৪৫ ইয়ার্ডে শিপব্রেকিং বন্ধ- বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আদেশ স্থগিত রাখার দাবিতে সমাবেশ by মোয়াজ্জেমুল হক

প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে শিপ ব্রেকিং শিল্পের জন্য যখন নীতিমালা প্রণয়নের কাজ এগিয়ে চলেছে তখন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের প্রণীত আমদানি নীতিতে প্রণীত এক আদেশের জের হিসেবে বিদেশ থেকে স্ক্র্যাপ শিপ আমদানি সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হয়ে গেছে।
এছাড়া গত ২১ ফেব্রম্নয়ারি থেকে ৪৫টি শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডে বন্ধ হয়ে গেছে স্ক্র্যাপ জাহাজ ভাঙ্গার কার্যক্রম এবং স্ক্র্যাপ ও পেস্নট সরবরাহের নেটওয়ার্ক। ফলে সহসা বাজারে লোহার মূল্য উর্ধমুখী হয়ে অস্থিতিশীল হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ইতোমধ্যে লোহার বাজার মূল্য টনপ্রতি ২ থেকে আড়াই হাজার টাকা বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ শিপ ব্রেকিং এ্যাসোসিয়েশন (বিএসবিএ) স্টীল ও রিরোলিং মিল ওনার্স এ্যাসোসিয়েশন, শিপ ব্রেকিং কন্ট্রাক্টার্স এ্যাসোসিয়েশন, শিপ ব্রেকিং ফার্নিচার এ্যাসোসিয়েশনসহ শিপ ব্রেকিং শিল্পের সঙ্গে জড়িত শ্রমিকদের সংগঠনসমূহের প থেকে অবিলম্বে স্ক্র্যাপ শিপ আমদানি সম্পর্কিত নীতিমালা স্থগিত রাখার দাবিতে সভা সমাবেশ ও মানববন্ধন কর্মসূচী হয়েছে।
উলেস্নখ্য, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ২০০৯-২০১২ সালের জন্য প্রণীত আমদানি নীতি আদেশে স্ক্র্যাপ শিপ আমদানিতে নতুন একটি শর্ত আরোপ করেছে। এ শর্ত আরোপিত হয়েছে হাইকোর্টের নির্দেশনার আলোকে। গত ২৬ জানুয়ারি জারিকৃত এক আদেশে বলা হয়েছে, 'স্ক্র্যাপ ভেসেল আমদানির েেত্র এটা বিষাক্ত বর্জ্যমুক্ত নয়_ এ মর্মে রফতানিকারক দেশের সরকার বা সরকার কর্তৃক অনুমোদিত উপযুক্ত কর্তৃপরে প্রত্যয়নপত্র শিপিং ডকুমেন্টের সহিত অবশ্যই দাখিল করিতে হইবে'। এ সংক্রানত্ম গেজেটটি প্রায় পনেরো দিন পর হসত্মগত হয় চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস কর্তৃপ ও সংশিস্নষ্ট আমদানিকারক মহলে। ২৬ জানুয়ারি গেজেট হওয়ার পর বিষয়টি অজানা থাকায় এরই মাঝে আমদানি হয়ে এসেছে ৮টি স্ক্র্যাপ ভেসেল। আমদানি নীতির আদেশ অনুযায়ী বিষাক্ত বর্জ্যমুক্ত সার্টিফিকেট না থাকায় এসব জাহাজের বিচিং অনুমতি বন্ধ করে দেয় কাস্টম কর্তৃপ। অবশ্য ইতোমধ্যে সংশিস্নষ্ট আমদানিকারকগণ অঙ্গীকারনামা দিয়ে ৬টি জাহাজের বিচিং অনুমতি গ্রহণ করেছে। অঙ্গীকারনামায় উলেস্নখ করতে হয়েছে পরবতর্ী যথাযথ আদেশ নির্দেশ না হওয়া পর্যনত্ম এসব জাহাজ বিচিং করা হলেও তা কাটা যাবে না। বর্তমানে বহির্নোঙ্গরে আরও দুটি জাহাজ বিচিংয়ের অপোয় রয়েছে।
