মার্চেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হচ্ছে, ফেব্রুয়ারিতে প্রস্তুতি শেষ- জামায়াতের উস্কানি সত্ত্বেও by বিকাশ দত্ত

 যত বাধা বিপত্তি আসুক না কেন মার্চ মাস থেকেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কাজ শুরু হবে। সরকার পিছু হটবে না। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি।
চলতি মাসে পুরনো হাইকোর্ট ভবনে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য আনুষ্ঠানিক সমসত্ম কাজ সম্পন্ন করা হবে। এরপর মার্চ মাস থেকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যক্রম শুরু করবে সরকার। জাতি অধীর আগ্রহে অপেৰা করছে ইতিহাসের ধিকৃত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দেখার জন্য। প্রাথমিক পর্যায়ে তদন্ত করে যাদের বিরুদ্ধে উপাদান পাওয়া যাবে তাদেরই অভিযুক্ত করা হবে। এদিকে যখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার, তখনই দেশব্যাপী জামায়াতে ইসলমীর অঙ্গ সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবির শিৰাঙ্গনে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করছে। আওয়ামী লীগ ৰমতায় আসার পর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যার বিচার হয়েছে। বিচারের পর অভিযুক্ত খুনীদের ফাঁসি কার্যকর করাও হয়েছে। সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের রায় আপীল বিভাগ বহাল রেখেছে। এসব কারণে স্বাধীনতার শত্রম্ন জামায়াত-শিবির যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ভ-ুল করতেই দেশব্যাপী ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে। দীর্ঘ ৩৪ বছর পর বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হয়েছে। ৩৮ বছর পর হলেও সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করবেই।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য ২০০৯-১০ অর্থবছরে ১০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। নিজস্ব আইনে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কাজ শুরম্ন হবে। এখন পর্যনত্ম দেশে কতজন যুদ্ধাপরাধী আছে তার নির্দিষ্ট কোন তালিকা নেই। গণতদনত্ম কমিশন, সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম, ইসলামী ঐক্যজোটের হাতে কিছু তালিকা রয়েছে। সরকার নিজস্ব তদনত্ম সংস্থা এবং অন্যদের কাছ থেকে এ ব্যাপারে সহযোগিতা পাবে বলে জানা গেছে। ইতোমধ্যে সরকার বেশ কিছু জামায়াত নেতার গতিবিধির ওপর তীৰ্ন নজর রেখেছে। তাদের বিদেশ যাওয়ায় নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।
তদনত্ম কাজ মার্চ থেকে শুরম্ন
আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেছেন, মার্চ থেকেই ইনভেস্টিগেশন শুরম্ন হবে। পুরনো হাইকোর্ট ভবনেই ট্রাইবু্যনাল বসানো হবে। সেখানেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কাজ চলবে। এছাড়া ফেব্রম্নয়ারি মাসের মধ্যে বিচারকের বসার স্থান, সাংবাদিক, বিদেশী পর্যবেৰক, আসামিদের বসার স্থান, বিদেশী আইনজীবী, মানবাধিাকর কমর্ী, সিকিউরিটিদের বসার জায়গা ঠিক করা হবে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ভ-ুল করতে জামায়াত-শিবির যত উস্কানি দিক না কেন যথাসময়েই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কাজ শুরম্ন হবে। দেশে কতজন যুদ্ধারাধী আছে, এ প্রসঙ্গে আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেছেন, এটা এখনও সরকারের হাতে নেই। তদনত্ম সংস্থা প্রাথমিকভাবে তদনত্ম করে যাদের বিরম্নদ্ধে উপাদান পাবে তাদের বিরম্নদ্ধে অভিযোগ আনা হবে। রিপোর্টের ভিত্তিতেই ব্যবস্থা নেয়া হবে। তিনি আরও বলেন, যেহেতু এটি একটি আনত্মর্জাতিক মানের বিচার, সে কারণেই সব কিছু ঠিক করেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরম্ন হবে।
তদনত্ম কমিটি গঠন না করলে বিচার নিরর্থক
আপীল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মোঃ গোলাম রাব্বানী জনকণ্ঠকে বলেছেন, অনতিবিলম্বে তদনত্ম সংস্থা গঠন না করা পর্যনত্ম যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা হবে এ কথা বলা নিরর্থক। তদনত্ম সংস্থা যে কোন স্থানে বসে কাজ শুরম্ন করতে পারে। এ ব্যাপারে তিনি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বেশ কিছু তথ্য তুলে ধরেন।
১৯৭৩ সালের আনত্মর্জাতিক অপরাধসমূহ (ট্রাইবু্যনাল) আইনে বর্ণিত কার্যক্রমকে ৩ ভাগে ভাগ করা যায়। আইনটির ৮ ধারায় বলা আছে, এই আইনে নির্দিষ্ট অপরাধগুলোর তদনত্মের উদ্দেশ্যে সরকার স্বাধীন একটি এজেন্সি প্রতিষ্ঠা করবে। আইনটির ৭ ধারায় বলা আছে যে, সরকার যুদ্ধাপরাধীদের অভিযুক্ত ব্যক্তিদের ট্রাইবু্যনালের সামনে সোপর্দ করার জন্য সরকার আইনজীবী বা প্রসিকিউটর নিয়োগ দেবে। আইনটির ৬ ধারায় বলা আছে যে, গেজেট বিজ্ঞপ্তি দিয়ে সরকার এক বা একাধিক ট্রাইবু্যনাল গঠন করবে।
