কাদের মোল্লার সাফাই সাক্ষীর আবেদনের ওপর আজ শুনানি- যুদ্ধাপরাধী বিচার

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতারকৃত জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কাদের মোল্লার পক্ষে আরও ৬ জন সাফাই সাক্ষীর আবেদনের ওপর আজ শুনানি অনুষ্ঠিত হবে।
একই সঙ্গে জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযমের মামলায় রিট্রায়ালের শুনানির দ্বিতীয় দিনে আজ আবার ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক বক্তব্য রাখবেন। একইসঙ্গে বাচ্চু রাজাকার হিসেবে পরিচিত আবুল কালাম আজাদের পক্ষে রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করবেন। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ ও ২-এ এই গুরুত্বপূর্ণ শুনানিগুলো অনুষ্ঠিত হবে।
অন্যদিকে বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীর পক্ষে একটি আবেদন করা হয়েছে। প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুমকে অপসারণ ও তার শাস্তি দাবি করেন। এ আবেদনটি নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত প্রসিকিউশনের সাক্ষী নেয়া হবে না। রিট্রায়ালের সঙ্গে সাকার আবেদনও শুনানি হবে। জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়েছে একইসঙ্গে ডিফেন্স পক্ষের ৬ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়। এখন যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করছেন প্রসিকিউটর মোহাম্মদ আলী। এর মধ্যে আসামিপক্ষ আরও ৬ সাফাই সাক্ষীর জন্য আবেদন করেছেন। চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান শাহীনের নেতৃত্বে তিন সদস্যবিশিষ্ট আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২-এ আবেদন করা হয়। আজ এ বিষয়ে শুনানি হবে।
মুক্তিযুদ্ধকালে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২-এ কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে মামলা বর্তমানে বিচারিক প্রক্রিয়া শেষপর্যায়ে রয়েছে। এই মামলায় প্রসিকিউশনের যুক্তি (আর্গুমেন্ট) উপস্থাপন চলছে। প্রসিকিউশনের যুক্তি উপস্থাপন শেষে আসামিপক্ষ যুক্তি উপস্থাপন করবে। এরপরই কাদের মোল্লার মামলার রায় প্রদানের তারিখ ঘোষণা করবে ট্রাইব্যুনাল।
এর আগে কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা (আইও) আব্দুর রাজ্জাক খান ও মনোয়ারা বেগমসহ রাষ্ট্রপক্ষের মোট ১২ সাক্ষী ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দেন। আসামিপক্ষের আইনজীবীরা তাদের জেরা শেষ করেছেন। কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেয়া প্রসিকিউশন পক্ষের অন্য সাক্ষীরা হলেন, বীর মুক্তিযোদ্ধা মোজাফফর আহম্মেদ খান, বীর মুক্তিযোদ্ধা মামা বাহিনীর প্রধান ও কমান্ডার শহিদুল হক খান মামা, কাদের মোল্লার হাতে ক্ষতিগ্রস্ত এক নারী সাক্ষী (ক্যামেরা ট্রায়াল), কবি কাজী রোজি, শহীদ বুদ্ধিজীবী সাংবাদিক ও আইনজীবী খন্দকার আবু তালেবের পুত্র সরকারী কর্মকর্তা খন্দকার আবুল আহসান, সাবেক ছাত্রলীগ কর্মী সাফিউদ্দিন মোল্লা, আব্দুল মজিদ পালোয়ান, কেরানীগঞ্জের ঘাটারচর গ্রামের শহীদ নবী হোসেন বুলুর স্ত্রী নূরজাহান বেগম, বীর মুক্তিযোদ্ধা আমির হোসেন মোল্লা এবং সৈয়দ আব্দুল কাইয়ুম।
অন্যদিকে কাদের মোল্লা নিজেসহ ৬ জন সাফাই সাক্ষ্য দিয়েছেন তার পক্ষে। অন্য ৫ সাফাই সাক্ষী হচ্ছেন, সুশীল চন্দ্র ম-ল, মোসলেম উদ্দিন মাস্টার, সাহেরা খাতুন, আলতাফ উদ্দিন মোল্লা ও এআইএম লোকমান। প্রসিকিউশনপক্ষ তাদের জেরা সম্পন্ন করেছেন। ২৮ মে একাত্তরে হত্যা, গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ, ষড়যন্ত্র ও উস্কানিসহ ৬টি অভিযোগ এনে কাদের মোল্লার বিরদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের ৩(২)(এ)(জি),(এইচ),৩(১), ৩(২)(এ)(এইচ) অভিযোগ গঠন করেন ট্রাইব্যুনাল-২। গত ২০ জুন তার বিরুদ্ধে ওপেনিং স্টেটমেন্ট (সূচনা বক্তব্য) উপস্থাপন করেন রাষ্ট্রপক্ষের প্রসিকিউটর মোহাম্মদ আলী ও সুলতান মাহমুদ। তারা ৯৬ পৃষ্ঠার এ সূচনা বক্তব্যে কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে আনা ৬টি অভিযোগ বিস্তারিতভাবে তুলে ধরেন। কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে আনা ৬টি অভিযোগের মধ্যে রয়েছে, কবি মেহেরুন্নেছাসহ বুদ্ধিজীবী হত্যা, পল্লবীর আলোকদি গ্রামে ৩৪৪ জনকে হত্যা, খন্দকার আবু তালেবকে হত্যা, বাংলা কলেজের ছাত্র পল্লবসহ সাতজনকে হত্যা, কেরানীগঞ্জের শহীদনগর গ্রামের ভাওয়াল খান বাড়ি ও ঘাটারচরসহ পাশের আরও দুটি গ্রামের অসংখ্য লোককে হত্যার ঘটনা।
