্ত আসন্ন। আর মাত্র কয়েকদিন। এর পরই বসন্ত বরণ-ফাল্গুনী হওয়ায় মেতে ওঠার উপলৰ। তবে এর আগেই আগেই যেন বাসন্তি উৎসবের আমেজটা ছুঁয়ে গেল বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনকে।
যে উৎসব দেশবাসীকে ছুঁয়ে গেল তা আমাদের মহিলা ক্রীড়াবিদদের কল্যাণে। দৰিণ এশিয়ার সবচাইতে মর্যাদার ক্রীড়া উৎসব এসএ গেমসের এবারের আসরটাকে শুধু স্মরণীয় করেই নয়, নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করার মধ্য দিয়ে মহিলা ক্রীড়াবিদরা বলতে গেলে মান বাঁচালেন দেশ ও জাতির। মুখ রৰা করলেন স্বাগতিক বাংলাদেশের। নিজ মাটিতে খেলা। নিজেদের চেনা পরিবেশে দেশের ক্রীড়াবিদরা প্রত্যাশার সঙ্গে প্রাপ্তির যোগসূত্র ঘটিয়ে দেশকে উপহার দেবেন কাঙ্ৰিত পদক। এটাই স্বাভাবিক। অনত্মত আয়োজক দেশ হিসেবে এটাই প্রত্যাশা ছিল ক্রীড়াপ্রেমীদের। সেই প্রত্যাশা এবার পূরণ হয়েছে। অতীতের রেকর্ড ভঙ্গ করে খেলোয়াড়রা গলায় ঝুলিয়েছেন এবার ১৮টি স্বর্ণ পদক। যদিও গেমস শুরম্নর আগে খোদ আয়োজক কমিটির পৰ থেকে টার্গেট দেয়া হয়েছিল ১৭টি স্বর্ণ পদকের। অবিস্মরণীয় এই সাফল্যে মুখ্য ভূমিকা রাখে এবার মেয়েরা। যা অনেকটা ছিল অপ্রত্যাশিত, অভাবনীয়। এক কথায় কল্পনার বাইরে। সেই অসাধ্য সাধন করে খেলাধুলায় মেয়েরা প্রমাণ করলেন চেষ্টা থাকলে সম্ভব অসম্ভবকেও জয় করা। বাংলাদেশের ঝুলিতে জমা পড়া ১৮টি স্বর্ণপদকের আটটি উপহার দিয়েছেন মেয়েরা। অথচ গেমস শুরম্নর আগে হিসেবের বাইরে ছিলেন মহিলা ক্রীড়াবিদরা। নিশ্চয়তার পরিবর্তে মেয়েদের নিয়ে শুধু আশার বাণীই শুনিয়েছিলেন কর্মকর্তারা। শেষ পর্যনত্ম বাজিমাত করলেন মেয়েরাই। ইতিহাস সৃষ্টি করা এই সাফল্যে শুধু মুখের প্রশংসাই যথেষ্ট নয়। জাতীয়ভাবে এবার মেয়েদের আলাদাভাবে সম্মান জানানো উচিত। যদিও খাটো করে দেখার সুযোগ নেই ছেলেদের অর্জিত সাফল্যকেও। কারণ সব সাফল্যই সমান কৃতিত্বের। কিন্তু বাংলাদেশের সামাজিক প্রেৰাপট তথা প্রতিবন্ধকতার বেড়াজাল ছিন্ন করে মেয়েদের এই উঠে আসাটা ছিল বিরাট চ্যালেঞ্জের। সঙ্গতকারণে বলতে হয় মেয়েদের অর্জন বাড়তি প্রশংসা এবং কৃতিত্বের দাবি রাখে। সামাজিকতার কারণেই ভারত, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভুটান বা মালদ্বীপের তুলনায় বাংলাদেশের মেয়েরা একটু হলেও রৰণশীল। অবাধ স্বাধীনতা নেই চালচলনে। ফলে খেলাধুলার সঙ্গে জড়িত