নিঃসঙ্গ ভ্যালেন্টাইন by তৌফিক অপু

শিরিন আক্তার একজন কর্মজীবী নারী। প্রাইভেট অফিসে কাজ করার কারণে নিয়মমাফিক অনেকটা সময় অফিসেই কাটাতে হয়। পঞ্চাশোর্ধ এই মহিলা দুটি কন্যা সনত্মানের জননী।
স্বামী কম্পিউটার এবং আইটি জগতে একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। সংসার জীবনের নানা উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে তার জীবনেও ঘটেছে বড় রকমের একটি ঘটনা। স্বামী ব্যবসায়িক জগতে ব্যসত্ম সময় কাটাতেন বলে সংসারের অন্যান্য যাবতীয় কাজ শিরিন আক্তারকেই সারতে হতো। অফিস সামলে সংসার সামলানো সহজ কথা নয়। তারপরও তিনি তার মেধা এবং কর্মঠতার মধ্য দিয়ে মেয়ে দুটোকে উচ্চ শিৰিত করেছেন। একটি মেয়েকে ডাক্তারি পাস করিয়েছেন এবং অপর জনকে ইঞ্জিনিয়ারিং। সব সফলতা ধরা দেয়ার আগেই তার স্বামী হুট করে দ্বিতীয় বিয়ে করে তার সাজানো সংসার থেকে সম্পূর্ণভাবে আলাদা হয়ে যায়। এমনকি মেয়ে দুটোর ভরণপোষণ পর্যনত্ম শিরিন আক্তারের ঘাড়ে চাপিয়ে চলে যান। এ ঘটনায় মুষড়ে পড়েন শিরিন আক্তার। এতকিছুর পরেও স্বাভাবিক হয়ে ধীরে ধীরে সামলে নিয়েছেন সব কিছু। মেয়ে দুটোকে প্রতিষ্ঠা করিয়েছেন নিজ নিজ পেশায়। চাকরির শেষ প্রানত্মে এসে এখনও নিরলসভাবে শ্রম দিয়ে যাচ্ছেন শিরিন আক্তার। পেশাগত কারণে মেয়ে দুটোকেও ভীষণ ব্যসত্ম সময় কাটাতে হয়। যার ফলে বেশিরভাগ সময়ই বাসায় ফিরে একা একা সময় কাটাতে হয়। ইদানীং নিজেকে খুব একা মনে হয় তার। তার ধারণা, ধীরে ধীরে জড় পদার্থে পরিণত হচ্ছেন তিনি। সবকিছুই ছন্দহীন লাগছে। মনের অভিব্যক্তি প্রকাশ করার মতো কাউকে কাছে না পাওয়ার বেদনা কুঁরে কুঁরে খাচ্ছে। অসম্ভব এক অস্থিরতা বোধ করছেন শিরিন আক্তার। তার জীবন যেন আর চলতে চাইছে না। তিনি অনুভব করছেন একজন মানুষকে যার সঙ্গে অনেক না বলা কথাগুলো শেয়ার করে স্বাচ্ছ্যন্দবোধ করা যায়। তিনি সিদ্ধানত্ম নেন বিয়ে করার। কিন্তু আমাদের সমাজ ব্যবস্থা কি তা মেনে নেবে_এই টেনশনে তিনি আরও ব্যাকুল হয়ে পড়েন। না পারছেন সমাজের শৃঙ্খল ভাঙাতে, না পারছেন সনত্মানদের সব কথা খুলে বলতে। চরম এক দ্বিধাদ্বন্দ্বে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন তিনি। পরিণত বয়সেও যে কাউকে ভালবাসার সাধ জন্ম নিতে পারে তা শিরিন আক্তারের কেস স্টাডির মাধ্যমেই বোঝা যায়।
নাজমুল হাসান এবং সালমা হাসান দু'জনই শিৰিত এবং সম্ভ্রানত্ম বংশের সনত্মান। পারিবারিক সম্মতিতেই তাদের বিয়ে সম্পন্ন হয়। যৌথ ফ্যামিলিতে বসবাস করলেও নাজমুল হাসানের ট্রান্সফারের কারণে অন্য জেলায় গিয়ে বসবাস করতে হয় তাদের, এবং দীর্ঘকাল তারা ওই জেলাতেই জীবনযাপন করছেন। এই পথপরিক্রমায় তারা দুই ছেলে এবং এক মেয়ের বাবা-মা হন। প্রত্যেক সনত্মানকে নিশ্চিত ভবিষ্যত গড়ে দেয়ার কাজ সুচারম্নরূপ সম্পন্ন করার চেষ্টা করেছেন। মেয়ের বিয়ে দেয়ার পর হঠাৎ করেই মারা যান নাজমুল হাসান। ছেলেদের পড়ালেখা শেষ করানোর সম্পূর্ণ দায়িত্ব এসে পড়ে সালমা হাসানের ওপর। সবকিছু সামলে নিয়ে বাসত্মব অবস্থা খুব দৃঢ়তার সঙ্গে পরিচালনা করেন সালমা হাসান। বড় ছেলে একটি প্রাইভেট কোম্পানির উচ্চপদে যোগ দিয়ে দেশের বাইরে পোস্টিং হয়ে চলে যায় এবং ছোট ছেলেও উচ্চ শিৰার জন্য বিদেশে পাড়ি জমায়। যার ফলে ভীষণ একা হয়ে পড়েন সালমা হাসান। দিনের পর দিন একাকী জীবন তাকে অস্থির করে তুলেছিল। মায়ের এ দুঃখ সনত্মানরা বুঝতে পারে। মায়ের একাকিত্ব ঘোচাতে সনত্মানরা উদ্যোগী হয়ে সিদ্ধানত্ম নেয় মাকে আবার বিয়ে করানোর। যাতে করে মা এই বয়সে একটু নির্ভরতা খুঁজে পায়। প্রথমদিকে মায়ের অমত থাকলেও সনত্মানদের অনুরোধে শেষ পর্যনত্ম রাজি হন। আসলে এই বয়সে বিয়ে করার অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে নির্ভরতা। শারীরিক চাহিদা নয়, মানসিক শেয়ারিংই মুখ্য। প্রৌঢ় বয়সের অবলম্বন হিসেবে একে অন্যকে কাছে পাওয়ার আকাঙ্ৰা অন্যরকম ভালবাসার জন্ম দেয়।
