স্মরণ : একজন মহৎ মানুষ : মৌলবী মাদার বখশ by ড. মাহফুজুর রহমান আখন্দ

রাজশাহীর কৃতীসন্তান মৌলবী মাদার বখশ সাধারণ মানুষের ভালোবাসার বন্ধনে নিজেকে সমর্পিত করতে পেরেছিলেন ভালোবাসা দিয়েই। তিনি  স্মরণীয় হয়ে আছেন জনকল্যাণে ব্রতী হয়ে।
বিখ্যাত চলনবিলের অখ্যাত অঞ্চলের সন্তান। নাটোর জেলার সিংড়া উপজেলার স্থাপনদীঘি গ্রামে তার জন্ম, বঙ্গভঙ্গের বছরে অর্থাৎ ১৯০৫ সালের ১৪ ফেব্র“য়ারি। মেঠোপথ আর নৌকাযোগে যাতায়াত করেই অর্জন করেন প্রাথমিক শিা। সে সময় মুসলমানদের শিার সুযোগ লাভ ছিল বিরাট চ্যালেঞ্জ। কাসে সবার পেছনে কিংবা আলাদা বেঞ্চে বসতে হতো তাদের। অবহেলা আর লাঞ্ছনার এমন স্তর মাড়িয়েও মাদার বখশ চৌগ্রামে রাজা রমনীকান্ত কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হাইস্কুল থেকে ১৯২২ সালে ফার্স্ট ডিভিশনে পাস করেন মেট্রিক । রাজশাহী কলেজ থেকে ১৯২৪ সালে আইএ এবং ১৯২৬ সালে বিএ পাস করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে ১৯২৮ সালে কৃতিত্বের সাথে এমএ পাস করেন। পরের বছর কলকাতার রিপন কলেজ থেকে বিএল ডিগ্রিও অর্জন করেন। এরপর পোরশার হাই মাদরাসা এবং মুর্শিদাবাদের সালার হাইস্কুলে শিকতা করেছেন। ১৯৩৪ সালে রাজশাহী জজ কোর্টে আইন পেশায় আত্মনিয়োগ করে অল্প সময়েই খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছতে সম হন। বিশেষ করে অল্প ফি এবং বিনা পয়সায় গরিব অসহায় মানুষের কাজ করার কারণে জনগণের প্রিয় পাত্রে পরিণত হন।

রাজনীতির মাঠেও মাদার বখশ ছিলেন সফল। পাকিস্তান আন্দোলন থেকে শুরু করে জাতির স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে তিনি ছিলেন ত্যাগী ব্যক্তিত্ব। পাকিস্তানের স্থপতি মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ এবং বরেণ্য নেতা শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সাথে রাজনীতি করেছেন। ১৯৪৬ সালে আত্রাই-বাগমারা ও মান্দা নির্বাচনী এলাকা থেকে বঙ্গীয় আইনসভার সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৪৭ থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত তিনি পূর্ব পাকিস্তান আইনসভার সদস্য ছিলেন। ১৯৫০ সালে রাজশাহী পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তিকে তিনি প্রশ্রয় দেননি। দলের চেয়ে দেশকে অনেক বড় করে দেখতেন। দেশ ও জাতির স্বার্থে নিজ দলের বিরুদ্ধাচরণ করেই ভাষা আন্দোলনে সাহসী ভূমিকা পালন করতে পেরেছেন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্র“য়ারি ঢাকায় নির্মম হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ২২ ফেব্র“য়ারি ভুবনমোহন পার্কে প্রতিবাদ সভায় মাদার বখশ দৃঢ়কণ্ঠে ঘোষণা করেন, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি না দিলে আইনসভা থেকে পদত্যাগ করবেন। এ বক্তব্যের প্রোপটে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে তিনি মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ এবং আবুল হাশিমের সাথে কারাবরণ করেন। শিা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতার জন্য ব্যক্তিগত উদ্যোগের সাথে প্রশাসনিক সেতুবন্ধ নির্মাণ করে তিনি রাজশাহীকে শিানগরীতে পরিণত করেন। নিজ গ্রামে স্কুল প্রতিষ্ঠা ছাড়াও রাজশাহীতে ১৯৪৯ সালে বেসরকারি মেডিক্যাল স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন, যা ১৯৫৮ সালে মেডিক্যাল কলেজ ও  হাসপাতালে উন্নীত হয়। ১৯৫৪ সালে রাজশাহী সোবহানিয়া হাইস্কুল (বর্তমানে কোর্ট অ্যাকাডেমি), ১৯৬০ সালে  লক্ষ্মীপুর বালিকা বিদ্যালয়, ১৯৪৭ সালে মুসলিম হাইস্কুল, ১৯৬৭ সালে হোমিওপ্যাথি কলেজ প্রতিষ্ঠাসহ এ অঞ্চলের গণমানুষের শিার উন্নয়নে অসামান্য অবদান রেখে গেছেন। আজকের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম উচ্চ শিাপ্রতিষ্ঠান। এটি প্রতিষ্ঠার পেছনে মাদার বখশের অবদানই ছিল মুখ্য। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামকে রাজশাহীতে আমন্ত্রণ করে নিয়ে আসার পেছনেও তার উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল।

তিনি কর্মজীবন শুরু করেছিলেন শিকতা দিয়ে এবং শেষও করেছেন এর মাধ্যমে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির অনুরোধে ১৯৫৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি আইন বিভাগের খণ্ডকালীন শিক হিসেবে যোগ দিয়ে জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত ওই দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৭ সালের ২১ জানুয়ারি পাড়ি জমান পরপারে, মহান আল্লাহর দরবারে। আজ আমরা তাকে কতটুকু স্মরণ করছি? ১৯৮০ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে তার নামে একটি হল প্রতিষ্ঠিত হলেও সরকারিভাবে তেমন কোনো স্মারক চোখে পড়ে না। রাজশাহী ফায়ার ব্রিগেড থেকে কোর্ট এলাকা পর্যন্ত প্রধান সড়কটি তার নামে নামকরণ করা হলেও কোথাও সাইন বোডে তা লেখা নেই। তার স্মৃতি যতটুকু বেঁচে আছে তা তার সুযোগ্য ছেলে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর মরহুম আবু নাসের মোহাম্মদ সালেহ ও মেয়ে মরহুম বেগম মনোয়ারা রহমান এবং তাদের পরিবারের কৃতিত্ব। মাদর বখশ কেজি স্কুল, মাদার বখশ গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজ প্রভৃতি প্রতিষ্ঠায় তারা অবদান রেখেছেন। আমরা খান মুহাম্মদ ইমাদউদ্দীনের মতো মাদার বখশকেও ভুলতে বসেছি।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

mrakhanda@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.