হওয়ার ৰেত্রেও একটা বিরূপ প্রভাব মোকাবেলা করতে হয় আমাদের মেয়েদের। কিন্তু এবারের এসএ গেমসে সামাজিক প্রতিবন্ধকতাকেও হার মানিয়েছেন বাংলাদেশের মেয়েরা। ঠিক যেভাবে তারা ক্রীড়ামঞ্চে হার মানিয়েছেন প্রতিপৰ দেশগুলোর মেয়েদের। এর বাইরে সীমিত সুযোগ-সুবিধার পাশাপাশি উন্নতমানের প্রশিৰণের অভাবতো রয়েছেই। ভারত-শ্রীলঙ্কার মেয়েরা যে কোন গেমস সামনে রেখে বছরের পর বছর বিদেশে প্রশিৰণের সুযোগ পেয়ে থাকেন। ফলে সাফল্যও তাদের বেশি। আমরা জন্ম দিতে পারিনি পিটি উষা, দামায়েনত্মি দারশা, সুশানত্মিকা, কুহেলি গাঙ্গুলির মতো মহিলা ক্রীড়াবিদ, যাদের টার্গেট থাকে অলিম্পিক থেকে স্বর্ণ কুড়িয়ে আনার। আমাদের না পারার কারণ পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধার অভাব ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিতে না পারা। নিরাপত্তা বলতে আর্থিক নিশ্চয়তা। স্বর্ণ জিতলেই ভারতের মেয়েরা পেয়ে থাকে ১৫ থেকে ২০ লাখ রম্নপী। ফলে একটি স্বর্ণ পদকই জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয় ভারতের একজন মহিলা ক্রীড়াবিদের। প্রায় একই ধরনের সুযোগসুবিধা পেয়ে থাকেন শ্রীলঙ্কার মেয়েরাও। সে তুলনায় আমাদের মেয়েরা কিছুই পান না বললেই চলে। তবে ক্রীড়াপ্রেমী হিসেবে সর্বজন প্রশংসিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘোষণায় অনেকাংশেই এবার অনুপ্রাণিত বাংলাদেশের ক্রীড়াবিদরা। ব্যক্তিগত স্বর্ণ পদকের জন্য পাঁচ লাখ টাকা করে অর্থ পুরস্কার দেয়ার কথা জানিয়েছিলেন তিনি গেমস শুরম্নর আগে। যদিও বর্তমান সময়ে পাঁচ লাখ টাকা কিছুই না। কিন্তু স্বাধীনতার ৩৮ বছরের ইতিহাসে অন্য কোন সরকারের পৰ থেকে এভাবে পুরস্কৃত করা হয়নি। যা করার কথা বলেছেন শেখ হাসিনা। সচ্ছল পরিবারের মেয়েরা এখন খেলাধুলায় আসেন না বললেই চলে। বেশিরভাগ প্রত্যনত্ম গ্রামাঞ্চল, উপজাতি, পাহাড়ী মেয়েরাই বাঁচিয়ে রেখেছেন এদেশের মহিলাদের খেলাধুলার প্রাণপ্রদীপ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেয়া এই পাঁচ লাখ টাকা তাদের কাছে অনেক বড় প্রাপ্তি_ দরিদ্র একটা পরিবারের বেঁচে থাকার বিরাট অবলম্বন। উলেস্নখ্য, বাংলাদেশের খেলাধুলার ইতিহাসে শুটিংয়ের বাইরে তৎকালীন সাফ ও বর্তমান এসএ গেমসে এবারই প্রথম স্বর্ণ জয়ের কৃতিত্ব দেখিয়েছেন মেয়েরা। তাও একটি-দু'টি নয়। শুটিংকে সঙ্গী করে একাধিক। স্বাভাবতই এই প্রাপ্তি খেলাধুলায় নতুন ইতিহাস। যা আগামীর অনুপ্রেরাণা হিসেবে বিরাট অবদান রাখতে সৰম বলে মনে করেন বিজ্ঞ মহল। মেয়েদের সঙ্গে পালস্না দিয়ে ছেলেরাও সামানভাবে পারফর্ম করতে পারলে স্বর্ণপদকের পালস্না আরও অনেক ভারি হতো। কিন্তু হতাশ-নিরাশ যাই বলা হোক না কেন, ছেলেদের সার্বিক রেজাল্ট হতাশ করেছে গোটা জাতিকে। যদিও তা কিছুটা মাটিচাপা দিতে সৰম হয় ফুটবল ও ক্রিকেট। সব প্রাপ্তিই সমান কৃতিত্বের হলেও গেমসের সবচেয়ে দামী সোনা হিসেবে বিবেচিত ফুটবল। দীর্ঘ ১১ বছর পর নিজ মাটিতে আবার সেই অধরা স্বপ্ন পূরণ করেছেন আমিনুলরা। অন্যদিকে প্রথম অনত্মভর্ুক্ত হওয়া ক্রিকেটের (অনূর্ধ-১৯) স্বর্ণও গর্বিত করেছে জাতিকে। ফুটবলে অংশগ্রহণ ছিল আমাদের মেয়েদের। জনপ্রিয় এই ইভেন্টেও মন্দের ভাল হিসেবে পদক এসেছে। অর্থাৎ খালি হাতে মাঠ ছাড়েননি আমাদের মেয়েরা। ভারতে মেয়েদের ফুটবল চর্চা প্রায় বিশ বছরের। আর বাংলাদেশে মেয়েদের আনুষ্ঠানিক ফুটবল প্রচলন মাত্র বছর তিনেকের। এই অল্প সময়ের মধ্যেও মেয়েদের ফুটবলের অগ্রগতি ঈর্ষণীয়। এৰেত্রে অবশ্য প্রশংসার দাবি রাখে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন। বিশেষ করে মেয়েদের ফুটবল সমৃদ্ধ করতে সম্ভাব্য আর্থিক সহযোগিতা ও খেলোয়াড়দের টানা প্রশিৰণের মধ্যে রাখা। বেশিরভাগ মেয়ে ফুটবলারই দরিদ্র উপজাতি। ট্যালেন্টহান্টের মাধ্যমে পাহাড়ী অঞ্চল থেকে সংগ্রহ করা হয় মেয়ে ফুটবলার। ফুটবলার হওয়ার সুবাদে সরকারী চাকরি পেয়েছেন প্রায় অর্ধ শতাধিক মেয়ে। অর্থাৎ মোটামুটি সচ্ছলভাবে বেঁচে থাকার একটা পথ খুঁজে পেয়েছেন মেয়ে ফুটবলররা। এতে উৎসাহিত হচ্ছেন অন্যরাও। বিশেষ করে রাঙ্গামাটি, বান্দরবান এলাকায় এখন নাকি মেয়ে একটু বড় হলেই তাদের বাবা-মা ফুটবলার হওয়ার জন্য অনুপ্রাণিত করে থাকেন। অপেৰায় থাকেন কখন মেয়ে সুযোগ পাবে খেলার। ফুটবলের মতো অন্যসব ইভেন্টে সুযোগসুবিধা কম। ফুটবলের মতো অন্য ক্রীড়া ফেডারেশনগুলোর আর্থিক ভিত তেমন মজবুত না। ফলে ইচ্ছা সত্ত্বেও তাদের পৰে সম্ভব হয়ে ওঠে না মেয়েদের জন্য তেমন কিছু করার। এৰেত্রে সরকারের পৰ থেকে উদ্যোগ নেয়া উচিত। উপজাতি তথা পাহাড়ী মেয়েদের খেলাধুলায় সম্পৃক্ত করতে পারলে সাফল্য নিশ্চিত-প্রমাণ করেছেন এবারের এসএ গেমসে বান্দরবানের প্রত্যনত্ম লামা এলাকার মেয়ে জো উ প্রম্ন। পরাশক্তি ভারত, শ্রীলঙ্কা, নেপাল