সাইফ আহমেদ এবং সুলতানা রাজিয়া দু'জনই বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী ছিলেন। এক সঙ্গে পড়ার সময়ে দু'জনের মধ্যে ভাল বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। হয়তো পছন্দও করত একে অন্যকে। কিন্তু কখনই কেউ তা প্রকাশ করেনি। ছাত্রাবস্থায় বিয়ে হয়ে যায় সুলতানার। পড়াশোনা শেষ করে শিৰকতা পেশায় নিজেকে ব্যসত্ম করে ফেলেন সাইফ। নিয়মিত না হলেও যোগাযোগ ছিল দু'জনের মধ্যে। এক সময় সাইফও বিয়ে করে সংসারি হয়। চাকরি, সংসার নিয়ে বেশ ব্যসত্ম সময় কাটে তার। বিদেশ থেকে ডিগ্রী নেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করা ইত্যাদিতে সময় গড়িয়ে যায়। হঠাৎ একদিন সংবাদ পান সুলতানার স্বামী রোড এ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছে। সমবেদনা জানাতে ছুটে যান সাইফ। সুলতানাকে সানত্ম্বনা দেয়া ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না তার।
কিন্তু নিজের জীবনেও যে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে যাবে তা তিনি কল্পনাও করেননি। বেশ কয়েকদিন জ্বরে ভোগার পর সাইফ তার স্ত্রীকে হাসপাতালে ভর্তি করান। কয়েক দফা টেস্ট করানোর পর ডাক্তাররা জানান তার স্ত্রীর বস্নাড ক্যান্সার হয়েছে। মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। ছেলেমেয়েরা যার যার সংসার নিয়ে আলাদাভাবে বসবাস করত। মায়ের এমন সংবাদে ছুটে আসে সবাই। কিন্তু অনেক চেষ্টার পরও সাইফ তার স্ত্রীকে বাঁচাতে পারলেন না। প্রচ- মানসিক আঘাত পান। তার ওপর ছেলেমেয়েরা দূরে দূরে থাকাতে মনের কষ্ট লাঘব করার মতো কাউকে কাছে পাননি সাইফ। এ সময় তার পুরনো বন্ধু সুলতানা তাকে আশ্বসত্ম করেন ভেঙ্গে না পড়ার জন্য। মাঝে মধ্যে ফোনে কথা বলে তারা একে অন্যের সুখ-দুঃখ শেয়ার করেন। এক সময় দু'জনই অনুভব করলেন কথা বলার জন্য বা একটু নির্ভরতার জন্য একজন মানুষ দরকার। এই বয়সে একা থাকতে অনেকটা ভয়ও লাগে এ রকম অনুভূতি থেকেই তারা দু'জনে সিদ্ধানত্ম নেন এক হওয়ার। বিয়ে করেন তারা। শেষ জীবনে একে অন্যকে সঙ্গী হিসেবে পেয়ে অনেকটা নির্ভর দু'জনে।
আজকাল এমন অনেক ঘটনা ঘটছে। আমাদের সমাজের প্রথাগত রীতিনীতির কারণে অনেকেই নিজের একাকিত্ব ঘোচাতে সাহস পান না। জীবনের অনেকগুলো অধ্যায় ব্যসত্মতায় কাটানোর পর একটা সময় মানুষ নিজেকে নিঃসঙ্গ অনুভব করে। বিশেষ করে চলার পথের সঙ্গী হারানোর দুঃখ ভার বহন করাটা বেশ দুরূহ হয়ে পড়ে। যুগে যুগে বহু কবি-সাহিত্যিকরা প্রেম-ভালবাসা নিয়ে বহু গল্প, কবিতা, উপন্যাসই লিখেছেন যার অধিকাংশই তরম্নণ-তরম্নণী জুটি নিয়ে লেখা। যে কারণে প্রেম-ভালবাসা বলতে আমরা এই সত্মরের প্রেমকাহিনীকেই বুঝি। যার ফলে অন্যান্য সত্মরের ভালবাসার তীব্রতা আমরা অনুভব করি না। অথচ ভালবাসা সব সময়ই শাশ্বত সুন্দর। প্রাধান্যতার বিচার ব্যাখ্যার প্রয়োজন পড়ে না। অথচ সব বুঝেও ভালবাসার প্রকৃত মূল্যায়ন আমরা কখনই করতে পারি না। এর গভীরতা পরিমাপ করার প্রয়োজনও বোধ করি না। এ কারণে উচিত যে কোন সত্মরের ভালবাসার গভীরতা পরিমাপ করে সেভাবে মূল্যায়ন করা।

No comments

Powered by Blogger.