রঙে রাঙা লন্ডন অলিম্পিক by জাহিদুল আলম জয়

 সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনার কাব্যগাথা সঙ্গী করে ২০১২ সালে সম্পন্ন হয়েছে বিশ্বের সর্ববৃহৎ ক্রীড়া আসর অলিম্পিক গেমস। সুরের মূর্ছনায় বিদায় জানানো হয় ৩০তম আসরকে। পূর্ব লন্ডনের স্ট্যার্টফোর্ডের অলিম্পিক স্টেডিয়াম সমাপনী দিনে সেজেছিল বর্ণাঢ্য সাজে।
ব্রিটিশ ফ্যাশন ও সঙ্গীতের মূর্ছনায় সফল আয়োজনে ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই করে নিয়েছে ইংল্যান্ডের রাজধানী লন্ডন। অবিশ্বাস্য, অবিস্মরণীয়, তাক লাগানো, মনোমুগ্ধকর, জমকালো, বর্ণিল কোন উপমাই গ্রেট ব্রিটেনের জন্য যথেষ্ট নয়। এককথায় বলতে হবে- সর্বকালের অন্যতম সেরা অলিম্পিক গেমস উপহার দিয়েছে লন্ডন। মাঠ এবং মাঠের বাইরে সমান সফল হয়েছে দেশটি। গত ২৭ জুলাই অলিম্পিক স্টেডিয়ামে বর্ণাঢ্য উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষে জ্বলে উঠেছিল যে মশাল, টানা সতেরো দিন সাড়ে দশ হাজার বিশ্বসেরা এ্যাথলেটের আলো ছড়ানো অনবদ্য ক্রীড়া নৈপুণ্যের মাধ্যমে তার সমাপ্তি ঘটে গত ১২ আগস্ট। যুক্তরাষ্ট্রের সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধার, চীনের শীর্ষস্থান হাতছাড়া, স্বাগতিক গ্রেট ব্রিটেনের শত বছরের সেরা সাফল্য, গতির রাজা উসাইন বোল্টের গৌরবময় কীর্তিগাথা, মাইকেল ফেলপসের সবচেয়ে বেশি অলিম্পিক পদক জয়ের রেকর্ড, পা হারানো দৌড়বিদ অস্কার পিস্টোরিয়াসের ঐতিহাসিক অংশগ্রহণ, ব্রাজিল পুরুষ ফুটবল দলের আরও একবার স্বর্ণ জিততে না পারার হাহাকার, বিভিন্ন ডিসিপ্লিনে রেকর্ড ভাঙা গড়ার খেলা এরকম অসংখ্য কীর্তির সাক্ষী হয়ে রয়েছে এবারের ৩০তম লন্ডন অলিম্পিক। চার বছর আগে বেজিং অলিম্পিকে স্বাগতিক চীনের কাছে শ্রেষ্ঠত্ব হারিয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এবার লন্ডন অলিম্পিকে তাই শীর্ষস্থান ফিরে পাওয়ার চ্যালেঞ্জে এসেছিলেন মার্কিন এ্যাথলেটরা। সতেরো দিনের ময়দানী লড়াইয়ে চীনকে টপকে প্রত্যাশিতভাবে সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধার করে যুক্তরাষ্ট্র। এবারের লন্ডন অলিম্পিকে ৪৬ স্বর্ণ এবং ২৯টি করে রৌপ্য ও ব্রোঞ্জসহ মোট ১০৪টি পদক পেয়ে সবার সেরা হওয়ার কৃতিত্ব দেখায় অলিম্পিকের ইতিহাসে