ও পাকিসত্মানী মেয়েদের টেক্কা দিয়ে স্বর্ণ পদক গলায় ঝুলিয়েছেন কারাতেকা জো প্রম্ন। সাইনু-মাইনু দুই বোনের মতো অগণিত পাহাড়ী মেয়ে ফুটবলে। সচেতন মহলের মতে, ভবিষ্যতে আরও ভাল করতে চাইলে ফেডারেশনগুলোর দিকে না তাকিয়ে সরকারের তরফ থেকেও উদ্যোগ নেয়া উচিত আগ্রহী উপজাতি মেয়েদের খেলাধুলার সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে। পাহাড়ী মেয়েদের বাড়তি সুবিধা বলতে ফিজিক্যাল ফিটনেস। মোদ্দাকথা আর্থিক নিশ্চয়তা পেলে নিজেদের প্রয়োজনেই খেলাধুলায় আসতে বাধ্য তারা। আর এই আর্থিক নিশ্চয়তা দিতে কেবল সরকারই। অনত্মত এবারের সাফল্যের দিকে তাকিয়ে হলেও এগিয়ে আসা উচিত সরকারের।
যাদের নিয়ে আজ গর্বিত গোটা জাতি সেই স্বর্ণকন্যারা হলেন শারমিন আকতার রত্না, সৈয়দা সাদিয়া সুলতানা, তৃপ্তি দত্ত, ইতি ইসলাম, শাম্মি আকতার, শারমিন ফারজানা রম্নমি, জো উ প্রম্ন ও মরিয়ম খাতুন।
কারাতে ও তায়কোয়ান্ডোতেই চমকটা বেশি দেখিয়েছেন মেয়েরা। এর বাইরে সাফল্য বলতে শুটিং ও গলফে। কারাতের চার স্বর্ণ পদকের তিনটিই মেয়েদের। মরিয়ম খাতুন ও জো উ প্রম্নর ব্যক্তিগত সাফল্যের সঙ্গে রয়েছে দলগত স্বর্ণপদক। উশুতে ইতি ইসলাম এবং তায়কোয়ান্ডোতে স্বর্ণপদক জয় করেন শারমিন ফারজানা রম্নমি ও শাম্মি আকতার। শুটিংয়ের এয়ার রাইফেলে শারমিন আকতার রত্না এককের পাশাপাশি দলগত স্বর্ণ জেতেন সাদিয়া ও তৃপ্তিকে নিয়ে ।
প্রসঙ্গত, ১৯৯৩ সালে ঢাকা সাফ গেমসে সর্বাধিক ১১টি স্বর্ণপদক জয় করেছিল বাংলাদেশ। সেবার মেয়েদের অর্জন বলতে ছিল শুটিংয়ের তিনটি। অন্য কোন ইভেন্টে স্বর্ণ স্বাদ নিতে পারেননি মেয়েরা। না পাওয়ার এই বন্ধ্যাত্ব ঘুচিয়ে এবার প্রত্যাশা আর বাসত্মবতার মাঝে দাঁড়িয়ে অবশেষে শুধু স্বর্ণপদকই নয়, নতুন ইতিহাসের জন্ম দিলেন এবার মেয়েরা পুরম্নষদের টেক্কা দিয়ে।
স্বর্ণ পদকের বাইরে সাঁতারে দু'টি রৌপ্য পেয়েছেন মাহফুজা খাতুন। শুটিংয়ে সাদিয়া সুলতানা ও এ্যাথলেটিক্সে সুমিতা রানী। এর মধ্যে স্বর্ণপদক না পাওয়ায় চোখের পানিতে মিরপুর সুইমিংপুলের জল ভারি করেন মাহফুজা। একইভাবে চূড়ানত্ম ঘোষণার আগেই স্বর্ণপদক নিশ্চিত জেনে আনন্দে আত্মহারা হয়েছিলেন সুমিতা নিজের আত্মবিশ্বাস থেকে। কিন্তু দুর্ভাগ্য-ফটো ফিনিশিংয়ে তার পদক গিয়ে দাঁড়ায় রৌপ্যে। অল্পের জন্য হেরে যান এই হার্ডলার।

No comments

Powered by Blogger.