নতুন গণমাধ্যম- অ্যারন সোয়ার্টজকে খুন করল কে? by মশিউল আলম

মাত্র ১২ বছর বয়সে একটি কম্পিউটার সফটওয়্যার লিখেছিল সে। একটি অবাণিজ্যিক ওয়েবসাইট প্রতিষ্ঠার জন্য ‘আর্সডিজিটা প্রাইজ’ পেয়েছিল ১৩ বছর বয়সে। ইন্টারনেটে ব্লগপোস্ট সঞ্চালনের স্বয়ংক্রিয় সংগঠিত ব্যবস্থা আরএসএস তৈরির কাজে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল ১৪ বছর বয়সে।
একই বয়সে যোগ দিয়েছিল অধ্যাপক লরেন্স লেসিগের সঙ্গে, তাঁর ‘ক্রিয়েটিভ কমনস’ নামের ইন্টারনেট সংস্থা গড়ে তোলার কাজে। আইনানুগ পন্থায় অলাভজনক ভিত্তিতে সৃজনশীল কর্ম বিনিময় ও প্রসারের লক্ষ্যে নিবেদিত ওয়েবভিত্তিক সংগঠন হিসেবে ক্রিয়েটিভ কমনস পশ্চিমা নতুন গণমাধ্যম ও বুদ্ধিবৃত্তিক জগতে এখন বেশ পরিচিত ও সমাদৃত একটি নাম। ভীষণ জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগভিত্তিক সংবাদ সাইট ‘রেডিট’ প্রতিষ্ঠায় হাত লাগিয়েছিল, যখন সে সদ্য কৈশোর পেরিয়েছে। রেডিট ছিল একটি যৌথ উদ্যোগ, যুক্তরাষ্ট্রের বিরাট এক প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান কনডি ন্যাস্ট একসময় রেডিট কিনে নিলে প্রচুর টাকা পেয়েছিল সে। খুব অল্প বয়সে অনেক টাকাপয়সা আসে তার হাতে, কিন্তু টাকার জন্য জীবনে সে কিছুই করেনি।
সফটওয়্যার প্রোগ্রামারদের জগতে জীবন্ত কিংবদন্তি অ্যারন সোয়ার্টজ সম্বন্ধে এই তথ্যগুলো নিতান্তই সাধারণ। এসব তথ্য তার কোনো বিশেষ কৃতী তুলে ধরে না। যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে প্রভাবশালী দৈনিক নিউইয়র্ক টাইমস তার নামের আগে লেখে ‘পলিটিক্যাল অ্যাকটিভিস্ট’। কিন্তু এ থেকে ধারণা পাওয়া না, তার রাজনীতিটা কী নিয়ে। ডেমোক্রেসিওয়াচ-খ্যাত এমি গুডম্যান তাকে বলেন ‘সোশ্যাল জাস্টিস অ্যাকটিভিস্ট’। অন্যরা বলে ‘ফ্রি ডেটা অ্যাকটিভিস্ট’, ‘ইন্টারনেট ফ্রিডম অ্যাকটিভিস্ট’, ‘ক্রুসেডার ইন ওপেন ডেটা মুভমেন্ট’ ইত্যাদি। উইকিলিকসের জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ ‘ইন্টারনেট ফ্রিডম ফাইটার’ বলতে যাদের বোঝাতে চান, অ্যারন সোয়ার্টজ তাদের সবচেয়ে সামনের সারির একজন যোদ্ধা।
এই যোদ্ধারা ইন্টারনেট অ্যাকটিভিস্ট একদিকে রাষ্ট্রের নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণের হাত থেকে ইন্টারনেটকে রক্ষা করার লড়াই-সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে অনলাইনে ফাইল শেয়ারিং ব্যবস্থার মাধ্যমে উদগ্র মুনাফালোভী ব্যবসায়ীগোষ্ঠীর মুখে চাপড় মেরে জনসাধারণের জন্য বিনা পয়সায় বুদ্ধিবৃত্তিক ও সৃজনশীল কর্ম বিতরণ করে চলেছে। তারা বলছে, তথ্য ও জ্ঞানের প্রবাহকে করতে হবে অবাধ: অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত সমস্ত সীমাবদ্ধতা দূর করে তারা সবার জন্য তথ্য ও জ্ঞান সহজলভ্য করার সংগ্রামে লিপ্ত। ওপেন সোর্স মুভমেন্ট, ওপেন অ্যাকসেস মুভমেন্ট, ফ্রি ডেটা মুভমেন্ট ইত্যাদি নানা নামে তারা সক্রিয়।