মুক্তিযুদ্ধকালে গোলাম মোস্তফা নামে এক মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যার অভিযোগে ২০০৭ সালের ১৭ ডিসেম্বর জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কাদের মোল্লাসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে কেরানীগঞ্জ থানায় একটি মামলা হয়। ওই মামলাটি করেছিলেন কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে প্রথম সাক্ষী মোস্তফার কমান্ডার মোজাফফর আহমেদ খান। ২০০৮ সালে পল্লবী থানায় আরও একটি মামলা হয় কাদের মোল্লাসহ অনেকের বিরুদ্ধে। ওই মামলার অভিযোগে ২০১০ সালের ১৩ জুলাই তাকে গ্রেফতার করা হয়।
আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে ২০১১ সালের ১ নবেম্বর জমা দেয়া তদন্ত প্রতিবেদনে হত্যা, খুন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের বিভিন্ন অভিযোগ আনা হয়। ২৮ ডিসেম্বর তার বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ আমলে নেন ট্রাইব্যুনাল। গত ১৬ এপ্রিল আব্দুল কাদের মোল্লার মামলাসহ তিনটি মামলা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ থেকে ট্রাইব্যুনাল-২-এ স্থানান্তর করা হয়। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ কোন মামলা ছিল না।
গোলাম আযম ॥ জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযমের মামলায় এখন রিট্রায়ালের শুনানি চলছে। আজ দ্বিতীয় দিনের মতো শুনানি শুরু হবে। চেয়ারম্যান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবীরের নেতৃত্বে তিন সদস্যবিশিষ্ট আন্তার্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ এই শুনানি হবে। ট্রাইব্যুনালে অন্য দু’সদস্য রয়েছেন বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিম ও বিচারপতি আনোয়ারুল হক।
এর আগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সাবেক চেয়ারম্যান বিচারপতি মোঃ নিজামুল হক নাসিমের নেতৃত্বাধীন ট্রাইব্যুনাল-১ গোলাম আযমের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের ১৭তম ও শেষ সাক্ষী মামলার তদন্ত কর্মকর্তা (আইও) মতিউর রহমানকে জেরা করছেন। পাশাপাশি সাফাই সাক্ষী হিসেবে গোলাম আযমের ছেলে সাক্ষ্য প্রদান করছিলেন। এর আগে ৯ অক্টোবর গোলাম আযমের পক্ষে সাক্ষী দেয়ার জন্য আসামিপক্ষের দেয়া ২ হাজার ৯৩৯ জনের তালিকা থেকে কমিয়ে ১২ সাক্ষীর নাম মঞ্জুর করে ট্রাইবু্যুনাল। মানবতাবিরোধী ৫ ধরনের অপরাধের ৬১টি অভিযোগে অভিযুক্ত করে গত ১৩ মে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে ট্রাইব্যুনাল। ১ জুলাই থেকে তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়।
এছাড়া এ মামলায় ৮ জন ঘটনার সাক্ষী ও ৭ জন জব্দ তালিকারসহ মোট ১৫ জন সাক্ষী ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিয়েছেন। ঘটনার সাক্ষীরা হলেন, বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ ও গবেষক ড. মুনতাসীর মামুন, মুক্তিযোদ্ধা মাহবুব উদ্দিন আহম্মদ বীরবিক্রম, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও মানবাধিকার কর্মী এ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল, শফিউদ্দিন আহমেদ, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পৈরতলার দক্ষিণপাড়ার সোনা মিয়া, শহীদ পরিবারের এক নারী (ক্যামেরা ট্রায়াল), বিশিষ্ট গীতিকার ও সুরকার আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল এবং রাজধানীর নাখালপাড়ার ফরিদ আলম।
