জলবায়ু সম্মেলন থেকে কী পাওয়া গেল

সম্প্রতি কাতারের দোহায় অনুষ্ঠিত জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত সম্মেলন (সিওপি) ব্যর্থতার মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে। সম্মেলন গ্রীনহাউস গ্যাসের নির্গমন অর্থপূর্ণভাবে হ্রাস করতে শুধু যে ব্যর্থ হয়েছে তা-ই নয় উপরন্তু পোল্যান্ড ও রাশিয়ার মতো দেশগুলোকে ভারি শিল্প বজায় রাখার জন্য উষ্ণ বায়ু নির্গমনের যে সুযোগ দেয়া হয়েছে তাতে কার্বন নির্গমন আরও বৃদ্ধি পেতে পারে।
সম্মেলনে সত্যিকারের কোন অঙ্গীকার ঘোষিত হয়নি। অর্থায়নের বিষয়টিও এক বিরোধীয় ইস্যু হিসেবে থেকে গেছে।
জলবায়ু বিষয়ক আলোচনার গতিবেগটি কয়েক বছর আগে কোপেনহেগেন সম্মেলনে হারিয়ে যায়। দোহা সম্মেলনেও সেটিকে পুনরুজ্জীবিত করা যায়নি। কোপেনহেগেন সম্মেলনে ধনী দেশগুলো ২০২০ সাল নাগাদ ১০ হাজার কোটি ডলারের বার্ষিক তহবিল গড়ে তুলতে রাজি হয় যাতে সেই তহবিল দিয়ে গরিব দেশগুলোকে জলবায়ু পরিবর্তন বৃদ্ধির বিরূপ প্রতিক্রিয়া মোকাবেলায় সাহায্য করা যায়। কিন্তু দোহা সম্মেলনে সেই জাতীয় কোন অঙ্গীকার আসেনি।
বেশকিছু কারণে দোহা আলোচনা অচলাবস্থার মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে। একটি বড় কারণ হলো কার্বন নিগর্মন হ্রাসে বিশ্বের দেশগুলোকে বাধ্য করার জন্য কিয়োটো প্রটোকল পরবর্তী একটি অন্তর্বর্তী চুক্তি স্বাক্ষরে সম্মেলন সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। বেশিরভাগ উন্নয়নশীল দেশ এমন চুক্তি স্বাক্ষরে অস্বীকৃতি জানানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও জাপানের মতো উন্নত দেশগুলোকে দোষারোপ করেছে।
২০২০ সাল নাগাদ ১০ হাজার কোটি ডলার ক্ষতিপূরণ তহবিল গঠন নিয়ে কিয়োটো সম্মেলনে যে মতৈক্য হয়েছিল গত তিন বছরে এ নিয়ে যথেষ্ট দরকষাকষি হয়েছে। কখন কিভাবে এই অর্থায়ন করা হবে, কে ক্ষতিপূরণ দেবে এবং কাকে দেবে তা নিয়ে বেশ বিতর্ক হয়েছে সম্মেলনের বাইরে। দেখা গেছে যে, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত হারিকেন স্যান্ডির কারণে আমেরিকার যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তাতে ক্ষতিপূরণের অঙ্ক দাঁড়ায় ১০ হাজার কোটি ডলারের মতো। অথচ এই আমেরিকাই সবচেয়ে বড় পরিবেশ দূষণকারী আলোচনায় এই আমেরিকাই সবচেয়ে একগুঁয়েমির পরিচয় দিয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন অন্তর্বর্তীকালীন তহবিলে অর্থ যোগাতে রাজি হলেও যুক্তরাষ্ট্র বিশ্ব অর্থনৈতিক সঙ্কটের দোহাই পেরে অর্থ যোগানোর ব্যাপারে কোন অঙ্গীকার করতে রাজি হয়নি।
এদিকে সম্মেলনে দুর্বল নেতৃত্বদানের জন্য কাতারের সমালোচনা করা হয়েছে। কার্বন নিগর্মন ব্যাপকহারে হ্রাস করতে একটা অর্থবহ ঐকমত্যে পৌঁছানোর ব্যাপারে অন্যান্য আরব দেশকে বাধ্য করার পরিবর্তে কাতার একটি জলবায়ু গবেষণা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার রাজি হয়। সম্মেলনের সভাপতি আবদুল্লাহ বিন হামাদ আল আত্তিয়াহ বলেন যে এই প্রশ্নে আরবদের এক যৌথ অবস্থান গড়ে তোলার ব্যাপারে তার ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয়নি।
