‘পলাতক আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া কতটা ন্যায়বিচার, সে ব্যাপারে দ্বিমত রয়েছে’

বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেছেন, ‘একজন পলাতক আসামিকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান কতটা ন্যায়বিচারভিত্তিক সে ব্যাপারে আমার দ্বিমত রয়েছে।
পাকিস্তানি বাহিনীর ১৯৫ জন চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীকে এবং তৎকালীন প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্বে যারা ছিল তাদেরও যদি কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হতো তবেই বিচারের সার্থকতা খুঁজে পাওয়া যেত। কিন্তু তাদের বাদ দিয়ে বিশেষ ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে সাজা প্রদান কতটা সার্থকতা বয়ে আনবে এবং জনগণ তা কতটা মেনে নেবেন সে ব্যাপারে আমি সন্দিহান।’

একাত্তরে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় বিশিষ্ট ইসলামি ব্যক্তিত্ব মাওলানা আবুল কালাম আযাদের ফাঁসির আদেশের পর নয়া দিগন্তকে দেয়া এক প্রতিক্রিয়ায় তিনি এ কথা বলেন। গতকাল সোমবার বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এ রায় ঘোষণা করেন। মুক্তিযুদ্ধকালে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় করা মামলার প্রথম এ রায় নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের বেশির ভাগ সিনিয়র আইনজীবীরা কোনো প্রতিক্রিয়া জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেন।

অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, ‘মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে যে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়েছিল সেই ট্রাইব্যুনালের একজন পলাতক আসামি মাওলানা আবুল কালাম আযাদ। ফৌজদারি দণ্ডবিধি অনুসারে যে অপরাধগুলোর বিচার সম্ভব একজন পলাতক আসামির সেই অপরাধগুলোর জন্য ট্রাইব্যুনাল তাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন। আসামি পলাতক থাকলে ফৌজদারি কার্যবিধি অনুসারে মৃত্যুদণ্ডের ক্ষেত্রে হাইকোর্ট বিভাগ থেকে রায় অনুমোদনের পর কার্যকর করা হয়। কিন্তু ট্রাইব্যুনালের ক্ষেত্রে আপিল করতে হবে সরাসরি আপিল বিভাগে। এ ক্ষেত্রে যেহেতু আসামি পলাতক, সেহেতু ট্রাইব্যুনালের আদেশই চূড়ান্ত।’

তিনি আরো বলেন, ‘একজন পলাতক আসামিকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান কতটা ন্যায়বিচারভিত্তিক সে ব্যাপারে আমার দ্বিমত রয়েছে। তা ছাড়া মানবতাবিরোধী অপরাধের নামে যে ব্যক্তিকে সাজা দেয়া হলো, তা তখনই আমাদের কাছে ন্যায়সঙ্গত ও উৎসাহব্যঞ্জক হতো, যদি দণ্ডিত ব্যক্তির সাথে যাদের ছত্রছায়ায় ও প্রত্যক্ষ মদদে এই কথিত জঘন্য অপরাধগুলো সংঘটিত হয়েছে। পাকিস্তানি বাহিনীর ১৯৫ জন চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীকে এবং তৎকালীন প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্বে যারা ছিল তাদেরও যদি কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হতো তবেই বিচারের সার্থকতা খুঁজে পাওয়া যেত। কিন্তু তাদের বাদ দিয়ে বিশেষ ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে সাজা প্রদান কতটা সার্থকতা বয়ে আনবে এবং জনগণ তা কতটা মেনে নেবেন সে ব্যাপারে আমি সন্দিহান।’

তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের সব মানুষই যুদ্ধাপরাধের বিচার চায়। কিন্তু সে বিচার কোনো রাজনৈতিক প্রতিহিংসার জন্য বা কোনো বিশেষ ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে কাঠগড়ায় দাঁড়া করানোর জন্য করা হলে তা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। আমি মনে করি, এই বিচার জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য হবে না।’

বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদিন বলেন, এটা সর্বপ্রথম রায়। এই রায়ের জন্য আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছি, তারা অধীর অগ্রহে অপো করেছি। রায়ে আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে। এটি নিয়ে এখনই কিছু বলা যাবে না। রায়ের অনুলিপি দেখে বলতে হবে। তিনি আরো বলেন, ‘তবে রাজনৈতিক মহলে এর খুব একটা প্রভাব থাকবে বলে আমার মনে হয় না। এটা দুই পরে যুক্তিতর্কের মাধ্যমে হলে ভালো হতো। বিষয়টি হয়েছে একতরফা। যাদের বিচার আগে শুরু হয়েছে, তাদের বিচারের রায় এখনো হয়নি। এটা অভিযুক্তের আইনজীবী না থাকায় এই বিচার তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেছে।’

তবে এ বিষয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেননি সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক। এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে ব্যারিস্টার রফিক-উল হক বলেন, ‘আমি রায় সম্পর্কে কিছুই জানি না, কোনো বক্তব্য দেবো না।’ এ দিকে প্রতিক্রিয়ার ব্যাপারে একই অবস্থানে আছেন বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা। এ ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে কোনো প্রতিক্রিয়া জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেন ব্যারিস্টার মওদুুদ আহমদ, ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া, ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকনসহ অন্যরা।

সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার এম আমীর-উল-ইসলাম বলেন, ‘একাত্তরের যে জঘন্যতম গণহত্যা হয়েছিল তার প্রথম রায়ের মধ্য দিয়ে জাতির ৪২ বছরের গ্লানি মুক্তির সূত্রপাত ঘটেছে আজ (সোমবার)। জাতি মৌলিক মূল্যবোধ পুনঃস্থাপন করার পথে এক ধাপ এগিয়ে গেছে। কোনো অপরাধী আইনের ঊর্ধ্বে থাকবে না। যুদ্ধের সময় যারা নির্যাতিত তাদের অনেকে জীবিত নেই। এ রায়ের মাধ্যমে তাদের আত্মা স্বস্তি ও শান্তি পাবে। এটা প্রতিশোধমূলক নয়, তবে এটা প্রতিষেধকমূলক। এর মাধ্যমে বিভিন্ন অপরাধ প্রশমিত হবে।’

No comments

Powered by Blogger.