জব্দ তালিকার সাক্ষীরা হলেন বাংলা একাডেমীর সহ-গ্রন্থাগারিক মোঃ এজাব উদ্দিন মিয়া, পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের (এসবি) রাজনৈতিক শাখার উচ্চমান সহকারী সেলিনা আফরোজ, কুষ্টিয়া জেলা পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের উচ্চমান সহকারী কাজী আইয়ুব হোসেন, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার কামালের বোন ডা. মুনিয়া ইসলাম চৌধুরী, জাতীয় জাদুঘরের কিপার ড.স্বপন কুমার বিশ্বাস, পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই) আমিনুল ইসলাম এবং মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে কর্মরত সাঁট মুদ্রাক্ষরিক জামিনুর শেখ।
অন্যদিকে এক আবেদনের প্রেক্ষিতে প্রসিকিউশনের ১৬তম সাক্ষী হিসেবে সাক্ষী মহসিন আলী খানের তদন্ত কর্মকর্তার কাছে দেয়া জবানবন্দীকেই সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করেছে ট্রাইব্যুনাল। ১১ জানুয়ারি গোলাম আযমকে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় জামিন নাকচ করে দিয়ে কারাগারে প্রেরণ করা হয়। এর আগে গত ৯ জানুয়ারি তার বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের দেয়া আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নিয়ে তাকে ট্রাইব্যুনালে হাজির হতে আদেশ দেয় ট্রাইব্যুনাল।
সম্প্রতি স্কাইপের মাধ্যমে সাবেক চেয়ারম্যান বিচারপতি মোঃ নিজামুল হক নাসিমের সঙ্গে ব্রাসেলস প্রবাসী ড. আহম্মেদ জিয়াউদ্দিনের কথোপকথন প্রকাশিত হওয়ার পর আসামিপক্ষের আইনজীবীরা নতুন করে মামলাগুলো শুনানির আবেদন করেন। এখন তিন মামলার রিট্রায়ালের আবেদন করেছে। যার মধ্যে গোলাম আযমের মামলা রিট্রায়ালের শুনানি চলছে। অন্য দুটি রিট্রায়ালের আবেদনের মধ্যে রয়েছে জামায়াতের আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী ও মাওলানা দেলাওয়ার হোসেইন সাঈদী।
বাচ্চু রাজাকার ॥ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত পলাতক আসামি বাচ্চু রাজাকার হিসেবে পরিচিত আবুল কালাম আজাদের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ হয়েছে। আজ থেকে রাষ্ট্র নিয়োজিত আইনজীবী আব্দুস শাকুর আসামি বাচ্চু রাজাকারের পক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করবেন। চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান শাহীনের নেতৃত্বে তিন সদস্যবিশিষ্ট আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এই যুক্তিতর্ক অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ট্রাইব্যুনালে অন্য দু’সদস্য ছিলেন বিচারপতি মোঃ মজিবুর রহমান মিয়া ও জজ মোঃ শাহিনুর ইসলাম।
প্রসিকিউটর সাহিদুর রহমান সোমবার দ্বিতীয় দিনের মতো যুক্তিতর্ক (আর্গুমেন্ট) উপস্থাপন সম্পন্ন করেন। বাচ্চু রাজাকারের বিরুদ্ধে মোট ৮টি অপরাধের বিষয়ে ২২ সাক্ষীর সাক্ষ্যের ব্যাপারে যুক্তি (আর্গুমেন্ট) উপস্থাপন করেছেন বলে জানান প্রসিকিউটর সাহিদুর রহমান।
৪ নবেম্বর বাচ্চু রাজাকারের বিরুদ্ধে ৮টি সুনির্দিষ্ট ঘটনায় অভিযোগ গঠন করা হয়। ট্রাইব্যুনালে তার বিরুদ্ধে ১০টি ঘটনায় ২২টি অভিযোগের ভিত্তিতে মোট ৪৪৮ পৃষ্ঠার অভিযোগ দাখিল করা হয়েছে। ৭ অক্টোবর ট্রাইব্যুনাল আবুল কালাম আজাদের অনুপস্থিতিতে বিচার শুরুর আদেশ দিয়ে তার পক্ষে আইনী লড়াই করতে সরকারের খরচে মোঃ আব্দুস শুকুর খানকে আইনজীবী হিসেবে নিয়োগ দেয়। ১১ অক্টোবর এ মামলার নথিপত্র (ডকুমেন্ট) ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রারের মাধ্যমে বুঝে নেয়। ৯ সেপ্টেম্বর বাচ্চু রাজাকারের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নেয় ট্রাইব্যুনাল।
২৬ জুলাই তদন্ত সংস্থা বাচ্চু রাজাকারের বিরুদ্ধে তদন্ত কাজ শেষ করে তদন্ত প্রতিবেদন প্রসিকিউশনের কাছে জমা দেয়। এর আগে ৩ এপ্রিল বাচ্চু রাজাকারের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে ট্রাইব্যুনাল। এরপর থেকে সে পলাতক রয়েছে। পরে গত ২৫ সেপ্টেম্বর ডেইলি স্টার ও দৈনিক জনকণ্ঠ পত্রিকায় তাকে আদালতে হাজির হওয়ার হুলিয়া জারি করে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে ট্রাইব্যুনাল।

No comments

Powered by Blogger.