এদিকে, চট্টগ্রামে গড়ে ওঠা দেশের একমাত্র ও পৃথিবীর বৃহত্তম শিপ ব্রেকিং শিল্পে সব ধরনের কার্যক্রম থমকে যাওয়ায় পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের প থেকে সচিবের স্বারে গত ১৭ ফেব্রম্নয়ারি বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সচিবের কাছে প্রেরিত এক পত্রে এ সংক্রানত্ম আমদানি নীতি আদেশ সংশোধনের সুপারিশ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, পরিবেশসম্মতভাবে জাহাজ ভাঙ্গা কার্যক্রমের ওপর বিধি প্রণয়ন না হওয়া পর্যনত্ম জারিকৃত অনুচ্ছেদটি সংশোধনের ব্যবস্থা নেয়া হোক। পরিবেশ সচিব আরও উলেস্নখ করেছেন, জাহাজ ভাঙ্গা কার্যক্রম পরিবেশসম্মতভাবে সম্পাদনের ল্যে প্রধানমন্ত্রী বিধিমালা প্রণয়নের নির্দেশ দিয়েছেন। এছাড়া বিধি প্রণয়নের জন্য হাইকোর্ট বিভাগেরও নির্দেশনা রয়েছে। সে অনুযায়ী পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় জাহাজ ভাঙ্গা ও বিপজ্জনক বর্জ্য বিধিমালা ব্যবস্থাপনা প্রণয়নের কার্যক্রম শুরম্ন করেছে। যা অনতিবিলম্বে ভেটিং নিয়ে জারি করা হবে।
সংশিস্নষ্ট সূত্রে জানা গেছে, পরিবেশ মন্ত্রণালয় থেকে এ ধরনের সুপারিশপত্র পেঁৗছানোর পর বাণিজ্য মন্ত্রণালয় অনানুষ্ঠানিকভাবে জানিয়ে দিয়েছে, এতে তাদের করণীয় কিছু নেই। একমাত্র মন্ত্রিপরিষদ সভায় সংশোধনের সিদ্ধানত্ম নিতে পারে। বাণিজ্যমন্ত্রীও অনুরূপ সিদ্ধানত্মে অটল রয়েছেন। এ অবস্থায় সীতাকু-ের প্রায় ২০ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে গড়ে ওঠা শিপ ব্রেকিং শিল্প সম্পূর্ণভাবে স্থবির হয়ে পড়েছে।
এদিকে, বিএসবিএ'র প থেকে ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী, বাণিজ্যমন্ত্রী এবং বন ও পরিবেশমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলা হয়েছে, দেশের শিপ ব্রেকিং শিল্প মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে। বিদেশী অর্থে ও মদদে কয়েকটি এনজিও সংস্থা গার্মেন্টস শিল্পের মতো শিপ ব্রেকিং শিল্পও বন্ধ করে দেয়ার পাঁয়তারায় লিপ্ত রয়েছে। বিএসবিএ'র প্রেসিডেন্ট জাফর আলম জানিয়েছেন, স্ক্র্যাপ করার জন্য আমদানিকৃত জাহাজ সাধারণত ২০ থেকে ২৫ বছরের পুরনো হয়ে থাকে। তৈরির পর থেকে এ সময়কালের মধ্যে সংশিস্নষ্ট জাহাজের কাস, ফ্যাগ, রেজিস্ট্রেশন ইত্যাদি কয়েক দফায় পরিবর্তন হয়ে থাকে। চলমান একটি জাহাজ রিসাইকিং অর্থাৎ কাটার জন্য বিক্রি হয় তখন এর অবস্থান বেশিরভাগ েেত্র এমন হয় যে, তৈরিকারী দেশ বা সরকার, রেজিস্ট্রেশনকারী দেশ, মালিক ও বিক্রেতা কখনও এক জায়গায় অবস্থান করেন না। যে দেশ থেকে এ জাতীয় জাহাজ বিক্রি বা রফতানি হয় সে দেশের বিক্রেতার সঙ্গে সংশিস্নষ্ট জাহাজের মালিক ছাড়া অন্য সংস্থার সঙ্গে কোন সম্পর্ক থাকে না। তাই জারিকৃত আমদানি নীতি বাসত্মবায়ন অসম্ভব। বিএসবিএ'র সহসভাপতি আলহাজ কামাল উদ্দিন জানান, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে যেখানে জাহাজ রিসাইকিংয়ের জন্য জাতীয় নীতিমালা বিবেচনাধীন তার আগে এ ধরনের আদেশের পেছনে কোন ষড়যন্ত্র রয়েছে কিনা তাও ভেবে দেখতে হবে।
প্রসঙ্গত উলেস্নখ্য, দেশে চাহিদার ৮০ ভাগেরও বেশি লোহার যোগান দেয়া হয় শিপ ব্রেকিং শিল্প থেকে। এ শিল্পের সঙ্গে প্রত্য ও পরোভাবে ৬ লাখেরও বেশি মানুষ জড়িত। এ শিল্প থেকে সরকার প্রতি বছর প্রায় ৯শ' কোটি টাকা রাজস্ব আয় করে থাকে।
অন্যদিকে, জাহাজ ভাঙ্গা কার্যক্রমের ফলে এলাকার সার্বিক পরিবেশও বিপর্যসত্ম। বিশেষ করে শ্রমিকদের নিরাপত্তাজনিত কোন ব্যবস্থা না থাকায় প্রতিবছর অসংখ্য শ্রমিক দুর্ঘটনা কবলিত হয়ে একদিকে যেমন প্রাণ হারাচ্ছে, অন্যদিকে চিরদিনের জন্য পঙ্গুত্ব বরণ করছে। পাশাপাশি বিষাক্ত বর্জ্যের কারণে সীতাকু-ের উপকূল সংশিস্নষ্ট সাগর এলাকায় মাছসহ জলজ প্রাণী শূন্য হয়ে গেছে। রাসায়নিক বিষক্রিয়ায় এলাকার সবুজ বেষ্টনী ইতোমধ্যে নষ্ট হয়ে গেছে। পাশর্্বপ্রতিক্রিয়ায় সাধারণ মানুষ নিয়মিতভাবে বিভিন্ন রোগে আক্রানত্ম হচ্ছে। এসব নিয়ে দুটি এনজিও সংস্থা তৎপর রয়েছে। একটি এনজিও সংস্থা এ নিয়ে উচ্চ আদালতে রিট করার পর আদালত বিধিমালা প্রণয়নে নির্দেশ প্রদান করেছে। এ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ২ জানুয়ারি চট্টগ্রামে আইইবি'র অধিবেশনে বক্তব্য দিতে গিয়ে ঘোষণা করেন শীঘ্রই জাহাজ ভাঙ্গা শিল্পের জন্য নীতিমালা প্রণয়ন করা হবে। তিনি বলেন, সরকার জাহাজ ভাঙ্গা শিল্প বিরোধী নয়। কিন্তু তা কোনভাবে পরিবেশের তিসাধন করতে পারে না। এরপর থেকে শুরম্ন হয় বিধিমালা প্রণয়নে পরিবেশ অধিদফতরের কার্যক্রম। এ অবস্থায় গত ২৬ জানুয়ারি প্রণীত আমদানি নীতিতে বিষাক্ত বর্জ্যমুক্ত স্ক্র্যাপ জাহাজের সার্টিফিকেট শিপিং ডকুমেন্টের সঙ্গে দাখিল করা বাধ্যতামূলক করা হয়। এরপর থেকে স্ক্র্যাপ জাহাজ আমদানি যেমন বন্ধ রয়েছে, তেমনি থমকে গেছে ইয়ার্ডসমূহ থেকে কাঁচামাল সরবরাহ কার্যক্রম। এর ফলে কাঁচামালের অভাবে রি-রোলিং ও স্টীল মিলগুলোতে সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে। রড উৎপাদন হ্রাস পাওয়ায় বাজারে তা আঘাত হানতে শুরম্ন করেছে।
এদিকে অনুসন্ধানে জানা গেছে, স্ক্র্যাপ জাহাজের আমদানিকারকরা সম্মিলিতভাবে স্ক্র্যাপ জাহাজ আমদানি, জাহাজ ভাঙ্গা ও কাঁচামাল সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে। এর ফলে রি-রোলিং ও স্টীল মিল মালিকরা, কন্ট্রাকটর্স এ্যাসোসিয়েশন তাদের ব্যবসায়িক কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এবং হাজার হাজার শ্রমিক বর্তমানে বেকারত্বের কবলে পড়ায় রাসত্মায় নেমেছে।