অ্যারন সোয়ার্ট তাদের সম্মুখসারির একজন। ২০০৮ সালে সে লিখেছে ‘ওপেন গেরিলা অ্যাকসেস ম্যানিফেস্টো’: তথ্য হলো ক্ষমতা। সব ক্ষমতার মতো এই ক্ষমতাও কিছু মানুষ কুক্ষিগত করে রাখতে চায়। পৃথিবীর সমগ্র বৈজ্ঞানিক ও সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার কয়েক শতাব্দী ধরে প্রকাশিত হয়েছে বই ও পত্রপত্রিকায়, সেসব বই ও পত্রপত্রিকা ডিজিটাইজ করে অল্প কিছুসংখ্যক ব্যক্তিমালিকানাধীন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের সম্পত্তিতে পরিণত করা হচ্ছে। বিজ্ঞান গবেষণার সবচেয়ে বিখ্যাত ফলগুলো সম্পর্কে লেখা পড়তে চাও? তাহলে তোমাকে অনেক টাকা পাঠাতে হবে রিড এলসেভিয়েরের মতো প্রকাশকদের কাছে।... বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-গবেষকদের নিজের সহকর্মীর গবেষণা-প্রবন্ধ পড়তে হলে টাকা খরচ করতে হবে? পুরো লাইব্রেরির সব বইপত্র স্ক্যান করা হবে, কিন্তু সেগুলো পড়তে পারবে শুধুই গুগলের লোকেরা? বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্র পড়তে পারবে শুধুই প্রথম বিশ্বের এলিট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্র-শিক্ষকেরা, দক্ষিণ গোলার্ধের দরিদ্র মানুষ সেসবের নাগালই পাবে না? এটা জঘন্য, এটা মেনে নেওয়া যায় না।
ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষা করে ইন্টারনেটের মাধ্যমে মানুষে মানুষে যোগাযোগ স্থাপনের স্বাধীন অধিকার (ফ্রিডম টু কানেক্ট) সুরক্ষিত করতে এবং তথ্য ও জ্ঞানের অভিগম্যতাকে সর্বজনীন ও সহজলভ্য করতে অ্যারন যেসব উদ্যোগ নিয়েছে, তার দু-একটির কথা উল্লেখ করা যাক। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের একটি অনলাইন ডেটাবেইস আছে, যেখানে আদালতের নথিপত্র পাওয়া যায়। যেকোনো ব্যক্তি সে ওয়েবসাইট থেকে পয়সার বিনিময়ে যেকোনো নথিপত্র ডাউনলোড করতে পারে। অ্যারনের আপত্তি পয়সা নিয়ে। তার যুক্তি, আদালতের নথিপত্র তৈরি হয়েছে জনগণের করের টাকায়, এগুলো জনগণের সম্পত্তি। এগুলো পেতে জনগণকে পয়সা খরচ করতে হবে কেন? বিনা মূল্যে ও সহজে নথিগুলো প্রত্যেক নাগরিকের পাওয়ার ব্যবস্থা করা উচিত। ২০০৮ সালে সে ওই সরকারি ওয়েবসাইট হ্যাক করে নামিয়ে ফেলল প্রায় দুই কোটি নথিপত্র। ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন ওরফে এফবিআই যথারীতি তাকে ডেকে নিয়ে জেরা করল। কিন্তু অ্যারনের যুক্তি তারা উড়িয়ে দিতে পারল না বলে ওর বিরুদ্ধে মামলা করতে পারল না।