সেরা সাফল্যের দেশ যুক্তরাষ্ট্র। ৩৮ স্বর্ণ, ২৭ রৌপ্য, ২৩ ব্রোঞ্জসহ মোট ৮৮টি পদক পেয়ে দ্বিতীয় স্থান নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয় বেজিংয়ের সেরা চীনকে। তৃতীয় স্থান পায় স্বাগতিক গ্রেট ব্রিটেন। নিজেদের অলিম্পিক ইতিহাসে ১০৪ বছরের সেরা সাফল্য প্রদর্শন করে ব্রিটিশরা। ২৯ স্বর্ণ, ১৭ রৌপ্য, ১৯ ব্রোঞ্জসহ গ্রেট ব্রিটেনের ঝুলিতে জমা পড়ে ৬৫টি পদক। তবে দুর্ভাগা বলতে হবে রাশিয়াকে। মোট ৮২টি পদক জিতেও তাদের সন্তুষ্ট থাকতে হয় চতুর্থ স্থান নিয়ে। এর কারণ সোনা, রূপার চেয়ে তারা বেশি জয় করে ব্রোঞ্জপদক। ২৪টি স্বর্ণের বিপরীতে রাশিয়া জয় করে ২৫টি রৌপ্য ও ৩৩টি ব্রোঞ্জপদক। পদক তালিকার সেরা দশে চীন ছাড়া জায়গা পায় আর মাত্র একটি এশিয়ান দেশ। দক্ষিণ কোরিয়া। ১৩ স্বর্ণ, ৮ রৌপ্য, ৭ ব্রোঞ্জসহ ২৮টি পদক নিয়ে তাদের অবস্থান পঞ্চম।
এছাড়া পদক তালিকার ষষ্ঠ থেকে দশম স্থান পাওয়া দেশগুলো হলোÑজার্মানি, ফ্রান্স, ইতালি, হাঙ্গেরি ও অস্ট্রেলিয়া। এশিয়ার আরেক দেশ জাপান অল্পের জন্য সেরা দশের বাইরে চলে যায়। জার্মানি ১১ স্বর্ণ, ১৯ রৌপ্য ও ১৪ ব্রোঞ্জসহ জয় করে মোট ৪৪টি পদক। সপ্তম স্থান পাওয়া ফ্রান্স ১১টি করে স্বর্ণ ও রৌপ্য এবং ১২টি ব্রোঞ্জসহ মোট ৩৪টি পদক জয় করে। ৮ স্বর্ণ, ৯ রৌপ্য ও ১১ বোঞ্জসহ মোট ২৮টি পদক জিতে অষ্টমস্থানে ইতালি। ৮স্বর্ণ, ৪ রৌপ্য ও ৫ ব্রোঞ্জসহ মোট ১৭টি পদক পায় নবম স্থান পাওয়া হাঙ্গেরি। সাঁতারে রাজত্ব খুইয়ে দশম স্থান নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয় অস্ট্রেলিয়াকে। ৭ স্বর্ণ, ১৬টি রৌপ্য ও ১২ ব্রোঞ্জসহ ৩৫টি পদক জেতেন অসি এ্যাথলেটরা। ৭ স্বর্ণ, ১৪ রৌপ্য, ১৭ ব্রোঞ্জসহ মোট ৩৮টি পদক পেয়ে পদক তালিকার একাদশতম স্থান জাপানের। চমক দেখানো কাজাখস্থান ৭ স্বর্ণ, ১ রৌপ্য, ৫ ব্রোঞ্জসহ মোট ১৩টি পদক জয় করে। তালিকায় তাদের অবস্থান দ্বাদশ। এটি কাজাখস্থানের অলিম্পিক ইতিহাসে সেরা সাফল্য। লন্ডন অলিম্পিকে ৩০২টি স্বর্ণ জয়ের লড়াইয়ে বিশ্ব রেকর্ড হয় ৩০টি। আর পদক জয় করে ৮৫টি দেশ। চীনের বেজিংয়ে অনুষ্ঠিত ২০০৮ সালের অলিম্পিকে মার্কিন সাম্রাজ্য গুড়িয়ে দিয়ে প্রথমবারের মতো শ্রেষ্ঠত্ব নিজেদের করে নিয়েছিল এশিয়ার গর্বের প্রতীক চীন। সেবার ৫১ স্বর্ণসহ ১০০টি পদক জিতে সবার সেরা হয়েছিল বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশটি। মোট ১১০টি পদক জিতলেও স্বর্ণসংখ্যা (৩৬) কম হওয়ায় দ্বিতীয় হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। চার বছর পর এবার মুকুট ধরে রাখার মিশনে এসেছিল চীনারা। আর মার্কিনীদের লক্ষ্য ছিল হারানো সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধার। এই লড়াইয়ে যুক্তরাষ্ট্র সফল হলেও সাম্রাজ্য হাতছাড়া হয় চীনের। বেজিংয়ে যুক্তরাষ্ট্র ৩৬ স্বর্ণ জিতলেও এবার পায় ৪৬টি স্বর্ণ। তবে সার্বিকভাবে তাদের পদকের সংখ্যা কমেছে। গত আসরে যুক্তরাষ্ট্র মোট পদক জিতেছিল ১১০টি, এবার সে সংখ্যা ১০৪টি। তবে মোট পদকের সংখ্যা কমলেও এবার আগের আসরের চেয়ে ১০টি স্বর্ণ বেশি পাওয়ায় সিংহাসন ফিরে পায় যুক্তরাষ্ট্র। চীনের শীর্ষস্থান হাতছাড়া হওয়ার মূল কারণ বেজিংয়ে পাওয়া সাফল্য ধরে রাখতে না পারা। আগেরবার চীন স্বর্ণ জিতেছিল ৫১টি। লন্ডনে সে সংখ্যা ৩৮টি। অর্থাৎ ১৩টি স্বর্ণ কমে গেছে চীনাদের। মজার ব্যাপার হচ্ছে, বেজিংয়ের চেয়ে এই ১৩টি পদকই এবার কম পেয়েছে চীন। ব্যক্তিগত সাফল্যের বিচারে মার্কিন এ্যাথলেটদের কাছে কেউ পাত্তাই পায়নি। প্রতিযোগিতায় পুরুষ ও নারী উভয় বিভাগেই ব্যক্তিগত ইভেন্টে শীর্ষস্থানে ছিলেন মার্কিন প্রতিযোগীরা। ইতিহাস সেরা সাঁতারু ও সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ অলিম্পিয়ানের মুকুট পরা মাইকেল ফেলপস ৪টি স্বর্ণ ও ২টি রৌপ্যপদকসহ ৬টি পদক জয় করেন। তার চেয়ে একটি পদক কম জেতেন আরেক আমেরিকান প্রমীলা সাঁতারু মিসি ফ্রাঙ্কলিন। ৪টি স্বর্ণ ও একটি ব্রোঞ্জসহ তিনি জয় করেন ৫টি পদক। ব্যক্তিগত পদকের বিচারে সেরা দশের তালিকায় সাঁতটি নামই যুক্তরাষ্ট্রের অলিম্পিয়ানদের। ব্যতিক্রমী তিনটি নাম হলো উসাইন বোল্ট, সুন ইয়াং ও অ্যাগনেল ইয়ানিক। বিশ্বের দ্রুততম মানব উসাইন বোল্ট তিনটি স্বর্ণপদক নিয়ে ব্যক্তিগত অর্জনের তালিকায় আছেন চতুর্থ স্থানে। দুটি স্বর্ণ এবং একটি করে রৌপ্য ও ব্রোঞ্জ পেয়ে সেরা দশে জায়গা করে নেন চীনা সাঁতারু সুন ইয়াং। এ তালিকায় ঠাঁই পেয়েছেন আরেক সাঁতারু ফ্রান্সের অ্যাগনেল ইয়ানিক। তিনি জয় করেন দুটি স্বর্ণ ও একটি রৌপ্যপদক।

No comments

Powered by Blogger.