নতুন বছরে পুরনো গল্প by লুৎফর রহমান রনো

বাংলাদেশের মানুষ বা বাঙালি জাতি স্বভাবতই লড়াকু। লড়ছে বলেই টিকে রয়েছে_অবিরাম লড়ে চলেছে। জিরিয়ে নেওয়ার মতো খানিক অবকাশ পাচ্ছে না এ দুর্ভাগা জাতি। শত শত বছর ধরে লড়ছে, কেবল লড়ছে। জীবনের জন্য কিংবা বলা যায় সুস্থ মানবিক জীবনের প্রয়োজনেই বিশ্রাম অত্যাবশ্যক।
কিন্তু এই মূল্যবান বিশ্রামটুকু নেই। বিশ্রাম ছাড়া সময়ের সঙ্গে সঠিক পথ ও পাথেয়, লক্ষ্য ও লড়ার কৌশল নির্ধারণ বা পুনর্নির্ধারণ করা কঠিন হয়ে ওঠে। তখন অসতর্কভাবে ভুল পদক্ষেপ বিপদ ডেকে আনে_মরীচিকার প্রতারণার ফাঁদে পড়ে অতীতের অনেক অর্জন পর্যন্ত ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। আমরা সেই লড়াকু জাতি_আমাদের নিজেদের জীবনের কথাটি ভাবার ফুরসত নেই। লড়াইয়ের সমূহ ফসল হাতছাড়া হয়ে যায়_হাতিয়ে নিয়ে যায় অদৃশ্য শক্তি।
সত্তরের ঘূর্ণিঝড় থেকে শুরু হয়েছিল আজকের দুই-তিন প্রজন্মের লড়াই_সিডর-আইলা পর্যন্ত এসে অসম যুদ্ধেও জয়ী হয়ে টিকে আছে যে জনগোষ্ঠী, নতুন বছরে তাদের অর্জন-বিসর্জনের হিসাব-নিকাশটা কী নিদারুণ অবহেলিত। প্রকৃতির প্রলয় একসময় থেমে যায়, রাত ভোর হয়, পত্রহীন শাখা-প্রশাখা আবার সবুজে ছেয়ে যায়, কিন্তু বিধ্বস্ত জীবনের হাহাকার যাঁদের প্রজন্মপরম্পরা বিস্তৃত হয়ে চলেছে, তাঁদের কী অর্জন সুদীর্ঘ চলি্লশ বছরের লড়াই শেষে? নতুন বছরে স্মরণ করছি উপকূল অঞ্চলের সংগ্রামী মানুষকে। যাঁদের জীবন আগাগোড়া দুঃখের চাদরে মোড়া। দিন দিন তাঁরা তাঁদের কৃষিজমি হারিয়েছে, ভিটেবাড়ি ছেড়েছে অনেকেই_দেশ আছে, দেশে সরকারি ও বেসরকারি উন্নয়ন কর্মযজ্ঞ চলছে, তাতে অর্জনের অন্ত নেই, তবু হাজার হাজার মানুষ উদ্বাস্তু জীবনযাপন করছে। আসবে জলবায়ু তহবিল, হয়তো ওদের জন্য একটি টিউবওয়েল ও স্যানিটারি ল্যাট্রিন করে দেওয়া হবে_বেশ, এই তো।
পোশাকশিল্পের মাহাত্ম্য বর্ণনা না করলেও চলবে। হাজার কোটি ডলারের রপ্তানি হচ্ছে। দেশের অর্থনৈতিক জগতে সত্যি বিপ্লব ঘটেছে বলা যায়। প্রায় ৩০ লাখ শ্রমিকের কর্মসংস্থানসহ পোশাকশিল্প ঘিরে আরো অনেক আয়-উপার্জনের খাত তৈরি হয়েছে, যা অস্বীকার করা যায় না। তবু মনে একটি সংশয়ের খোঁচা লেগেই থাকে_কর্মসংস্থান হলেই কি দারিদ্র্য ঘোচে, মানুষ বাঁচে, কর্মীদের