দেশ চালায় কারা? রাজনীতিবিদরা না-কি আমলারা? by হাবিবুর রহমান স্বপন

 মহান বিজয়ের এই মাসে মনে পড়ছে তাঁদের যাঁরা জীবন দিয়ে, মান দিয়ে, সম্পদ হারিয়ে দেশটি স্বাধীন করে গেছেন। আরও মনে পড়ছে মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কথা। তাঁর ত্যাগ এবং প্রচেষ্টা সত্ত্বেও এদেশ থেকে দুর্র্নীতিবাজদের উচ্ছেদ করা যায়নি।
বরং দুর্নীতিবাজদের খপ্পরে এখন দেশবাসী অসহায়। বঙ্গবন্ধু আফসোস করে বলেছিলেন,“সবাই পায় সোনার খনি আর আমি পেয়েছি চোরের খনি।”
আমাদের দেশের কিছু কিছু রাজনীতিবিদরা মহান নেতার নাম ভাঙ্গিয়ে লুটেপুটে খান আর গলাবাজি করেন। চোর-বাটপার-বদমাইশরাই নাকি এখন রাজনীতিবিদদের প্রিয়। সমাজের নিচুমানের নেতারা এখন রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করেন। রাজনীতি করতে প্রয়োজন টাকার; অবশ্য আগে লাগত নেতার সততা ও বলিষ্ঠ চরিত্র। সবার আগে যেটা লাগত সেটা হচ্ছে প্রচ- দেশপ্রেম এবং মেধা। ছাত্র রাজনীতি করে ধাপে ধাপে একজন নেতায় পরিণত হতেন। এখন নেতা হতে লাগে টাকা আর গোয়ার্তুমি বা মস্তানী। অনেকে অবৈধ বা কালো টাকার দাপটে (যদিও এদেশে কালো টাকা ট্যাক্স দিয়ে সাদা করা যায়) দলের মনোনয়ন পেয়ে হচ্ছেন সংসদ সদস্য, উপজেলা চেয়ারম্যান, মেয়র ইত্যাদি জনপ্রতিনিধি। ব্যতিক্রম খুব সামান্যই। ভাল মানুষ হাতে গোনা কিছু আছেন যারা রাজনীতি করেন বটে তবে তারা কোণঠাসা।
কষ্ট লাগে বঙ্গবন্ধুর মতো মহান নেতার ছবির সঙ্গে যখন দেখি একজন মস্তানের ছবি। ক’দিন আগে মুক্তিযোদ্ধা মোঃ আবু শামা আক্ষেপ করে বললেন, খুনী, মাদক ব্যবসায়ী এবং দুর্নীতিবাজদের পুঁজি এখন মহান নেতাদের ছবি। তারা বঙ্গবন্ধুর মতো মহান নেতার পাশে ছবি লাগিয়ে নববর্ষ, ঈদ-পুজা এবং জাতীয় দিবসসমূহে প্রচার করছে। প্রচুর টাকা খরচ করে বিভিন্ন জনপদে রঙিন ব্যানার লাগিয়ে দিয়ে নিজেকে জাহির করছে। তিনি বললেন, আমরা যুদ্ধ শেষে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে অস্ত্র জমা দিয়ে বাড়ি ফিরে জমিতে কৃষিকাজে মনোনিবেশ করি। কৃষক পরিবারের এই অর্ধশিক্ষিত সদস্য ভারতের দেরাদুনে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। ভারতে ট্রেনিং নেয়ার আগেই তিনি অংশ নেন নগরবাড়ি ঘাটের যুদ্ধে। ট্রেনিং শেষে তিনি অংশ নেন হিলি, চরকাই, চাঁপাইনবাবগঞ্জের বিভিন্ন সেক্টরের যুদ্ধে। সর্বশেষ তিনি অংশ নেন সাঁথিয়ার যুদ্ধে। তার বহু সহযোদ্ধা শহীদ হন। তিনি ক্ষোভের সঙ্গে আরও বললেন যুদ্ধবিদ্ধস্ত বাংলাদেশ গড়তে বঙ্গবন্ধুর প্রচেষ্টা ছিল আন্তরিক। কিন্তু কিছু চোর সে সময় রিলিফের সামগ্রী চুরি করে সম্পদের পাহাড় গড়ে।