দেখা যাচ্ছে, সরকারের প্রথম কাজটি হলো তদনত্ম বা এজেন্সি গঠন করা। এবং তদনত্ম বা এজেন্সি কর্মকর্তা কর্তৃক যুদ্ধাপরাধীদের শনাক্ত ও তাদের বিরম্নদ্ধে সাৰ্য গ্রহণ করা হলে আর কোন কার্যক্রম তাৎৰণিক প্রয়োজন নেই। যুদ্ধারাধীদের শনাক্ত ও অভিযুক্তদের নাম প্রস্তুত করা হলেই প্রসিকিউটর বা সরকারী আইনজীবী নিযুক্তির প্রয়োজন হবে। তারপর ট্রাইবু্যনাল গঠন করতে হবে। আইনটির ১০ ধারায় বিচারের কার্যপ্রণালী বলা আছে। এবং ৯ ধারায় মামলা রম্নজু করার নিয়মাবলী আছে। উপরোক্ত ৯ ধারার ৩য় দফায় বলা হয়েছে, মুখ্য প্রসিকিউটর মামলা রম্নজু হবার কমপৰে ৩ সপ্তাহ পূর্বে সাৰীগণের লিপিবদ্ধ বিবৃতি প্রদান করবেন।
দেশে কতজন যুদ্ধাপরাধী আছে
দেশ স্বাধীন হবার পর মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা হয়েছে। অথচ ৩৮ বছর পরও যুদ্ধাপরাধীদের কোন তালিকা করা হয়নি। কোন সরকার এই তালিকা তৈরির ব্যাপারেও উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিসত্মানের সেনাবাহিনীর দোসর রাজাকার, আলবদর, আলসামসই হলো যুদ্ধাপরাধী। এদের বেশিরভাগই জামায়াত নেতা। যদিও কিছু বিএনপি নেতাও এই তালিকার মধ্যে পড়ে যাচ্ছে। ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইম ট্রাইবু্যনাল এ্যাক্ট ১৯৭৩-এর অধীনে সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবি করে আসছে। '৭১ সালে যুদ্ধাপরাধীরা নিরীহ নারী-পুরম্নষ-শিশুদের ওপর নির্বিচার গণহত্যা, ধর্ষণ, অগি্নসংযোগ ও ধ্বংসাত্মকের মতো মানবতা বিরোধী কাজের সাথে লিপ্ত ছিল। সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই একটি যুদ্ধাপরাধীদের প্রাথমিক তালিকা তৈরি করে। ঐ তালিকায় ৫০ জন যুদ্ধাপরাধীর নাম স্থান পায়। তালিকায় যাদের নাম রয়েছে তারা হলো জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযম, বর্তমান আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, মাওলানা একেএম ইউসুফ, মাওলানা দেলোয়ার হোসাইন সাঈদী, মোঃ কামারম্নজ্জামান, মাওলানা আব্দুর রহিম, আব্বাস আলী খান, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, আব্দুল কাদের মোলস্না, মোঃ হামিদুল হক চৌধুরী, খাজা খায়েরম্নদ্দিন, মাহামুদ আলী, মোঃ আব্দুল আলীম, এএমএস সোলায়মান, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, ফজলুল কাদের চৌধুরী, জুলমত আলী খান, কাজী কাদের, খান আব্দুস সবুর খান, মাওলানা ফরিদ আহমেদ, শাহ মোঃ আজিজুর রহমান, মাওলানা আব্দুল মান্নান, ডা. আবু মোতালেব মালেক, মোঃ ইউনুস, এবিএম খালেক মজুমদার, এএসএম ইউসুফ, নুরম্নল আমিন, একিউএম শফিউল ইসলাম, আব্দুল মতিন, এ্যাডভোকেট মোঃ আইনুদ্দিন, মাওলানা নুরম্নজ্জামান, মাওলানা মোঃ ইসহাক, গোলাম সরোয়ার, মোঃ আকতার উদ্দিন আহমেদ, মাওলানা আব্দুল সোবহান, ক্যাপ্টেন (অব) আব্দুল বাছেদ, আব্দুল মতিন ভুঁইয়া, মোঃ আব্দুল কাশেম, ওবায়দুলস্নাহ মজুমদার, মীর কাশেম আলী, ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল জব্বার, মওলানা আবুল কালাম আজাদ, মোঃ আব্দুল হান্নান, ব্যারিস্টার কোরবান আলী, আশরাফ হোসাইন, এ্যাডভোকেট আনসার আলী, মোঃ কায়সার, আব্দুল মজিদ তালুকদার, নওয়াজেস আহমেদ, একে মোশাররফ হোসেন। এদের মধ্যে অনেকে ইতোমধ্যে মারা গেছেন।
সরকারের আনত্মরিকতার অভাব নেই
'৭১-এর ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির জনকণ্ঠকে বলেছেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে সরকারের আনত্মরিকতার কোন অভাব নেই। নিরপেৰ কর্মকর্তাদের নিয়েই তদনত্ম সংস্থা, আইনজীবী নিয়োগ করতে হবে। কারণ এটি একটি স্পর্শকাতর বিষয়। সৎ, দৰ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসীদের নিয়েই সব কিছু করতে হবে। তা না হলে বিচার প্রহসন হবে। যুদ্ধাপরাধীদের তালিকা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সরকারের পাশাপাশি অন্য যে সমসত্ম সংগঠন আছে তাদের সহায়তা নিয়েই একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রস্তুত করা। ১৯৯২ সালের ১৯ জানুয়ারি জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের যে প্রক্রিয়া চলে আসছে, তা মার্চের বিচার কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে পূর্ণতা পাবে। ওদিকে জাতায়াত ইসলামীও বসে নেই। জামায়াতের পৰে ১০০ আইনজীবী লন্ডনে বসে আছে। দেশেও একটি আইনজীবী প্যানেল প্রস্তুত রাখা হয়েছে। ব্যবস্থা বুঝেই তারা কার্যক্রম শুরম্ন করবে।

No comments

Powered by Blogger.