বাঁচানোর মতো মনোভাব কি থাকে, যাঁরা মুনাফার জন্য কর্মক্ষেত্র সৃষ্টি করেছেন, তাঁদের? যদি কোনো শ্রমবিক্রি পদ্ধতি দাসত্বের শৃঙ্খল পরিয়ে দেয়, সে কর্মক্ষেত্র কিছু দেয় নাকি শুধু শক্তিটুকু নেয়। আর এ দেওয়া-নেওয়ার ভিত্তি যদি বিশ্বের শ্রম আইন মান্য তথা নৈতিক-মানবিক না হয়, তাহলে দাস সৃষ্টি কি দারিদ্র্য মোচনে সহায়ক হতে পারে? পারে না। তাই পোশাকশিল্পের তরক্কির কথা যখন আমরা বলব, অবশ্যই তাঁদের কথাই যেন প্রাধান্য পায়_যাঁদের তারুণ্য ও যৌবন ক্ষয়ে ক্ষয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত এক ঘোরের মধ্যে_মরতে মরতে বাঁচার নিরর্থক স্বপ্ন দেখতে দেখতে। স্মরণ করি নতুন বছরে তাঁদের, যাঁরা গত বছর বেতন বৃদ্ধির দাবিতে পুলিশ-মাস্তানের হাতে নির্যাতিত হয়েছে, যাঁরা নিহত হয়েছেন গুলিতে কিংবা গুম হয়ে। স্মরণ করি গার্মেন্টে আগুনে পুড়ে যাঁরা প্রাণ হারিয়েছেন, তাঁদের। আর প্রার্থনা করি, এসব অসহায় অতিদরিদ্র পরিবারের তরুণ বয়সী জীবনগুলোকে যেন আগুনে না পোড়ানো হয়, প্রার্থনা কোনো পরম শক্তির কাছে। কারণ আগুন ধরে গেলে ঘর থেকে বের হওয়ার পথটুকু যেখানে থাকে না, সিঁড়ি থাকলে গেট থাকে তালাবদ্ধ_এমন অব্যবস্থাই যেখানে এর অনেক ক্ষেত্রে নিয়ম হয়ে আছে, সেসব নিয়ন্তা একটু সচেতন হলেই মঙ্গল।
তথ্যপ্রযুক্তির গল্প তো কল্পনাকেও হার মানায়_এমনই বিপ্লব ঘটে গেছে এ খাতে। এর কল্যাণে সামাজিক-সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ পর্যন্ত পুনর্নির্ধারিত হয়েছে। 'ডিজিটাল সংস্কৃতি'-র উপকারভোগী ওরাই, যাঁদের উপার্জনের হার উঁচুতে। আমরা সরকারি নতুন বেতন স্কেল লক্ষ করলে বৈষম্যের মাত্রা অনুধাবন করতে পারি। নিম্নে চার হাজার, ঊধর্ে্ব চলি্লশ হাজার। তার মানে একটি শ্রেণী কখনোই কোনো যুগের কোনো সংস্কৃতি-সভ্যতার সুফল ভোগ করতে পারবে না। এ হোক না শিক্ষা-চিকিৎসা-আহার-বিহার যেকোনো কিছুই।
নতুন বছরে এই চিরবঞ্চিত কিন্তু লড়াকু মানুষের কথা স্মরণ করি সমবেদনা ও সশ্রদ্ধচিত্তে। আর স্বপ্ন দেখি এমন কোনো শক্তির আবির্ভাবের, যার প্রভাবে আকাশ-পাতাল বৈষম্য-বিপন্ন সমাজে সাম্য না আসুক, একটি ভারসাম্যপূর্ণ সংস্কৃতি সৃষ্টি হবে।

লেখক : সাংবাদিক
ronokk1969@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.