বিশ্বজিৎ দাস হত্যাকাণ্ড-এমদাদও বলল, হামলা নেতাদের নির্দেশে

'ভগবানের দোহাই লাগে, আমারে মাইরেন না। আমি কিছু জানি না।' জীবন বাঁচাতে হামলাকারীদের কাছে এভাবেই প্রাণ ভিক্ষা চেয়েছিলেন বিশ্বজিৎ দাস। এ আকুতি কানে যায়নি ছাত্রলীগকর্মীদের। ধরা পড়ার পর এভাবেই তথ্য দিল আরেক অভিযুক্ত এমদাদুল হক (২৬)।
গত সোমবার গভীর রাতে চাঁপাইনবাবগঞ্জের সদর উপজেলার 'স্বপ্নপুরী' নামের একটি আবাসিক হোটেল থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। গতকাল মঙ্গলবার এমদাদকে ঢাকা মহানগর হাকিমের আদালতে হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করলে আদালত সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) কর্মকর্তারা জানান, গ্রেপ্তার এড়াতে সীমান্ত দিয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল এমদাদের। গণমাধ্যমের ছবি দেখে তদন্তকারীরা তাকে শনাক্ত করেন। গ্রেপ্তারের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদেই এমদাদ বিশ্বজিতের ওপর হামলায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে। তার দাবি, ছাত্রলীগ নেতাদের নির্দেশেই সে ২০-২১ জন ছাত্রলীগকর্মীর সঙ্গে বিশ্বজিতের ওপর হামলা চালায়। ভিক্টোরিয়া ডেন্টাল কিনিক ভবন থেকে নামার পর এমদাদ রড দিয়ে বিশ্বজিৎকে আঘাত করে।
এমদাদসহ বিশ্বজিৎ হত্যা মামলায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের অভিযুক্ত সাত কর্মীকে গ্রেপ্তার করল ডিবি পুলিশ। আসামিদের মধ্যে শাকিল, নাহিদ ও শাওন গত রবিবার আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। কিবরিয়া, টিপু ও সাইফুল তিন ও পাঁচ দিনের রিমান্ডে আছে।
গতকাল দুপুরে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। ডিএমপির মুখপাত্র, ডিবি পুলিশের উপকমিশনার মনিরুল ইসলাম জানান, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে সোমবার মধ্যরাতে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একটি দল চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরে অভিযান চালায়। তারা ভারতে পালানোর প্রস্তুতি নেওয়া অবস্থায় শহরের স্বপ্নপুরী রেস্টহাউস থেকে এমদাদকে গ্রেপ্তার করে। এমদাদের বাড়ি যশোর জেলার শার্শা উপজেলার পাঁচকাইবা গ্রামে। এমদাদ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০১০-১১ সেশনে দর্শন শাস্ত্রে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করে। বিশ্বজিৎ হত্যায় সম্পৃক্ততা প্রকাশের পর গত ১২ ডিসেম্বর তার সনদ বাতিল করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
মনিরুল ইসলাম আরো জানান, বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ভিডিও চিত্র এবং গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে এখন পর্যন্ত ২০-২১ জনকে শনাক্ত করা হয়েছে। এমদাদ তাদের মধ্যে অন্যতম। তাকে গ্রেপ্তারের জন্য ঢাকা এবং দেশের বিভিন্ন এলাকায় বেশ কয়েকটি এলাকায় অভিযান চালানো হয়। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন ডিএমপির উপকমিশনার (মিডিয়া) মাসুদুর রহমান, এডিসি নূরুন্নবি প্রমুখ।
পুলিশ জানায়, গ্রেপ্তার হওয়ার পর এমদাদ বলে, সে দরিদ্র পরিবারের সন্তান। তার বাবা মৃত আকরাম আলী একজন কৃষক ছিলেন। এমদাদ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মী ছিল। স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভের পর সে টেলিভিশন বিক্রয়কারী একটি প্রতিষ্ঠানের বিক্রয়কেন্দ্রে চাকরি নেয়। সেই সঙ্গে আরো একটি ভালো চাকরির জন্যও চেষ্টা চলছিল। সম্প্রতি ছাত্রলীগ নেতাদের আশ্বাসে চাকরি ছেড়ে সাংগঠনিক কাজে সক্রিয় হয়।
হামলার বর্ণনা দিয়ে এমদাদ বলে, ঘটনার দিন (৯ ডিসেম্বর) মিছিল থেকে রাজন, ইউনুস, শাকিলসহ কয়েকজন প্রথমে বিশ্বজিতের ওপর হামলা চালায়। এ ঘটনায় ২০ থেকে ২১ জন ছাত্রলীগকর্মী সরাসরি হামলায় অংশ নিলেও এ সময় পাশেই ছিলেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখার ছাত্রলীগের সভাপতি শরিফুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক সিরাজুল ইসলাম। বিশ্বজিৎ আত্মরক্ষা করতে যখন ভবন থেকে দৌড়ে নামছিলেন, এমদাদ তার হাতে থাকা রড দিয়ে তাঁকে আঘাত করে। এ সময় বিশ্বজিৎ বলছিলেন, 'ভগবানের দোহাই লাগে, আমারে মাইরেন না। আমি কিছুই জানি না।' এমদাদের দাবি, সে কোনোভাবেই বুঝতে পারেনি হামলায় বিশ্বজিৎ মারা যাবেন।
গোয়েন্দা সূত্র জানায়, স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতেও তিন আসামি ২১ ছাত্রলীগকর্মী হামলায় জড়িত বলে তথ্য দিয়েছে। রিমান্ডে থাকা আরো তিন আসামি এখন নিজেদের ভুলের জন্য অনুশোচনা করছে। তারা দাবি করছে, তাদের নির্দেশদাতা ছাত্রলীগ নেতারা; দায়িত্বরত পুলিশ এবং মিটফোর্ড হাসপাতালের চিকিৎসকরাও বিশ্বজিতের মৃত্যুর জন্য দায়ী। আসামিরা তাদেরও বিচার চাইছে।
এদিকে আমাদের আদালত প্রতিবেদক জানান, গতকাল বিশ্বজিৎ হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা, ডিবির পরিদর্শক তাজুল ইসলাম মহানগর হাকিম তানভীর আহমেদের আদালতে এমদাদকে হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করেন। আদালত সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
গত ৯ ডিসেম্বর বিরোধী দলের অবরোধ কর্মসূচির সময় পুরান ঢাকায় ছাত্রলীগকর্মীদের হামলায় নিহত হন শাঁখারীবাজারের দর্জি ব্যবসায়ী বিশ্বজিৎ দাস।

No comments

Powered by Blogger.