অপরদিকে বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় সূত্রে সোমবার জানানো হয়েছে, জাহাজ ভাঙ্গা শিল্পের জন্য আদালত জোন গঠন ও বিধিমালা প্রণয়নের কাজ এগিয়ে চলেছে। ইতোমধ্যে বিএসবিএ নেতৃবৃন্দসহ সংশিস্নষ্টদের নিয়ে দফায় দফায় বৈঠকও হয়েছে। সূত্র মতে, দূষিত জাহাজ ভাঙ্গার কারণে এলাকার পরিবেশের মারাত্মক তি হচ্ছে। গত বছরের ১৭ মার্চ হাইকোর্ট এক আদেশে জাহাজ ভাঙ্গা শিল্পকে পরিবেশসম্মত করতে সরকারকে আটদফা নির্দেশনা প্রদান করেছে। নির্দেশনায় বলা হয়েছে, দেশে কোন স্ক্র্যাপ জাহাজ আনার আগে তা দূষণমুক্ত কিনা তা নিশ্চিত হতে হবে। শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডগুলোকে পরিবেশ অধিদফতরের ছাড়পত্র নিতে হবে এবং এতে কি পরিমাণ বর্জ্য রয়েছে তা প্রতিমাসে সুপ্রীমকোর্টকে জানাতে হবে। হাইকোর্টের আদেশের পর ঐ বছরের ১৭ মে বিধিমালা প্রণয়নের জন্য সরকার একটি কমিটি গঠন করেছে। কমিটি কাজ করে যাচ্ছে। শীঘ্রই তা আইন মন্ত্রণালয়ের ভেটিংয়ের মাধ্যমে কার্যকর করা হবে। উলেস্নখ্য, এ শিল্পের কাঁচামাল নিয়ে ৫ শতাধিক রি-রোলিং মিল চালু রয়েছে। স্ক্র্যাপ জাহাজ আমদানিতে বিনিয়োগে জড়িত রয়েছে দেশের পনেরোটি তফসিলী ব্যাংকের ৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি।
এদিকে সীতাকু-ে শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডগুলোর একটিরও পরিবেশের কোন ছাড়পত্র নেই। দফায় দফায় নোটিস দেয়ার পরও তাতে কোন সুফল পাওয়া যায়নি। উলেস্নখ্য, প্রায় ৪০ বছর আগে সীতাকু-ে জাহাজ ভাঙ্গা কার্যক্রমের গোড়াপত্তন ঘটে। বর্তমানে এটি পৃথিবীর বৃহত্তম জাহাজ ভাঙ্গা শিল্পে পরিণত হয়েছে। দীর্ঘ চলিস্নশ বছরেও এ শিল্পের জন্য নীতিমালা প্রণয়ন হয়নি। পরিবেশ দূষণ ও মানবাধিকার লঙ্ঘন এ শিল্পের অন্যতম প্রধান সমস্যা। এ ব্যাপারে বিএসবিএ'র প থেকে সোমবার জানানো হয়েছে, কার্যকর নীতিমালা প্রণীত হলে তা সকলে মেনে চলতে প্রস্তুত রয়েছে। শ্রমিকদের স্বার্থে ১০ কোটি টাকা ব্যয়ে ইতোমধ্যে বহুতল একটি হাসপাতাল নির্মাণ কাজ এগিয়ে চলেছে। স্ক্র্যাপ জাহাজকে কাটার আগে তা বিষাক্ত বর্জ্যমুক্ত করার পদ্ধতি সরকার চালু করলে তা বাসত্মবায়ন করতে কারও কোন আপত্তি নেই। কিন্তু নীতিমালা প্রণয়নের মাঝপথে এ ধরনের আদেশে এ শিল্প চরম ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। অর্থনৈতিকসহ সরবরাহের একটি বিশাল নেটওয়ার্ক সম্পূর্ণভাবে থমকে গেছে।

No comments

Powered by Blogger.