কিন্তু ২০১১ সালে অ্যারন আরও বড় একটা কাজ করল। জেস্টোর নামের এক অনলাইন আর্কাইভে বিশ্বের নামীদামি প্রচুরসংখ্যক পত্রপত্রিকা ও একাডেমিক জার্নাল পড়া যায়। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, ইনস্টিটিউট, লাইব্রেরি, গবেষণাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র, শিক্ষক, গবেষকেরা নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের কম্পিউটার সিস্টেমে সেটা করতে পারেন। অ্যারন এমআইটির কম্পিউটার সিস্টেমে ঢুকে ডাউনলোড করে ফেলল প্রায় ৪৮ লাখ বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্র, একাডেমিক সন্দর্ভ, বুক রিভিউ ইত্যাদি। জেস্টোর কর্তৃপক্ষ বিষয়টা ধরতে পারল, এমআইটি কর্তৃপক্ষ জানতে পেরে অ্যারনের ওপর খেপে গেল, জেনে গেল প্রসিকিউশন কর্তৃপক্ষ। অ্যারনকে গ্রেপ্তার করা হলো, সে ডাউনলোড করা ফোল্ডার জেস্টোরকে ফেরত দিল, জানালও যে এগুলো সে কপি করেনি, অনলাইনে ছাড়েওনি। তবে এটুকু জানাতে দ্বিধা করল না যে জেস্টোর থেকে ডাউনলোড করা ৪৮ লাখ লেখা পত্র সে বিনা মূল্যে সবার জন্য সহজলভ্য করতে ইন্টারনেটে ছেড়ে দিতে চেয়েছিল।
জেস্টোর কর্তৃপক্ষ অ্যারনের বিরুদ্ধে মামলা করেনি, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি প্রসিকিউশসন তক্কে তক্কে ছিল। ২০১০ সালে সরকারের ‘স্টপ অনলাইন পাইরেসি অ্যাক্ট’ নামের আইন প্রণয়নের উদ্যোগ যারা ভন্ডুল করে দিয়েছে, এই অ্যারন সোয়ার্টজ ছিল তাদের অন্যতম নেতা। আসলে, অ্যারনের মধ্যে ওরা দেখতে পায় ব্র্যাডলি ম্যানিং, জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের মতো ইন্টারনেট-বিদ্রোহীদের ছায়া। সুতরাং, অ্যারনকে তারা এবার আর ছেড়ে দিতে পারে না। কম্পিউটার অপরাধসংক্রান্ত একাধিক আইনের অনেক ধারায় অভিযোগ দাঁড় করানো হলো অ্যারনের বিরুদ্ধে। দোষী সাব্যস্ত হলে মোট ৩৫ বছর কারাদণ্ড আর চার মিলিয়ন ডলার অর্থদণ্ড হবে অ্যারনের।
কিন্তু তা আর হওয়ার নয়। ১১ জানুয়ারি ওর মৃতদেহ পাওয়া গেছে সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ঝুলন্ত অবস্থায়। বলা হচ্ছে, অ্যারন আত্মহত্যা করেছে, কেউ কোনো সন্দেহ প্রকাশ করেনি এ নিয়ে। কিন্তু ওর পরিবার ও বন্ধু-সুহূদরা অভিযোগ করছে, ওর এই মৃত্যু আসলে একটা হত্যাকাণ্ড। ইন্টারনেট মুক্তিযোদ্ধা অ্যারন সোয়ার্টজকে হত্যা করেছে মার্কিন ফৌজদারি অপরাধ বিচারব্যবস্থা ও ম্যাসাচুসেটসের সরকারি কৌঁসুলিরা।
মশিউল আলম: সাংবাদিক।
mashiul.alam@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.