তবে দোহা সম্মেলন যে কাজটা করতে সক্ষম হয়েছে তা হলো এই যে, এটা কিয়োটো প্রটোকলের মেয়াদ শেষ মুহূর্তে বাড়িয়ে দিতে সম্মত হয়েছে। নইলে ২০১২ সাল শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে প্রটোকলের মেয়াদও শেষ হয়ে যেত। ১৯৯৭ সালের কিয়োটো চুক্তি অনুযায়ী ৩৫টি উন্নত দেশ ২০০৮-১২ এই চার বছরে তাদের কার্বন নিগর্মনের মাত্রা গড়ে অন্তত ৫ দশমিক ২ শতাংশ হারে কমিয়ে ১৯৯০ সালের মাত্রায় নিয়ে আসতে বাধ্য ছিল। গত কয়েক বছরে রাশিয়া, জাপান ও কানাডা অনানুষ্ঠানিকভাবে এই চুক্তি থেকে বেরিয়ে গেছে। কিন্তু তারপরও কিয়োটো প্রটোকল জলবায়ুর ক্ষেত্রে একমাত্র দলিল হিসেবে টিকে আছে যা মেনে চলার ব্যাপারে আইনানুগ বাধ্যবাধ্যকতা কাজ করে। এই যে আইনানুগ বাধ্যবাধকতা এর পিছনেও রয়েছে কার্বন নির্গমন ব্যাপকহারে হ্রাস করার ব্যাপারে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও অস্ট্রেলিয়ার প্রদত্ত গভীর প্রতিশ্রুতি।
পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা ইতোমধ্যে দশমিক ৮ ডিগ্রী সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে গুরুতর আবহাওয়াঘটিত দুর্যোগ সৃষ্টি হচ্ছে। সুমেরুর অধিকাংশ বরফ গলে গেছে। অন্যান্য মারাত্মক পরিবেশগত সমস্যাও দেখা দিয়েছে। তবে তাপমাত্রা যেহারে বাড়ছে সেহারে বাড়তে থাকলে চলতি শতাব্দীর শেষ দিকে ৪ ডিগ্রীরও বেশি বেড়ে যাবে। এর পরিণামে ভয়াবহ তাপপ্রবাহ ঘটবে। খরা দেখা দেবে। সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে উপকূলীয় অঞ্চলের কোটি কোটি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। দোহা শীর্ষ বৈঠকের পর এই ভবিষ্যত বাণীগুলো অপরিবর্তিত আছে। জাতিসংঘ পরিবেশ কার্যক্রমের এক রিপোর্ট উপরোক্ত অবস্থার প্রতিকারে যেসব জরুরী পদক্ষেপের দাবি জানানো হয়েছিল দোহা সম্মেলনে দু’সপ্তাহের আলোচনা শেষে গৃহীত চূড়ান্ত ইশতেহারে সেগুলো উপেক্ষিত হয়েছে। ইশতেহারে গ্রীনহাউস গ্যাস নিগর্মন সম্পর্কিত কিয়োটো পরবর্তী চুক্তি ২০১৫ সালের মধ্যে চূড়ান্ত করার অঙ্গীকার ঘোষিত হয়েছে এবং সেই নতুন চুক্তিটি ২০২০ সালে কার্যকর হবে। অথচ জাতিসংঘ পরিবেশ কার্যক্রমের প্রধান বিজ্ঞানী অধ্যাপক জোসেফ এলকামো দোহা সম্মেলনের আগেই হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছিলেন যে পৃথিবীর উচ্চতা বৃদ্ধি যদি ২ ডিগ্রী সেলসিয়াসে সীমাবদ্ধ রাখতে হয় তাহলে বিশ্বব্যাপী কার্বন নিগর্মনের মাত্রা ২০৩০ সাল নাগাদ বর্তমান মাত্রার ২৫ শতাংশ নিচে নামিয়ে আনতে হবে এবং ২০৫০ সাল নাগাদ তা বর্তমান নিগর্মন মাত্রার ৫০ শতাংশেরও বেশি কমিয়ে ফেলতে হবে। কার্বন নিগর্মন হ্রাসে এসব কঠোর কার্যক্রমগুলো শুরু করার জন্য আমাদের ২০২০ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করে থাকার উপায় নেই। কিয়োটো প্রটোকলের মেয়াদ দোহা সম্মেলনে ৮ বছর বাড়ানো হয়েছে সত্য। কিন্তু এই মেয়াদ বাড়িয়ে কার্বন নির্গমন খুব একটা হ্রাস করা যাবে না।
চলমান ডেস্ক

No comments

Powered by Blogger.