এ প্রসঙ্গে অপর মুক্তিযোদ্ধা কলেজ শিক্ষক আয়েনউদ্দিন বললেন, স্বাধীনতার পর দেশের দুর্বল অর্থনীতির পরেও বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষাকে জাতীয়করণ করলেন। হাজার হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষক হলেন সরকারী চাকুরে। বাংলাদেশ ইসলামী দেশসমূহের সংগঠন ‘ও আই সি’র সদস্য হলো। গঠিত হলো ইসলামী ফাউন্ডেশন। এর পরের কথা যদি আলোচনা করা যায় তা’হলে বলতে হয় অপ্রিয় সত্য কথা। এই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অনেকেই স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ের দল জামায়াতে ইসলামীতে যোগ দিয়ে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে কুৎসা রটনা শুরু করলেন। হায়রে অকৃতজ্ঞ! আমলারা পাকিস্তান ধ্বংস করেছে। এটা আমার কথা নয়। বঙ্গবন্ধু তাঁর লেখা আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘জনাব গোলাম মোহাম্মদ পাকিস্তান হওয়ার পূর্বে একজন সরকারী কর্মচারী ছিলেন। তাঁকে অর্থমন্ত্রী করার ফলে আমলাতন্ত্র মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর মৃত্যুর সাথে সাথে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছিল। চৌধুরী মোহাম্মদ আলী কেন্দ্রীয় সরকারের সেক্রেটারি জেনারেল হয়ে একটা শক্তিশালী সরকারী কর্মচারী গ্রুপ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। পূর্ব বাংলায় জনাব আজিজ আহমদ চিফ সেক্রেটারি ছিলেন। সত্যিকার ক্ষমতা তিনিই ব্যবহার করতেন। জনাব নূরুল আমিন তাঁর কথা ছাড়া এক পা-ও নড়তেন না’ (তথ্য সূত্র : বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী-পৃষ্ঠা ১৭৩)। লিয়াকত আলী খানের মৃত্যুর পর পাকিস্তানের শাসন ব্যবস্থা চলে যায় আমলা এবং সামরিক জান্তাদের হাতে। এর পরেই দেশটি থেকে গণতন্ত্র নির্বাসনে যায়। যদিও ১৯৭০ সালে গণভোট দেয়া হয়, কিন্তু ভোটে জয়ী আওয়ামী লীগের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয়নি। তারপর যা হবার তাই হলো। বাংলাদেশের অভ্যুদয় হলো। তখন ভোটে জয়ী দলকে যদি ক্ষমতা হস্তান্তর করা হতো তা হলে ইতিহাস অন্য রকম হতো।
স্বাধীনতার পর এদেশকে সঠিকভাবে পরিচালিত করতে পারেননি অদক্ষ আমলারা। তবে তাঁদের আন্তরিকতার কোন অভাব ছিল না। বঙ্গবন্ধুর উদারতার সুযোগ নিয়ে একদল দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদ লুটপাট শুরু করে। এ কারণেই বঙ্গবন্ধু ক্ষোভের সঙ্গে বলেছিলেন, ‘আমার চারদিকে চাটার দল।’ অদক্ষ আমলারা চেষ্টা করেছেন। তবে তাদের যে বিজ্ঞচিত কর্মদক্ষতার দরকার ছিল সেই অভিজ্ঞতা তাদের ছিল না। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় জেলা প্রশাসক ছিলেন এমন আমলাকে সামলাতে হয় সচিবের দায়িত্ব। যেমন রাঙ্গামাটির জেলা প্রশাসক এইচ টি ইমাম পান মন্ত্রিপরিষদ সচিবের দায়িত্ব এবং পাবনার জেলা প্রশাসক নূরুল কাদের খান পান সংস্থাপন সচিবের পদ। মেহেরপুরের এসডিও ড. তৌফিক ই এলাহী চৌধুরীকে স্বাধীনতার পর দেয়া হয় যুগ্ম সচিবের পদ। একইভাবে তখন সচিবালয়ের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পান ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীরসহ কয়েকজন। দক্ষ আমলা না থাকার কারণও ছিল তখন। পাকিস্তান সরকারের সময় বাঙালীদের তেমন কোন গুরুত্বপূর্ণ পদ না দেয়ায় দক্ষ বাঙালী আমলা তৈরি হয়নি। এখন আবার সেই আমলাদের খপ্পরে পড়েছে বাংলাদেশ। রাজনীতিবিদদের চেয়ে নাকি সাবেক আমলাদের ক্ষমতাই বেশি। এটা আমার কথা নয়, সংবাদপত্র বা বিভিন্ন মিডিয়ায় এমন প্রচারই দেখা যায়। বর্তমান সরকারের উপদেষ্টাদের প্রায় সকলেই আমলা। যেমন এইচ টি ইমাম, তৌফিক ই এলাহী চৌধূরী, ড.মশিউর রহমান, ডা.মোদাচ্ছের প্রমুখ।
বঙ্গবন্ধু যেখানে আমলাদের সম্পর্কে আগেই বলেছেন তাদের কারণেই পাকিস্তানের দশা ওরকম হয়েছিল। আর কি না তারই কন্যা বাংলাদেশ পরিচালনায় রেখেছেন আমলাদের। ভাল রাজনীতিবিদরাই দেশকে এগিয়ে নিতে পারেন। আমলারা রাজনীতিবিদদের পরামর্শক হিসেবে কাজ করবেনÑ এটাই নিয়ম। কিন্তু এদেশে উল্টো নিয়ম। আমলারাই রাজনীতিবিদদের উপদেষ্টা!
আমলা সাহেবরা কি উপদেশ দিচ্ছেন সরকারকে? সরকারের নির্বাচনী ওয়াদা কতটা বাস্তবায়ন হয়েছে? ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার কাজের অগ্রগতি কতটুকু? মানুষের জানমালের নিরাপত্তা আছে তো? দেশবাসী স্বাস্থ্য সেবা পাচ্ছে তো? বিদ্যুতের চাহিদা পুরোপুরি মিটানো গেছে কি? যোগাযোগ ব্যবস্থার হাল কি? অর্থনীতির দশা কেমন? শিক্ষার হাল কি?
উপরের প্রশ্নসমূহের উত্তর খুঁজলেই জানা যাবে উপদেষ্টা নিয়োগের উপযোগিতা এবং তাদের দক্ষতার প্রমাণ। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার কাজে অগ্রগতি এখনও কাক্সিক্ষত পর্যায়ে আসেনি। শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন পেনশন ডিজিটাল পদ্ধতিতে করা যায়নি। ভূমি ব্যবস্থাপনা ডিজিটাল করা সম্ভব হয়নি। অপরাধীদের তালিকা ঘরে বসে জানা যায় না। থানা পুলিশ কিংবা জনপ্রতিনিধিদের কাছে দাগী আসামিদের নাম তালিকা নেই। বিদ্যুত, পানি, গ্যাস ইত্যাদির বিল মিটারে ডিজিটাল পদ্ধতি করা যায়নি। প্রকাশ্যে মানুষ খুনের পরও আসামি খুঁজে পাওয়া যায় না। গুম হওয়া মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। হাসপাতালে চিকিৎসা সুবিধা আগের মতই আছে। ডাক্তাররা ফাঁকি দিচ্ছেন। গ্রামে থাকতে চান না ডাক্তাররা। ওষুধের অতিরিক্ত মূল্য। বিদ্যুতের উৎপাদন দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে তবুও চাহিদানুসারে তা বাড়েনি। এখনো লোডশেডিং হচ্ছে। যোগাযোগ ব্যবস্থা নাজুক। রেল যোগাযোগ সম্প্রসারণ কাজে মন্থর গতি। সড়কগুলো সম্প্রসারণ হয়নি। প্রতিটি উপজেলায় একটি করে স্কুল ও কলেজ সরকারী হয়নি। একটি করে কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপনের কাজে হাতই দেয়া হয়নি। সবাই বক্তৃতা বিবৃতি দেন আর বলেন, বঙ্গবন্ধুর আদর্শে তাঁর স্বপ্ন বাস্তবায়ন করব। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “শিক্ষিত জনশক্তি দেশের সম্পদ। আমি বাংলাদেশে এমন ব্যবহারিক শিক্ষার প্রসার চাই, যা দ্বারা প্রতিটি নাগরিক দেশের প্রয়োজন ও চাহিদা অনুযায়ী নিজেকে গড়ে তুলতে পারবে।” সমগ্র বিশ্বে এখন ব্যবহারিক বা কারিগরি শিক্ষার কদর। অথচ সরকারের চার বছর গত হলো এ পর্যন্ত প্রতিটি উপজেলায় কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান করা গেল না। শেখ সাদীর একটি বিখ্যাত উক্তি ‘অযোগ্য লোককে দায়িত্বপূর্ণ কাজ দেয়া চরম দায়িত্বহীনতা। তা হলে কি আমরা ধরে নেব, যারা দায়িত্ব পেয়েছেন তারা অযোগ্য আর যারা দায়িত্ব দিয়েছেন তারাও! যদিও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘আমার মন্ত্রীরা শুধু স্যুটেট-বুটেড না তারা দক্ষও।
মন্ত্রীরা যেহেতু দক্ষ তাহলে আর উপদেষ্টা দরকার কী? উপদেষ্টা না থাকলে তো রাষ্ট্রের অনেক টাকাও বাঁচত। মন্ত্রী আর উপদেষ্টা থাকতে শেয়ারবাজারে কেলেঙ্কারি হলো কেন? ব্যাংকের টাকা ল্যান্ড মার্কের তানভীর গংরা তুলে নিল কি ভাবে? পদ্মা সেতু নিয়ে এতো কথা হচ্ছে কেন? অনেক কিছু একসঙ্গে আরম্ভ করে কোন কিছুই করা যাচ্ছে না। সরকার আড়িয়াল বিলে বঙ্গবন্ধু বিমান বন্দর নির্মাণের কাজে হাত দিয়ে ব্যর্থ হয়েছে। ব্যর্থ হতে চলেছে পদ্মা সেতুতে। রেল সেবা সম্প্রসারণ কাজও অনেকটা ব্যর্থ। রেলের অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করা যায়নি। নদীর অবৈধ দখলদারদেরও উচ্ছেদ করা যায়নি।
সরকারের উচ্চপর্যায়ের নেতারা এখন বলছেন, আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে অনেক উন্নয়নমূলক কাজ যথাসময়ে শেষ করা যাচ্ছে না। এত বড় বড় সাবেক আমলারা উপদেষ্টা হওয়ার পরও কেমন করে আমলারা তাদের কাজে গাফলতি করছে? আমলাতান্ত্রিক জটিলতাটাই বা কি? আর সেই জটিলতা নিরসনকল্পে সরকার কি করছে বা সরকারকে আমলারা কি পরামর্শ দিচ্ছেন?
আমরা দেশের সাধারণ মানুষ চাই নেতাদের কথা এবং কাজে মিল থাকুক। তারা সত্য ভাষণ দিন। মনে রাখতে হবে বিশিষ্ট কবি দার্শনিক শেখ সাদীর সেই বাণী “জাতির নেতা একটি ভুল করলে ছোট বড় সকলেই তার ফল ভোগ করে।” আমাদের জাতীয় নেতারা যদি ভুল করেন তার খেসারত আমাদের সকলকেই দিতে হবে। অতএব সাধু সাবধান!

hrahman.swapon@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.