দক্ষিণ সুদানে মনিরের টেলিবিপ্লব by হাসান ইমাম

তখন দক্ষিণ সুদানে চলছে স্বাধীনতার লড়াই। সর্বত্র যুদ্ধের দামামা। পদে পদে মৃত্যুঝুঁকি। এসব জেনেও মনির সরকার পোল্যান্ডভিত্তিক তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ট্রাইকম্পের চাকরি নিয়ে সেখানে যান। ২০১১ সালে স্বাধীন হয় দক্ষিণ সুদান।
স্বাধীন রাষ্ট্র, তাই আন্তর্জাতিক টেলিযোগাযোগের জন্য এর প্রয়োজন একটি কান্ট্রি কোড। দক্ষিণ সুদানের জন্য ২১১ কান্ট্রি কোডটি তৈরির ব্যাপারে সহায়তা করলেন কুমিল্লার বুড়িচংয়ের ছেলে মনির সরকার। এখন সে দেশে তারহীন ইন্টারনেট সংযোগ দেওয়ার একটি প্রতিষ্ঠানও গড়ে তুলেছেন।
২০০৯ সালে প্রথম যখন মনির চাকরি নিয়ে দক্ষিণ সুদানে যান, তখন পুরো দেশ অস্থির। বাইরে বেরোলেই স্থানীয় লোকেরা তাঁকে ডাকত ‘মুইন্ডি’ বলে। একদিন জানলেন, মুইন্ডি মানে ইন্ডিয়ান। সেদিন থেকেই প্রতিবাদ মনির সরকারের। কেউ মুইন্ডি বলে ডাকলে তাকে বুঝিয়ে দিতেন, ‘আমি আসলে বাংলাদেশি।’
২০১১ সালে দক্ষিণ সুদান স্বাধীন হওয়ার সময়টাতেও তিনি সেখানে কর্মরত ছিলেন। নতুন দেশের টেলিযোগাযোগের জন্য দরকার একটা কান্ট্রি কোড। আইডিয়াটা এল মনির সরকারের মাথা থেকেই। সে দেশের কান্ট্রি কোড ডিজাইন সভায় তিনি জানালেন, কোডটা হতে পারে ২১১। যুক্তি হিসেবে দেখালেন, ২০১১ সাল এ দেশের স্বাধীনতার বছর। একবাক্যে পছন্দ করলেন সবাই। দক্ষিণ সুদান সরকার সেই প্রস্তাব পাঠাল আন্তর্জাতিক টেলিযোগাযোগ ইউনিয়নে (আইটিইউ)। ফাঁকা থাকায় সহজেই অনুমোদন হলো ২১১ কোডটির। দক্ষিণ সুদানের ইতিহাসে এ কারণে জড়িয়ে থাকল মনির সরকার, একই সঙ্গে বাংলাদেশের নামটিও।
কান্ট্রি কোড ছাড়াও মনির সরকার ডিজাইন করেছেন দক্ষিণ সুদানের ‘ন্যাশনাল ডায়ালিং প্ল্যান’। এ ছাড়া দেশটির প্রশাসনিক কর্মকর্তা, পুলিশ বা সামরিক কর্মকর্তাদের জন্য ব্যবহূত বিশেষ নম্বর তৈরিতেও পরামর্শক হিসেবে কাজ করেন তিনি। বিপদ-আপদে ৯৯৯-এ ডায়াল করে পুলিশের জরুরি সেবা পাওয়ার কারিগরি পরিকল্পনাও করে দেন মনির সরকার।
দক্ষিণ সুদানের টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা মোটামুটিভাবে চালু হলেও মুঠোফোন ও ইন্টারনেট সংযোগসেবা দিতে গিয়ে বাধে বিপত্তি। কারণ, দেশটি কোনো ফাইবার অপটিক কেব্ল নেটওয়ার্কে যুক্ত নয়। তাই ভি-স্যাট দিয়ে কৃত্রিম উপগ্রহনির্ভর ইন্টারনেট সংযোগ চালু করা হলো।
মনির বললেন, ‘দক্ষিণ সুদান সরকারের কাছে একটা পরিকল্পনা জমা দিয়েছিলাম ওয়াইম্যাক্স নেটওয়ার্ক স্থাপনের। পরিকল্পনাটি কর্তৃপক্ষের পছন্দ হলেও, পর্যাপ্ত তহবিল না থাকায় পিছিয়ে গেল সরকার।’
তার পরও লেগে ছিলেন তিনি। বললেন, ‘বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে যখন ওখানে কাজ করার অনুমতি দেওয়া হলো, তখন নিজেই ঝুঁকি নিয়ে শুরু করলাম।’ ফাস্ট নেটওয়ার্ক লিমিটেড নামে যাত্রা শুরু হলো দক্ষিণ সুদানের প্রথম ওয়াইম্যাক্স-সেবার। জানালেন, দেড় বছরের ব্যবধানে তাঁর কোম্পানির মূলধন এখন ৩ কোটি ডলার ছাড়িয়ে গেছে।
মনির সরকার দক্ষিণ সুদানে ফ্যাবমস নামে একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র চালু করেছেন। যেখানে আধুনিক তারহীন প্রযুক্তির নানা বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
বিদেশে ব্যস্ততা অনেক। তার পরও নিয়মিত দেশে আসেন স্ত্রী শারমিন সুলতানা ও মেয়ে ফাবলিহা শারাকে নিয়ে। মনির সরকারের জন্ম ১৯৮১ সালে। ছোটবেলাতেই ঢাকায় চলে আসেন চাচা হান্নান সরকারের কাছে। সেখানেই তাঁর বেড়ে ওঠা। তবলা বাজানো ছিল নেশা। স্নাতক পড়ার সময় এটাকে পেশা হিসেবে বেছেও নিতে চেয়েছিলেন। মুন্সিগঞ্জ থেকে ঢাকায় ফিরে টেলিযোগাযোগ বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন। এরপর কয়েক বছর ব্র্যাকনেটসহ কয়েকটি তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। সুদানে চাকরি নিয়ে যাওয়াটা মনির সরকারের পেশাগত জীবনে এক বড় বাঁক। মনির বলেন, ‘সুদানে আমার নানা ধরনের সমস্যা হতো। যুদ্ধবিধ্বস্ত সদ্য স্বাধীন একটি দেশে কিছু সমস্যা তো থাকবেই। তবে ভালো লাগে, যখন ওখানকার সবাই আমাকে আপন ভাবে, বাংলাদেশ নিয়ে আগ্রহ দেখায়।’
 আমিই বাংলাদেশ নিয়ে পরামর্শ ও তথ্য যোগাযোগ: ab@prothom-alo.info

No comments

Powered by Blogger.